প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ এপ্রিল ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. শুভ্র সৈকত
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
আমার ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে আমি সারাক্ষণ হাসতে থাকি। আমার ছেলের মধ্যেও এই দুর্বল দিকটি প্রবলভাবে উপস্থিত। সেও সারাদিন হাসতে থাকে। বাপ ৩২টা দাঁত বের করে হাসে, ছেলে হাসে ৮ দাঁত বের করে। আমি সাধারণত পরিচিত লোকদের দেখলে হাসি। আমার পুত্র পরিচিত অপরিচিত সবাইকে দেখলেই হাসে।
গত একমাসে হাসপাতাল যাওয়া ছাড়া বাসা থেকে বের হইনি। এই সময়ে ছেলে প্রায় সারাক্ষণ আমার সাথেই থাকে। আমার কোলে ছাড়া ঘুমায় না। গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে হাত বাড়িয়ে বাবাকে খোঁজে। হাতে নাগাল না পাওয়া পর্যন্ত কাঁদে, পেলে ঘুমিয়ে যায়।
অহর্নিশ বইকে বলে আম। বই খুলে আঙুল দিয়ে দিয়ে তাকে আম জাম কাঁঠাল পড়ানো হয় বলে তার ধারণা হয়েছে বইয়ের নাম হচ্ছে আম। মাঝে মাঝে দেখা যায় বাবাকে পড়ানোর জন্য প্রায় তার সমান ওজনের ডেভিডসন নামক আমটি টেনে হিচড়ে সে বাবার আশে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বাবার সাথে বাঃ (অর্থাৎ বল) খেলার জন্য মাঝে মাঝে সে ভোর ৫টা পর্যন্ত জেগে থাকে। রাতে না ঘুমাতে ঘুমাতে আমি বিরক্ত হওয়া শুরু করেছি, এমন সময় একদিন করোনার আশীর্বাদ নেমে এল।
এক সময় ওয়ার্ডের সাসপেক্টেড করোনা রোগীরা পজিটিভ হতে শুরু করল। হেলথ কেয়ার প্রফেশনালরা আক্রান্ত হতে থাকলেন। অগত্যা পিতাপুত্রের খেলা শেষ হলো। আমার কাছ থেকে যাতে আমার স্ত্রী পুত্র কোভিড আক্রান্ত না হয় সেজন্য তাদের দূরে পাঠিয়ে দিলাম।
এখন আর গভীর রাত পর্যন্ত আমার ছেলে আমাকে বিরক্ত করে না। তারপরও বেশিরভাগ রাত আমার নির্ঘুম কাটে। কেননা আমি জানি আমার পুত্র এখনো বাঃ হাতে এঘর ও ঘরে তার বাব্বাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হাত বাড়িয়ে বাব্বাকে পাচ্ছে না বলে তারও ঘুম আসছে না।
ছেলের সাথে এখন ভিডিও কলে কথা বলি। কঠিন অভিমানে আমার পুত্র আমার দিকে পারতপক্ষে তাকায় না। আমি হাসি হাসি মুখ করে ডাকলে সে তাকায় কিন্তু হাসে না। মহামারীর অবসরে আমার শিশুপুত্র হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছে।
একদিন অবশ্যই প্রকৃতি শান্ত হবে। আবার ঢাকা শহরের জ্যামে ঘর্মাক্ত বিরক্ত মানুষ একটা শান্ত ছুটির দিনের প্রতীক্ষা করবে। নির্জন শুভ্র সৈকতে ভেসে আসা ডলফিন, সভ্যতার অত্যাচারে আবার সমুদ্রে ফিরে যাবে। এ সবই আমরা জানি। শুধু জানিনা একজন চিকিৎসক পিতার সাথে তার হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়া পুত্রের আর দেখা হবে কি না।