২৯ জুন ২০২০, সোমবার
ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এফসিপিএস (সার্জারি)
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
আজ বাইরে থেকে এসেই জুতোয় স্প্রে করালাম। হাত হেক্সিসল দিয়ে ধুয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে রাখলাম। গগলস, মাস্ক খুলে হাত ধুয়ে নিলাম সাবান দিয়ে। তারপর মোজাও খুলে ফেললাম। মুখমণ্ডলে সাবান মেখে ৩০ সেকেন্ড পরে ধুয়ে ফেললাম। অতঃপর গোসল সারলাম। শার্ট-প্যান্ট দিনেরটা দিনই পরিষ্কার করে ফেলি। যদিও জানা নেই এখানে আসলেই কোন জীবাণু আছে কিনা! জীবাণুর ভয়ে দিশেহারা সকল সিস্টেম।
ঘরে ঢুকে খাবার চাইলাম। খাবার আগে আবারও হাত ভালো করে ৩০ সেকেন্ড সময় নিয়ে ধুয়ে নিলাম। কেননা এরই মধ্যে টাকাগুলো ড্রয়ারে রেখেছি। মাস্কগুলো প্যাকেটে ভরেছি। বলা তো যায় না, কোনদিক থেকে জীবাণুরা আক্রমন করে বসে!
প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, এই বুঝি হাতে জীবাণু লেগে গেলো! এই বুঝি নাকে হাত লাগলো। আমার সবকিছুকেই আমার অবিশ্বাস করতে হচ্ছে। চোখ কচলাতে গেলেই মনে হয় হাতটা জীবাণুমুক্ত তো!
নাক চুলকালে হাত ধুয়ে চুলকাতে হবে। চোখ চুলকালেও একই ব্যবস্থা। শরীরের এই অদ্ভুত নিয়ম। আপনার শরীরের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময় চুলকাবে, হাত না দেওয়া পর্যন্ত নিস্তার নাই। হাতের পরশ যেন সব যাতনা ঠিক করে দিবে। কি পরিহাস এখন সবচেয়ে অবিশ্বস্ত অঙ্গ হল হাত। অথচ এটি ছাড়া আমরা অচল। কোন অঙ্গকেই বিশ্বাস করা যায় না। কোনটা যে কোনদিকে ক্ষতি করে ফেলে!
আমরা যতই সাবধানতা অবলম্বন করিনা কেন, আমাদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ আমরা ফ্রন্টলাইন ফাইটার। করোনার জীবাণু শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথেও ঢুকে যেতে পারে। আমি শ্বাস নিলাম আর দূর্বল মাস্কের ভিতর দিয়েই জীবাণু ঢুকে গেলো। এতদিন যে KN95 মাস্ক আমরা পড়ছি, এটি নাকি শুধুই ধুলাবালি থেকে রক্ষা করে, আমাদেরকে জীবাণু থেকে নয়। এগুলোও আমরা এতোদিন সরকারীভাবে পাইনি। এগুলো নিজে কিনেছি। চাইনিজ ডাক্তারগন নিজেরা N95 অথবা 3M মাস্ক পড়ছে। ওদের ভাষ্যমতেই KN95 ফলস জীবাণুরক্ষাকারী। এটি কোভিড-১৯ প্রোটেক্টর নয়। অথচ আমাদের ফেসবুক পেইজগুলো এর বিজ্ঞাপনে সয়লাব। এগুলো নাকি 3M সমমানের মাস্ক। হায়রে মিথ্যার দেশ! তাই বলে এতো ভয়ংকর ব্যবসা! আমার ক্ষমতা থাকলে এই ব্যবসায়ীগুলোরে ধরে ধরে বিশ বছর জেলে রাখতাম। ওরা জীবন নিয়ে খেলেছে আমাদের। মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাদেরকে যুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছে অস্ত্রবিহীন। কি পরিহাস! একটি শেয়ার কিংবা কমেন্টের জন্য জেল জরিমানা হয়, কিন্তু জীবন হত্যাকারী ব্যবসায়ীদের কিছুই হয় না।
এই ক্ষুদ্র অনুজীবগুলো আমাদের কতকিছু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো! আমরা যে আসলে সিঙ্গাপুর নই, ইউরোপ নই। আমরা বাঙালিই শুধু। আমরা মৃত্যুকে সামনে রেখেও মানুষ ঠকানোর কাজে ব্যস্ত। অথচ আমরা জানি না, কাল বেঁচে থাকবো কিনা! এই টাকা পয়সা ভোগ করতে পারবো কিনা! অথচ ডাক্তারদের অনেকেই ফ্রি সার্ভিস দিচ্ছে অনলাইনে। আমি শত শত মানুষকে মোবাইল ফোনে ফ্রি চিকিৎসা সার্ভিস দিচ্ছি। শত শত করোনা আক্রান্ত রোগীকে মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে চিকিৎসা দিচ্ছি। আমার উপজেলার বাইরে থেকেও আমাকে ফোন দেয়। আমি কথা বলে মেসেজে চিকিৎসা লিখে পাঠিয়ে দেই।
আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুবই নাজুক। আমাদের ডাক্তারগণ দলবাজিতে ব্যস্ত। এই দলা-দলির কারণ হলো চুরিচামারির ভাগ পাওয়া। কোন মহৎ উদ্দ্যেশ্য নেই দলবাজির। আর যারা তাদেরকে দলবাজির জন্য ডাকছে, তারাও এজন্যই ডাকে যে এতে করে তাদের চুরির সুযোগ হয়। ডাক্তারদের বিরাট অংশই এই অপরাজনীতির বাইরে, তবে তারা সবসময় পিষ্ট হয় রাজনীতির চাকায়। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, সেদিকেই কাত হয়ে তাদের পদ রক্ষা করে। অথচ এখানে দরকার ছিলো অত্যন্ত প্রফেশনাল লোকজন, যারা পেশাটাকে ভালোবাসবে, সার্ভিসটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। রাজনীতিবিদদের প্রয়োজন জ্ঞানভিক্তিক পেশাদার লোকদের চর্চা করানো। দলীয় লোক দিয়ে পেশাদার চর্চা করা যায় না। কারণ মেডিকেল হলো গভীর মনোযোগের জায়গা। এখানে রাজনৈতিক চর্চা করতে গেলে মনোযোগ নষ্ট হয়। আর মনোযোগ নষ্ট হলে পেশার দক্ষতার কার্ভ নিচের দিকে নামতে থাকবে।
একটি গল্প মনে পড়লো। আমার মেডিকেল কলেজের এক প্রিয় জুনিয়র একবার মেরুদন্ডের নিচের অংশের ব্যথায় অস্থির। কোন ঔষধে তাকে ধরে না। ব্যথায় কান্নাকাটি করে। একমাত্র সন্তানের কান্না দেখে তার মা চোখের জল ফেলে। বাবা বিদেশ থেকে ফোনের পর ফোন দেয়। আমরাও গিয়ে দেখে আসি আর দুঃখ প্রকাশ করি। তার এক্সরে ভালো, এমআরআই করানো হয়। রিপোর্টে সমস্যা আছে। ব্যথা কোন ঔষধেই কমছে না। অতঃপর গন্তব্য বেঙ্গালোর এপোলো হাসপাতাল। ইন্ডিয়ার বিখ্যাত নিউরোসার্জন দেখাবে ওখানে। বাংলাদেশের নিউরোসার্জন ব্যথা কমাতে পারছে না।
কখনো কখনো সিনেমাটিক ব্যাপার আসলেই ঘটে। আমাদের মেডিকেল স্টুডেন্টের সাথে বিমানের পাশের সিটে বসেছেন এক মধ্যবয়ষ্ক ভদ্রলোক। তিনি এই ছোট্ট ছেলেটির সাথে গল্প জুড়ে দিলেন। তার অসুস্থতার খবর জেনে দুঃখ প্রকাশ করলেন। কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইলেন। তিনি খুব অবাক হলেন যখন শুনলেন একজন নিউরোসার্জনের কাছে বেঙ্গালোর এপোলো হাসপাতালে যাচ্ছে সে। নিজের পরিচয় দিলেন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরছেন। তিনিই কাঙ্খিত নিউরোসার্জন। তিনি অবাক হলেন এই জন্য যে বাংলাদেশে এতো বড় নিউরোসার্জন থাকতে তার কাছে কেনো পাঠাতে হলো!
তিনি কাগজপত্র দেখতে চাইলেন। ছাত্রটি রিপোর্ট দেখালো। তিনি রিপোর্ট দেখলেন না। ফিল্ম চাইলেন। ছাত্রটি ফিল্ম দেখালো। তিনি ফিল্ম দেখলেন। খুটিয়ে খুটিয়ে সব কিছু দেখলেন। অতঃপর বললেন তোমার কোন সমস্যা নাই। তুমি ফিরতি ফ্লাইটে চলে যাও।
হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই আর। ব্যথা লাগলে প্যারাসিটামল খাবে। রিপোর্টেরই একটি কাগজে কিছু ঔষধ লিখে দিলেন। সমস্যাটা সাইকোজেনিক ছিলো মনে হয়।
ঢাকার নিউরোসার্জনকে তিনি চিনেন। একসাথে এফআরসিএস করেছেন। তিনি এও বললেন যে,
“আমি কখনোই তার সাথে পারতাম না, ইংল্যান্ডের হাসপাতালে সে সবসময় আমার চেয়ে ভালো করতো। সে জিনিয়াস। বাংলাদেশে আসলে সবাই কেন বদলে যায় বুঝলাম না।”
জী জনাব, আমরা জানি কেন বদলে যাই। এই মাটিতে মেরিট ধরে না, শুধু জন্মায়।
ডাক্তারদের সামনে এতো ক্ষমতার হম্বিতম্বি চললে মাথার বিদ্যা তখন হাতে চলে আসে। তখন হয় আমরা তৈল মর্দন করি, নয়তো হাত শক্তিশালী করতে রাজনীতি করি। দুটোর কোনটাই পেশার দক্ষতার কাজে লাগে না। ওটা দিয়ে কেউ কেউ এমপি হয় সত্যি, তবে তারা তখন আর ডাক্তার থাকেন না। তারা ডাক্তারি সিস্টেম থেকে নিচে নেমে যান। আর দশজন যেমন ডাক্তারদের বকাঝকা করেন তিনিও তেমনি করেন। কারণ সিস্টেমের মধ্যে কাজ না করতে পারলে তাদের দুর্নাম করুন। তবেই না পাবলিক খাবে। পাবলিক ভাববে কেষ্ট বেটাই চোর। আর ঐদিকে চুরির জন্য কেষ্ট বেটার হাতে যে কিছুই অবশিষ্ট নেই তাতো কেষ্ট বলতে পারবে না। কারণ সে হয় সরকারী চাকুরী করে, নয়তো জমজমাট প্রাইভেট প্রাকটিস করে। আপনারা দুজায়গাতেই আঘাত হানতে পারেন। এই ক্ষমতার অপব্যবহার শুধু মেধাবীদের নয়, সবাইকেই মারছে।