একদা কোন এক এলাকায় বাইরে থেকে কিছু শিয়াল আমদানি করা হয়েছিল, উদ্দেশ্য ছিল শিয়ালগুলো এলাকার মৃত মুরগী খেয়ে পরিবেশ দূষন থেকে রক্ষা করবে। কিন্ত ঘটনা ঘটল উল্টো। শিয়ালের সংখ্যা গেল বেড়ে এবং এলাকায় ক্ষুধার্ত শেয়ালেরা এখন সুস্থ মুরগীগুলোও ধরে খাওয়ার পায়তারা করছে।
এই হল এদেশের অসাধু ঔষধ কোম্পানিগুলোর উদাহরণ। এসব অসাধু ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি তাদের স্বার্থ পূরনের জন্য জীবন রক্ষাকারী সকল ঔষধ তুলে দিয়েছে ওষুধের দোকানদার দের হাতে। মাসিক এবং বার্ষিক ব্যবসায়িক লক্ষ্য পূরন করার জন্য প্রতিটা ঔষধ কোম্পানি যে কোন উপায়েই হোক ঔষধ বিক্রয় করছেন। তাদের হয়ত সেই ধারনাই নেই যে তাদের বিক্রিত ঔষধের কত ভাগ, রোগির কল্যাণে সঠিক ও যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে। কোম্পানিগুলো সেই দিকে ফিরে তাকাতে চায়ও না। তাদের কোম্পানির ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া মাত্রই এরা দায়মুক্ত । কিন্তু আসলে কি তাই?
গত বছর আমার এক পরিচিত RMP পরিবারসহ বিদেশ ভ্রমন করে এসেছে ঔষধ কোম্পানির স্পন্সরে। এই হল সে সকল কোম্পানির টার্গেট ফুলফিলের নেপথ্য। এখনও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছেন না?
দেশের গ্রামে গঞ্জে, হাট-বাজারে ঔষধের যে পরিমাণ অপব্যবহার তার জন্য সবচেয় বেশী দায়ী হচ্ছে এসকল কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভরা। এরাই ফার্মাসিওয়ালাদের ঔষধ চিনিয়েছে এবং তাদেরকে ডাক্তার সাজার জন্য উদগ্রিব করে তাদের হাতে কাঁচামাল সরবরাহ করেছে। এদের এই অল্প অল্প বিদ্যা নিয়েই ফার্মাসিওয়ালা ক্রমে একজন ডাক্তার সেজে শুরু করেছে ঔষধের যত্রতত্র প্রয়োগ। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের বাইরে বছরে দেশে কত বিলিয়ন টাকার ঔষধ বিক্রয় হচ্ছে তার কোন পরিসংখ্যান কি সরকারের কাছে আছে? বিএসএমএমইউ’র প্রতিনিয়ত এন্টিবায়োটিক রেজিসটেন্স এর উপর এলার্মিং রিসার্চেও সরকারের খুব টনক নড়ছে বলে মনে হয় না। যদি টনক নড়ত, নিয়ম কানুন তো আগে থেকেই আছে, সেগুলো কেন প্রয়োগ করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না ?
