করোনার দিনগুলি – ১২ | উই কান্ট ব্রেদ

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, শনিবার, ৬ জুন, ২০২০
ডা. মাশকুরুল আলম
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ
২০১০-১১

লক ডাউন উঠে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও রাস্তায় শব্দ করে বীরদর্পে গাড়ি চলছে। মানুষগুলো বেপোরয়াভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কারো মুখের মাস্ক থুতনীতে, কারও আবার গলায়। একজন মাস্ক খুলে সিগারেট টানছে, আর একজন খুব সতর্ক। গাউন পড়ে বাইক চালাচ্ছে, প্রচন্ড গরমে সে গাউনের সামনের চেইন খোলা রেখেছে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে এক ছোট্ট ছেলে। তার পড়নে কাপড় নেই। মুখে মাস্ক তো দূরের কথা। ও কোভিড কি বোঝে না। হয়ত একদিন তার জ্বর হবে,কাশি হবে। শ্বাসকষ্ট হয়ে হুটহাট মরে যাবে। ডাক্তার লিখবে মৃত্যুর কারণ সন্দেহজনক কোভিড অথবা এটিপিক্যাল নিউমোনিয়া।

কিছুক্ষণ আগে পুলিশ এসে টহল দিয়ে গেল রাস্তায়, স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্য। পুলিশকে দেখে সবাই দৌড়ে পালালো। কেউ কেউ আবার পকেটের মাস্ক মুখে উল্টা সিধা না দেখেই পড়ে নিল। একজন আবার মাস্ক নেই বলে পড়নের শার্ট উপরে তুলে মুখ ঢাকার চেষ্টা করছে।

আজ সারাটা বিকেল হোটেল রুমের জানালা দিয়ে এসবই দেখল ডাক্তার শফিক। এরপর সন্ধ্যায় একটু টিভি ছেড়ে খবর দেখল। ভাল খবর খুব কম। আমেরিকায় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন চলছে, একজন পুলিশ শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে একজন কালো বর্ণের মানুষকে। আহা! কি নিষ্ঠুর! আন্দোলনের শ্লোগানটা শফিকের ভাল লেগেছে।
“আমরা শ্বাস নিতে পারছি না, উই কান্ট ব্রেদ!”
শফিকের মনে পড়ল কবি উপন্যাসের লাইনগুলো,
“কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো কেনে
কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?”

পৃথিবীতে পাপিষ্ঠরা সৌন্দর্য্য দেখে না, প্রকৃত সৌন্দর্য্য দেখতে হলে স্বচ্ছ একটি আত্মা প্রয়োজন। পাপিষ্টের সে আত্মা থাকে না।তারা কালো চুলে কুসুমের সৌন্দর্য্য দেখে চোখ জুড়াতে পারে না, কালো কোকিলের গানে মন ভরাতে পারে না।
সে এসব কি ভাবছে, একটু সাহিত্যিক ভাবনা চলে আসছে। মেডিকেলে পড়ার সময় শ’য়ে শ’য়ে উপন্যাস আর কবিতা পড়ার ফসল। কথায় কথায় কবিতার লাইন মাথায় চলে আসে। এক সময় তার কাছে টাকা থাকত না। গল্পের বই কিনতে পারত না। দুইবেলা খাবারের টাকা বাঁচিয়ে সে গল্পের বই কিনেছে।একবার সে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বই কিনল।অনেকগুলো কবিতা পড়ার পর তার মন খারাপ হল। এত শক্ত কবিতা সে আগে কখনো পড়ে নি। মনে হচ্ছে দু বেলা খাবারের টাকা জলে গেল। এরপর পঞ্চাশ পৃষ্ঠায় একটা লাইন তার খুব ভাল লাগল।
“বুকের ভিতরে কিছু পাথর থাকা ভাল, ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়”
এই একটা লাইনের জন্যই বইটা তার ভাল লেগে গেল।

টিভিতে আবার খবরে চোখ গেল। সেই খারাপ সংবাদ। ঈদের পরে বেড়েছে করোনার প্রকোপ।আবেগী মানুষগুলো লকডাউন অমান্য করে ঈদে বাড়ি গেছে। সংক্রমণ বেড়ে গেছে। ঢাকা থেকে ট্রাকে ট্রাকে মানুষ বাড়ি ফিরেছে। একটা ঈদ তাদের বাহিরে করা চলবে না। এই উপমহাদেশের মানুষের জীনের প্রতিটা কোডনে আবেগ আর আবেগ। এই জীনের মিউটেশন হয় না। এবার ঈদে শফিক কোভিড হসপিটালে ডিউটিতে ছিল। ঈদের সকালে রাউন্ডে গেল সে। অনেক রুগীই সুস্থ হয়ে উঠেছে। সুস্থ রুগীগুলো বাড়ি ফেরার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। টেস্ট নেগেটিভ আসছে না বলে যেতে পারছে না। শফিক তিনঘন্টার রাউন্ড শেষ করে ডাক্তার রুমে চলে এল। তার মাকে একটা কল দিতে হবে। মাকে ছাড়া তার অনেক ঈদ হসপিটালে কেটেছে। এবারে কথা দিয়েছিলো এই ঈদ অন্তত পরিবারের সাথে কাটাবে। মার জন্য নতুন শাড়ি কেনা হয়েছে, বাবার জন্য পাঞ্জাবী। প্রতি ঈদে মা তার প্রিয় নুডলস আর পায়েশ রান্না করে রাখে। এবারেও হয়ত রেখেছে। হয়ত কে জানে সে সব নিয়ে ছেলের জন্য এই ঈদের দিনেও আয়োজন করে কাঁদছে। মায়েরা এমনি, চোখের জল রিজার্ভ রাখে, সময়ে অসময়ে সন্তানের জন্য সে জল গড়ায়। মাকে ফোন দিয়েছে সে, কান্নাজড়িত কন্ঠে মা ফোন তুলেছে। এদিকে নার্সের রুম থেকে ফোন এল। ২৩ নং কেবিনের রোগীর অবস্থা খারাপ। ফোন রেখে তাকে যেতে হল। রোগীর স্যাচুরেশন কমে যাচ্ছে। হাই ফ্লো অক্সিজেনে কাজ হচ্ছে না। আই সি ইউ সাপোর্ট লাগবে। এই মুহুর্তে আই সি ইউ বেড ফাঁকা নেই। অক্সিজেন ফ্লো বাড়িয়ে দিল সে। রোগীর পজিশন চেঞ্জ করল। ৩ ঘন্টা পর রোগী একটু ইম্প্রুভ করল। শফিক খুব ক্লান্ত। এতক্ষণ পিপিই পড়ার জন্য সে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। বাসায় একটা কল করা যায়। তার ইচ্ছে করছে না। মায়ের সাথে কথা বলা হল না। ঈদের দিনটা এভাবেই কেটে গেল। ডাক্তারদের এতটা আবেগ থাকতে নেই। এতটা আবেগ থাকলে বাঁচা মরার খেলা খেলবে কিভাবে। ডেথ সার্টিফিকেট সুন্দর করে লিখবে কিভাবে, অপারেশন টেবিলে ফিনকি দেওয়া রক্তপাত বন্ধ করবে কিভাবে? সবার আবেগ দেখাতে নেই। অনেকের বুকেই পাথর রাখতে হয়, শব্দ করলে প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়।

টিভি বন্ধ করে হোটেলের ব্যালকনীতে এল সে। আকাশে আজ পাগল করা চাঁদ উঠেছে। একদম ঘর ছাড়ার মত জোসনা। এমন জোসনা দেখতে হিমুর মত বনে চলে যাওয়া, অথবা সাগর পাড়ে যাওয়া যায়।আকাশে থাকবে ভরা জোসনা, আর পাতালে সাগরের ঢেউ, সেই সাথে শীতল বাতাস। হাতের উপর প্রিয় হাত থাকলেও মন্দ হয় না। যার চোখ জনম জনম কাঁদিবার জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়।

