দুই ধরনের সম্ভাবণা এখানে উঠে আসে –
আমরা দেখেছি, পরিবারের কারো উপর রাগ করে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিতে। যেটা একান্তই মামুলী বিষয়। ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করে বোন কিম্বা বোনের সাথে ঝগড়া করে ভাই, কিম্বা অন্যান্য।
আবার সিরিয়াস কেইসও আমরা দেখি, স্ত্রী কিম্বা স্বামীর বনিবনা না হওয়া। শ্বশুড় বাড়িতে মেয়েদের নির্যাতনের করুণ কাহিনী।
আজ আমরা সবাই এসব দেখে বলছি, আহা কেন করলো এমন, ছেলেটা ভুল করেছে, মেয়েটা ঠিক করেনি। বাট, সমস্যা আমাদের সবারই আছে, কম বেশী। আজ আত্মহত্যার ঘোর বিরোধী মানুষটাও যেদিন নিজের জীবনে জটিলতায় পড়বেন দেখা যাবে নিজের অজান্তেই তিনি আত্মহনন এর পথ বেছে নিচ্ছেন।
আমরা উন্নত হচ্ছি কিনা জানিনা তবে আমাদের সমস্যা চাপা দিয়ে রাখার মানসিকতা পরিবর্তন আশু প্রয়োজন।
যে ছেলে কিম্বা যে মেয়ে সংসারে অসুখী তাকেও আমরা ধরে রাখছি সো কলড সামাজিকতার দোহাই দিয়ে, কিন্তু কেন? কে কি বলবে, কে কি ভাববে সেটা নিয়ে এত চিন্তিত কেন আমরা? আর একজনের সাথে না বনিবনা হলেও সারাজীবন কেন একসাথে থাকতে হবে? এই সমাজের কি রাইট আছে ওদের বেঁচে থাকাকে এমন দুর্বিসহ করে তোলার? ধর্মে কিম্বা আইনে দুই জায়গাতেই তো স্যাপারেশান নামক শব্দটা আছে, তাই না?
ওমুক মেয়ে যৌতুকের বলি, এই আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। মা বাবারা ধুম করে মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন এক বস্তা যৌতুক। বাহ! সমাজ দেখলো উনি কত ক্ষমতাধর। এমন সমস্যা হলে, মেয়েকে ওই বাড়ি থেকে তুলে নেয়াটাই আমি সমীচিন মনে করি। এভাবে আর কত?
সেদিন দেখলাম ৫ ছেলে মেয়ে তাদের মাকে দেখেন না। কিন্তু এই ৫ ছেলে মেয়ে ও তাদের বেটার হাফ মিলে মোট ১০ জন। কেন তারা তাদের মা কে দেখলো না? কারন একটাই, ছেলে ছেলের বউ এদের সাথে বনাবনি হয় না। এতে দোষটা কার? আমাদের সমাজের এই এক অসুক দোষ খুঁজতে থাকি আমরা। সমস্যা সমাধান নয় বরং দোষ খুঁজে কাউকে দোষী করে বাংলা সিনেমার হ্যাপি এন্ডিং দিতে পারলেই আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। আমরা ওল্ড হোমের ঘোর বিরোধী অথচ আমাদের প্রতিটা ঘরেই বৃদ্ধ মানুষ গুলো অবহেলার শিকার হয়। বয়স হয়েছে, বৃদ্ধ, এই বলে তাদেরকে সুবিধা কয়জন দেয়? নিজের মা বাবাকে যারা বউয়ের হেফাজতে দিয়ে শান্তি খুঁজতে চায়, আমি তাদের দলে নাই! কেন অন্যের মেয়ে আমার মা বাবার দায়িত্ব নিবে? আর যারা মানবতার খাতিরে দায়িত্ব নিয়ে বড়াই করে তাদের জন্য আমার করুণা। যা করেছেন সেটা আপনার মহত্ম, এটা ফলাও করে নিজেকে ছোট করার কিছু নেই।
বিদেশে বেবী কেয়ার সিস্টেম যেমন আছে ওল্ড হোমও আছে, কই কেউ তো কিছু বলছে না। ওখানে ডিভোর্সের হার অনেক বেশী, আমাদের দেশেও কম কোথায়? কিন্তু মৃত্যুর মিছিল আর কত?
কেউ একজনের আরেকজনকে ভালো নাই লাগতে পারে, এটা পরিষ্কার বলে দেয়াটাই সমীচিন। একসাথে থেকে জীবনটাকে বিষাক্ত করার মত পাপ আর নাই। দায়টা সমাজকেই নিতে হবে। এখন আর সেইদিন নেই। যুগের সাথে তাল মিলানোকে বলে আধুনিকতা, আর এই আধুনিকতার শিক্ষা ধর্মেই আছে। ডিভোর্স বা তালাক, মা বাবার হক আদায় কিম্বা যৌতুক প্রসংগে ধর্মের দিক নির্দেশনা ভীষন স্পষ্ট৷
আমরা যদি পরিষ্কার ভাবে ধর্ম মানতাম আমরা প্রতিটা মানুষকেই শান্তি দিতে পারতাম। আমরা সমাজকে একটু বেশীই মানি, ধর্মকে নয়। সমাজের বাইরে কিছু হলেই সেটাকে বলে ফেলি মডার্ণ লাইফ, ওয়েস্টার্ন ইত্যাদি। অথচ, ধর্মে যে বিধান আছে সেটা সামাজিকতার পরিপন্থী। সম্পর্কে প্রাণ থাকাটাই সবচেয়ে জরুরী।
যাই হোক, আজ এত কথা বলছি, কোন একদিন যে আমিও সেই কাতারে নাম লেখাবো না তার কি গ্যারেন্টি? অস্থির এক সময়ের দিকে এগিয়ে চলছি আমরা। আমাদের কোন দিক নির্দেশনা নেই। আমরা আছি সমালোচনায়, আমরা আছি নিজেকে ভালো প্রমাণের আর মিথ্যা অভিনয়ের বেসাতি গড়তে। কারো ফেইসবুকের স্মাইলিং কাপল ছবি দেখে ভাবার কোন কারন নেই যে সে খুব সুখে আছে৷ আজকাল সুখ বিক্রি হয় সহজেই, এহাত ওহাত ঘোরে কিন্তু মনের ভেতর স্থায়ী হয়না।
আমাদের অভিভাবকরা, আমাদের সমাজ, আমাদের বিবেক, বন্ধু, পরিজন এই ব্যর্থতা আমাদের সবার। অন্যের জীবনের রসালো গল্প নিয়ে নাস্তার টেবিলে ঝড় তোলার আগে প্লিজ নিজের পরিবারকে দেখুন। যতটুকু কষ্ট আছে শেয়ার করুন, সাবধান, এমন কাউকে কিছু বলবেন না যা পরে আপনাকে সারাজীবনের জন্য ঋণী করে রাখে। বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। যেখানে ভালোবাসা নেই, শ্রদ্ধা নেই সেখানে বিশ্বাস আসবে কোথা থেকে?
#আসুন_মৃত্যুর_মিছিল_বন্ধ_করি
ডা. মৃণাল সাহা