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে এখনও মেধাসত্ত আইনে ছাড় পেয়ে নিজের দেশের স্বল্প দামে ঔষধ মেনুফেকচারিং করতে পারে, এই ছাড় ২০৩৪ পর্যন্ত যথাসম্ভব বহাল থাকবে। এই আইন হচ্ছে গরিব দেশগুলোর প্রতি মেধাসত্ব অধিকারি দেশগুলোর প্রতি দয়া দেখানো ছাড়া আর কিছু না। আর সেটা সম্ভবত WHO, UN, FDA মিলে নির্ধারণ করে থাকে কোন কোন দেশকে এই ছাড় দেওয়া হবে। দেশ ফ্রিতে ঔষধের মেধাসত্ব পায় আর ফার্মাসিওয়ালারা এসব ঔষধ প্রেস্ক্রিপশন বানিয়ে লিখে। বেআইনি হলেও এই ক্ষেত্রে যেন আইনের শিথিলতা ব্যাপক।
খুব কমই শুনেছি যে OTCs drugs এর বাইরে নিজের মত করে ঔষধ বিক্রয়ের ফলে অমুক ফার্মাসির কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আবার নিজের নামের পূর্বে ডাঃ লিখতেও বেশ আগ্রহী এরা। শুধু ঔষধের কমার্শিয়াল নাম জেনেই যে ডাক্তার সাজা যায় না, এটা তাদের বলবে কে ? এছাড়া কখনো কখনো চিকিৎসকের দেওয়া প্রেস্কিপশনের ওষুধের সাথে নিজের ইচ্ছায় দুই একটা বাড়তি ঔষধ দিয়ে রোগিকে ‘এগুলোও সাথে লাগবে’ বলার অভ্যাসও আছে এদের।
সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, দেশে নাকি বর্তমানে ১০৩৩ রকম জেনেরিকের ঔষধ মেনুফেকচারিং এবং ব্যবহার হচ্ছে। জানতে ইচ্ছে হয় এর কয়টা আমাদের দেশের বিজ্ঞানিদের দ্বারা আবিষ্কৃত? দেশের কয়টা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির তৈরি করা নতুন কয়টা ওষুধ FDA দ্বারা অনুমদিত আছে জানা নাই।
তাহলে পুরো ব্যপারটা দাঁড়াল যে, দুনিয়ার বিখ্যাত বিখ্যাত সব ওষুধ কোম্পানির মেধাবী বিজ্ঞানীরা বছর বছর নিরলস গবেষণা করে জীবন রক্ষাকারী একেকটা ওষুধ আবিষ্কার করবেন আর আমাদের দেশ সেটার মেধাসত্ত মাগনায় পেয়ে গ্রামগঞ্জের ফার্মাসিওয়ালা দিয়ে সেই ওষুধ বিক্রি করবে। এটাই কি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা?
এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রিধারি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের উপদেশ ছাড়া কেনা যায় এমন ওষুধ (OTC drugs) আগে খুব সম্ভবত ১৪ টা ছিল। এখন নতুন লিস্টে আরও ১৫ টা যোগ করে মোট হয়েছে ৩৯ টা। যেখানে একটা ছোট্ট এন্টিবায়োটিকের ওরাল ফর্ম পর্যন্ত রাখা হয়নি, শুধু neomycin/gentamicin এর টপিক্যাল ব্যবহারের অয়েন্টমেন্ট রাখা হয়েছে, সেখানে এখনও কিভাবে গ্রামে গঞ্জে Meropenam, Cefepime, Moxifloxacin, Tazobactum injections মামুলি ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ??
আর Resistance শুধু এন্টিবায়োটিকই করে তা নয় কিন্তু, যে কোন ওষুধ Resistance করতে পারে। তাই কোন ড্রাগই রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের হাতছাড়া করা যাবে না। তাহলে কবে বন্ধ হবে এই ঔষধ নিয়ে বাণিজ্য? কবে জীবন রক্ষাকারী ঔষধের আইন বাস্তবায়িত হবে আর সেই আইন যথাযথ প্রয়োগ রাখা হবে?
ঔষধ শুধুই হউক জীবন রক্ষার জন্য জীবিকার রক্ষার জন্য নয়।
জীবিকা নির্বাহের বহু উপায় আছে। যারা বেআইনিভাবে ঔষধকে জীবিকার জন্য অপব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক। চিকিৎসকদের হাতিয়ার একটাই সেটা হল ‘ঔষধ’, এটা যে কারো খেলার পন্য নয়, তাই ঔষধের অপব্যবহার ঠেকাতে চিকিৎসকদেরই সর্বপ্রথম এগিয়ে আসতে হবে।
নতুবা যে ঔষধ দিয়ে রোগমুক্তি করতে বছরের পর বছর চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ে ডাক্তার হলেন, সেই ঔষধই যদি রোগ সারাতে অকার্যকর হয়ে পড়ে, তাহলে ডাক্তার হয়েও আমাদের পকেটে হাত নিয়ে গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না।
লিখেছেন ঃ ডাঃ শাকিল আহমেদ সরকার, MBBS ( Liaquat University of Medical & Health Sciences, Pakistan).
Thanks