প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২০ এপ্রিল, ২০২০, সোমবার:
ডা. মাহরুফ নজরুল
কুয়াশা মাখানো ভোরে হররোজ যখন পিটিতে যাই, ওপাশের পাহাড়ের মাথার উপর দিয়ে লালচে সূর্যটার আভা ঠিকরে বের হতে থাকে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন ভোরবেলায় সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা সীতাকুন্ডের পাহাড়গুলো গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ সে পাহাড় আর এ পাহাড়ের মাঝে প্রায় সাত হাজার কিলোমিটারের ব্যবধান।
ক্রান্তিকাল চলছে। করোনার ক্রান্তিকাল। দেশে যুদ্ধ, বিদেশে যুদ্ধ। যুদ্ধ নেই কোথায়? লক ডাউনের গ্যাড়াকলে পড়ে হাঁসফাঁস করছে সবাই। এতদিন বাইরে বাইরে ঘুরে শান্তির মাকে খুঁজে পায়নি কেউ, এখন নিজ বাড়িতেও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অস্থির সময়টা বহতা নদীর মত শুধু বয়েই চলেছে। সমাপ্তির মোহনা কোথায় কেউ জানে না।
ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন। গালি খাচ্ছেন। কদাচিৎ ধন্যবাদ পাচ্ছেন। আক্রান্ত হচ্ছেন। মারা যাচ্ছেন। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মত এই চাকা ঘুরছে। চাকুরির ভয়। মাস শেষে বেতনের দুশ্চিন্তা। স্ত্রীর অভিমান, সন্তানের কান্না, মা-বাবার আকুল প্রতীক্ষা- সবকিছু ছাপিয়ে দূর থেকে পরিবারকে একপলক দেখে ডিউটিতে যাচ্ছেন। এক দুই সপ্তাহ টানা ডিউটি করে এক দুই সপ্তাহ কোথাও একঘরে পড়ে থাকছেন। সংক্রমিত হবার ভয়, সংক্রমিত করার ভয়। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো না থাকলে কি যে হত! সন্তান এখন মায়ের আদর পায় ভিডিওকলে, মা-বাবা দোয়াও দেয় ভিডিওকলে। একটা সাদা এপ্রোন আর একটা সাদা স্ক্রিনেই এখন জীবন সীমাবদ্ধ। পিপিই বললেই পাবলিক ক্ষ্যাপা। তিতুমীর বাঁশেরকেল্লা দিয়ে যুদ্ধ করতে পারলে নালায়েকগুলো মশারির কাপড়ের উন্নতমানের মাস্ক, গাউন পরে করোনার বিরুদ্ধে লড়তে পারবে না! কসাই সব, জুম্মন কসাইয়ের চেয়েও নিকৃষ্ট কসাই!
সাধারণ মানুষ ঘরে বসে বসে হাত পা অবশ হয়ে গেলে বেরিয়ে পড়ছে- ফাঁকা রাস্তায়, খোলা বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে। রাস্তায় বেরোতে হচ্ছে নিম্নবিত্তদেরও- পেটের ক্ষুধায়। মৃত্যু আজ দারিদ্র্যের কাছে পরাজিত। ফকির মিসকিনগুলো রাস্তাতেই থাকে, রাস্তাতেই মরে। মরলে মরুক। রাস্তার কুকুর আর ফকির মিসকিন টোকাই- এরা তো সমগোত্রীয়ই। এদের মৃত্যুর অ্যাকাউন্টেবিলিটি রাখার জন্য কি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখা লাগবে? অ্যাকাউন্টেবিলিটি দরকার পুঁজিবাদদের, মজুতদারদের, চালচোরদের, মাস্ক কেলেংকারীর সাথে জড়িতদের।
বাতাসে আজ লাশের গন্ধ নেই ঠিক। কিন্তু, বাতাসে আজ মৃত্যুর বীজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাতাস আজ দূষিত। মসজিদ বন্ধ। মন্দির থমকে গেছে। প্রার্থনার সুর কেটে গেছে। পৃথিবীটা ধুকছে এক অদৃশ্য মহামারীতে।
কংগোর মাটিতে প্রতিদিন ভোরের ঐ পাহাড় বাওয়া, কুয়াশা ফুঁড়ে বের হয়ে আসা লালচে সূর্যটা আমাকে শক্তি দেয়। শক্তিকে কখনো ধ্বংস করা যায় না। একদিকে ভাঙ্গলে, আরেকদিকে তা নতুনরুপে সৃষ্টি হয়। এই ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় মানবজাতি কি এক শুদ্ধতর মানবজাতিতে রুপান্তরিত হতে পারবে? আমাদের ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, আমজনতা, আমাদের বিদ্যানন্দ, আমাদের নাম না জানা কত শত ভাই বোনগুলা যারা রাস্তায় রাস্তায়, ঘরে ঘরে, হাসপাতাল হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে খাবার দিচ্ছে, সাহায্য পৌছে দিচ্ছে তারা কি সন্তানদের এক অন্য যুদ্ধ জয়ের গল্প শোনাতে পারবে না? নতুন এক শুদ্ধ পৃথিবীতে তারা কি নির্মল বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারবে না?
পাহাড়ের গা বেয়ে, কুয়াশা কেটে সূর্যটা হাসতে হাসতে মাথার উপরে উঠে যাচ্ছে। নতুন বিশ্বাসে আজকের দিনটা তবে শুরু হোক!