আচ্ছা, সে মরলে কতজন কাঁদবে? কিভাবে কাঁদবে? আজ যদি তার শেষ রাত হয়? কতজন তাকে মনে রাখবে? কেউ তো কাউকে মনে রাখে না। এমনকি নামটাও ভুলে যায়। তার ইচ্ছা করে পৃথিবীর বুকে এমন কোন জায়গা খুঁজে বের করবে যেখানে তার পায়ের দাগ থাকবে। অনেক বছর পর একদল মানুষ সে পায়ের দাগ দেখে খুজে বের করার চেষ্টা করবে এ নির্জন জায়গায় কার পায়ের দাগ? অথবা সে অনেকগুলো কবিতা লিখবে রবীন্দ্রনাথের মত। শত বছর পর কিছু কবিতা প্রেমী সেসব পড়ে মুগ্ধ হবে।
এই মহামারীতে তার মাথায় মৃত্যুর চিন্তা ঢুকেছে। সেই সাথে সৃষ্টি হয়েছে হয়েছে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার তীব্র লোভ। হোটেল রুমে কোয়ারাইন্টানে একা থাকতে থাকতে তার মাথায় উদ্ভট চিন্তা খেলা করে।

আজ ৭ জুন। ডাক্তার শফিক ভর্তি আছে হসপিটালের বেডে। তার কোভিড পজিটিভ। হাই ফ্লো অক্সিজেন চলছে। তবু শ্বাস নিতে তার কষ্ট হয়। সেই বর্ণবিরোধী শ্লোগানের মত। “ইউ কান্ট ব্রেদ”। হাইপোক্সিয়ার জন্য তার মাথা ঘুরছে। একটু হ্যালোসিনেশনও হচ্ছে বোধহয়। সে দেখছে অনেকগুলো কালো মানুষ তার পাশে শ্লোগান দিচ্ছে। “উই কান্ট ব্রেদ, উই কান্ট ব্রেদ”। “কবি ” উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নিতাইচরণও তাদের সাথে আছে। এই নিতাই চরণই তো ডোমের ছেলে হয়েও কবি হয়েছে। আহা! কি ভাগ্য!
সে ছন্দ তুলেছে, “কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো কেনে”। কে যেন আবার বলছে,
“জলদি ইন্ট্রুবেশন করো, সাকার মিশেন, সিস্টার ক্যানুলা, অক্সিজেন বাড়াও, কুইক কুইক।”
এগুলোও কি আন্দোলনকারীদের শ্লোগান? সে পার্থক্য করতে পারছে না। পৃথিবীতে মানুষ বাঁচানোর আন্দোলন বুঝি এমনি হয়? তার চারপাশে কালো অন্ধকার হয়ে আসছে… কৃষ্ণাঙ্গদের গায়ের রংয়ের মত কালো।

Fahmida Hoque Miti

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

স্মৃতিতে অধ্যাপক ডা. এন আই খান: ডা. আবদুন নূর তুষার

Sat Jun 6 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ জুন ২০২০, শনিবার ডা. আবদুন নূর তুষার আমার শিক্ষক এন আই খান। নিঃসঙ্গ মৃত্যু বেছে নিয়েছেন ঢাকা মেডিকেলের কেবিনে গতকাল, পাশে ছিল তাঁরই কয়েকজন ছাত্র। শেষ মূহুর্তে তিনি নাকি খুঁজেছেন তাঁর সার্বক্ষনিক সাহায্যকারী শ্যামলকে। আর বলেছেন, তোরা আমাকে মাফ করে দিস। স্যার অসাধারন এক শিক্ষক ও চিকিৎসক […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo