করোনার দিনগুলি- ৪

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৩ এপ্রিল ২০২০, শুক্রবার:

একটু আগে যখন হসপিটালে ঢুকছিলাম, দেখি এক আনসার সদস্য ফোনে কথা বলছেন। হাঁটতে হাঁটতে কানে এলো, “যারা মারা গেছে সবাই কিন্তু বয়স্ক লোক, কোনো জোয়ান লোক মরতে দেখেছো?” বোঝা যাচ্ছে তিনি তার আপনজন কাউকে বোঝাচ্ছেন। হয় তিনি নির্জলা মিথ্যে বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন নতুবা তিনি এ বিষয়ক তথ্য সম্পর্কে ভীষণ অজ্ঞ।

আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। ২১-৩০ বছর যাদের বয়স, অর্থাৎ সবচেয়ে জোয়ান যারা, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর যারা, তারাই আক্রান্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি৷ প্রতি ১০০ জনে ২৪ জন তারাই। এরপর ৩১-৪০ বছর বয়সী আক্রান্ত হয়েছেন। ১০০ জনে ২২ জন৷ দেখা যাচ্ছে যুবকদেরই আক্রান্ত হবার হার সবচেয়ে বেশি। অনেক ইয়াং মানুষ মারা যাচ্ছেন৷

ওয়ার্ডের বাইরে থাকা গার্ডে থাকা আনসার সাহেবের বয়স কতো? ২৮/৩০? উনার মতোন করে মিথ্যে সান্ত্বনা পরিবারকে দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিটি যোদ্ধা। “না, না, খাওয়ার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না”, ” আরে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা যেরকমভাবে এতো এতো সুরক্ষা সামগ্রী পরে রোগী দেখি, আল্লাহ ভরসা”, “কী যে বলেন সবাই তো ডিউটি করছে আমি কীভাবে এই অবস্থায় বাসায় চলে আসি হাহাহা…” এই শেষের হাসিটার মাঝে কান্না লুকিয়ে থাকে। গলা ধরে আসা লুকোনো থাকে৷ অজান্তে চোখের কোণ বেয়ে অবাধ্য জল নামতে থাকে৷ অপর প্রান্ত কি বুঝতে পারে? না কি তারাও অভিনয় শিখে গেছে বাধ্য হয়ে? এই কথাগুলো প্রতিটি যোদ্ধার কমন কথা। তারা যখন দূর পরবাসে ফোনে কথা বলেন, কখনও শোনার সুযোগ হলে মিলিয়ে নিয়েন।

চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সেনাবাহিনী, আনসার, স্বেচ্ছাসেবক, আরও যারা যুদ্ধ করে যাচ্ছেন প্রতিটি পরিবারে একই দীর্ঘশ্বাস। গতকাল পর্যন্ত পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন ২১৭ জন।

এতোটুকু যখন লিখেছি, একজন বৃদ্ধা রুমে প্রবেশ করলেন৷ “স্যার, আমার রোগীটা একটু দেখবেন কেমন জানি করছে?” “কী হয় মা, আপনার?” “আমার স্বামী।” এই ডাক উপেক্ষা করার শক্তি নেই আমার। দেখে এলাম। সান্ত্বনা দিলাম৷ ওষুধ দিলাম।

আমরা চিকিৎসকরা ইতোমধ্যে একজন অগ্রণী যোদ্ধাকে হারিয়েছি। ২৫০+ সহযোদ্ধা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমার কর্মস্থলে দুটো ওয়ার্ড লকডাউন করতে হয়েছে। একদিনে ১১ জন কলিগ আক্রান্ত হয়েছে। এক কলিগকে বাসা থেকে বের করে দেবে বলেছে বাড়িওয়ালা। আরেক আক্রান্ত কলিগকে নানাভাবে হেয়-অপমান করছে বাসার সামনে এসে এলাকাবাসী। কিছুক্ষণ আগে খবর পেলাম এক আক্রান্ত সহকর্মীর মারাত্নক শ্বাসকষ্ট হচ্ছে৷

একের পর এক দুঃসংবাদ আমাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেয়৷ হঠাৎ করে খুব মন দুর্বল করে দেয়৷ পরক্ষণেই আবার যোদ্ধারা যার যতোটুকু আছে তাই নিয়ে নিজ নিজ যুদ্ধ সেক্টরে যুদ্ধ করতে চলে যায়। ভাঙে, তবে মচকায় না৷ বুকে এই সাহস, এই মানুষের জন্যে জীবনঝুঁকি নিয়ে ছুটে চলা, এই বুকে পাথর চেপে হাসিমুখে ঘোরার ক্ষমতা সরাসরি আল্লাহপ্রদত্ত। আর কিছুই না৷ তিনি নিজ অনুগ্রহে বেছে নিয়েছেন কাদের দিয়ে তিনি তার বান্দাদের উপকার করাবেন এই ঘোরলাগা অবাক কঠিন মুহূর্তে।

বরাবরের মতোই বলি, আপনাদের নিশ্চিন্তে ঘুম নিশ্চিত করতে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি। দু’আ চাই সবার।

লেখক:
ডা. মারুফ রায়হান খান
কার্ডিওলজি বিভাগ
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

Abdullah Al Maruf

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনাকালে রমজানে করণীয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ

Fri Apr 24 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ এপ্রিল, ২০২০, শুক্রবার: আগামী ২৫ এপ্রিল শুরু হতে যাচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান, ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। অন্য বছরের মত এবারও মুসলিমরা রোজা রাখবেন, তবে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাড়তি কিছু সতর্কতা এবং নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo