করোনার দিনগুলোয় – ১০ || করোনা, আমেরিকা ও আমরা

২০ জুন ২০২০, শনিবার

 

ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এফসিপিএস (সার্জারি)
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

 

আমরিকার সিটিজেন আমার বন্ধু দেলোয়ার সেদিন ফোন করলো। জানতে চাইলো আমাদের কেমন চলছে। তার খোঁজ খবর নিলাম। সে নিউইয়র্কে থাকছে। সবচেয়ে করোনা রোগীর এরিয়া সেটি। এখন অবশ্য ইম্প্রুভ হয়ে গেছে। আমাদের খোঁজ খবর নিতেই তার ফোন। বাল্যবন্ধু বলে কথা। এই বিপদের দিনে খোজঁখবর না নিয়ে থাকতে পারেনি।

আমেরিকানরা কি করেছে সে আমাকে বর্ণনা দিলো। আসলে বর্ণনা করেছে, সে যা করেছে। জনগন কি করেছে এই বিপদের দিনে। সরকারের আসলে তেমন কিছুই করা লাগেনি, যা করার জনগনই করেছে। সরকার শুধু লকডাউন এর ব্যবস্থা করেছে।

আমেরিকার জনগন সব রাস্তায় নেমে গিয়েছিলো সে সময়টায়। কোন আন্দোলনের জন্য নয় জনাব, সহযোগিতা করার জন্য। যে আমেরিকানরা পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে জানে না বছরের পর বছর, সে তারাই যা করেছে তা আমরা চিন্তাই করতে পারছি না!

১) প্রতি ঘরের কথা জেনেছে ওরা। মহল্লার সকল ঘরের খবর তারা রেখেছে। কার ঘরে রোগী আছে জেনে নিয়ে খাবার, ঔষধ পৌঁছে দিয়েছে। যার ঘরে খাবার নাই তাকে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। এর জন্য তারা মেম্বার, চেয়ারম্যান কিংবা কোন দান-খয়রাতকারীর দিকে তাকিয়ে থাকেনি। নিজেরাই দিয়েছে।

এইসব খাবার পৌঁছে দিয়ে গর্ববোধ করেছেন তারা, তাই কোন ফটোসেশন হয়নি, ফেসবুক, টুইটারে ভরে যায়নি।

২) যেসব ঘরে ডাক্তার আছে তাদেরকে খুঁজে বের করেছে কমিউনিটি। ডাক্তারের ছোট বাচ্চাকে তারা নিজের ঘরে নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে ডাক্তারকে ডিউটি করতে পাঠিয়েছে।

৩) স্বাস্থ্য কর্মীদেরকে সকল ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে দিয়েছে। লাইনে দাঁড়ালে তাকে লাইন ব্রেক করে সামনে ঠেলে দিয়েছে। এম্বুলেন্স ড্রাইভারকেও ওরা পিছন থেকে সামনে ঠেলে দিয়েছে লাইন ভেঙ্গে, যাতে করে তাড়াতাড়ি চলে গিয়ে জনগনের উপর খুশি থাকে।

৪) সর্বস্তরে নিয়ম মেনে চলেছে। মুখে মাস্ক ছাড়া কেউ বাইরে বের হয়নি কখনোই।

বিপরীতে আমরা কি করেছি দেখে নেই একটু…

১) কারো ঘরে রোগী থাকলে তাকে এলাকা থেকে বহিষ্কার করার জন্য জোর তদবির করেছি। আমি নিজেই তার স্বাক্ষী। আমাকে ফোন করেছেন সবচেয়ে বেশী।

২) খাবারের জন্য মেম্বার/চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করতে বলেছি। অনেক ক্ষেত্রেই আমিই যোগাযোগ করে দিয়েছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অনুরোধ করেছি ব্যবস্থা নিতে। আপনারা হা করে থেকেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরাও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সহযোগিতা করেছি।

৩) কারো কারো ঘরে আমরা খোঁজ নিয়েছি তবে সেটি রোগী হলে বের করে দেওয়ার জন্য। আর তার জন্য মিথ্যা কথাও বলেছি, যাতে করে রোগীটাকে বহিঃষ্কার করা যায়। যেমনঃ সে ঘরে না থেকে বাইরে হাটাহাটি করে এসব কুটনামি করেছেন।

৪) যেসব বাড়িতে ডাক্তার আছে, তাদেরকে বিতারিত করার চেষ্টা করেছি, সহযোগিতা করা তো দূরের কথা। করোনা হাসপাতালে ডিউটি করার অপরাধে বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে অনেক জায়গায়।

৪) করোনা পজিটিভ হওয়ায় বাসা তো দূরের কথা এলাকাতেই ঢুকতে দেইনি আমরা সবাই মিলে। শেষে প্রশাসনের সহযোগিতায় ডাক্তার তার বাসায় যেতে সক্ষম হয়। এক জায়গায়তো ১৭ সদস্যের বাসায় ঢিল ছুঁড়ছিলেন, যেন এলাকা ছেড়ে দেয় তারা। সেই ডাক্তার আপনাদেরকেই সেবা দিচ্ছিলেন এবং আপনাদের থেকেই আক্রান্ত হয়েছিলো। সে শপিং কিংবা মাস্তি করার জন্য কোথাও বেড়াতে যায়নি।

৫) এম্বুলেন্স হেলিকপ্টারে ডাক্তারকে উঠতে দেইনি আমরা সবাই মিলে। কারন আমাদের ধারনা সে যদি এই এলাকার উপর দিয়ে এম্বুলেন্সে যায়, তবে এই এলাকায় করোনা ছড়াবে। সে ডাক্তার পরে মারা যায়। আর ঐ মহল্লা কিন্তু এখন করোনা আক্রান্ত। ওটা ঠেকানো যায়নি, তবে ডাক্তারটাকে মারতে  পেরেছেন আপনারা।

৬) আর দান খয়রাত? আহা কি বলবো!

বিশ হাজার টাকার খাদ্য সহায়তা দিয়ে ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে প্রচারনা। ফেসবুকে ফটো, ভিডিও, ব্যানারে সয়লাব। আপনাদের ফাঁকে ফাঁকে আমরা গোপনে সহযোগিতা করেছি যেখানে কোন কাকপক্ষীও টের পায়নি।

আগে নিজে কি করছেন তার হিসেব করুন। যে যেমন কর্ম করবেন, তেমনি প্রতিফল পাবেন।

আমেরিকানরা কি করছে, তার ফল তারা চিকিৎসা ক্ষেত্রে পাচ্ছে। আপনারা যা করছেন, তার ফল আপনারা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে পাবেন।

নিজে কাজ করবেন ডাকাতের মতো আর প্রতিদান চাইবেন পীরদের মতো, তাতো হয় না।

এটি একটি যুদ্ধ। এখানে যার যা আছে সব নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আসুন আমার আপনার সব নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ি। তবে হয়তো মানুষের মৃত্যু কমিয়ে রাখতে পারবো।

এখনো সময় আছে কিছু করার। বড় পরিসরে পারবো না ঠিক, তবে ছোট্ট পরিসরে আমাদের মানুষগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা  করতে পারি।

 

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হয়ে সৌদি আরবে পঞ্চম প্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসকের মৃত্যু

Sat Jun 20 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, শনিবার, ২০ জুন, ২০২০ করোনা মহামারীতে শহীদ হলেন আরেকজন প্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসক। এবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন ডা. মোহাম্মদ শফিউল্লাহ (রনক)। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) তিনি সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে রিয়াদে অবস্থিত কিং ফাহাদ হাসপাতালে সিনিয়র মেডিসিন কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি প্রথমে সৌদি আরবের স্বাস্থ্য […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo