করোনার দিনগুলোয় ১৫ || যুব ভয়ংকর যুবা ভয়ংকর

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, সোমবার

ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এফসিপিএস (সার্জারি)
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

যুব ভয়ংকর যুবা ভয়ংকর
শিশুরা যে আরো ভয়ংকর

রাস্তায় বের হলেই মানুষজন চোখে পড়ে। সর্বত্র মাস্কবিহীন। কারো কোন বিকার নেই। এ চিত্র সারাদেশে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ঢাকা, কক্সবাজার সর্বত্র একই চিত্র। কেউ মাস্ক পরছে না। আমরা যারা মাস্ক পরছি, তারা যেন অন্যগ্রহের জীব।

যুবক যুবতীরা কোন মাস্ক পরবে না, কেননা তারা  মারা যায় না। ত্রিশের নীচে মারা যাওয়া খুবই বিরল ঘটনা। এই আনন্দে তারা মাস্ক ছেড়ে দিয়েছে। যুবতীরা এক কাঠি সরেস। তারা এমনকি আমার চেম্বারে ও নেকাব পরে ঢুকে পরে। জিজ্ঞেস করলেই বলে এটাই মাস্ক। আর আমি বলি এটি তো আপনার শ্বশুর ভাসুরের সামনে পরার জন্য। আমার সামনে মাস্কই পরবেন, যান মাস্ক পরে আসেন। বড্ড কষ্টে তারা দশ টাকার মাস্ক কিনে পরে। আহারে টাকার জন্য কত দরদ! দশটা টাকা যেন জলে ঢাললেন!

এই যুবতীদের সাথে আসে শিশুরা। কারো কোন মাস্ক নেই। যুবতীরা মনে করে শিশুদের তো সাজা দিতে পারবে না, তাই ওদের না পরালেও চলবে।অথচ দুই বছরের উপরে সবাইকে মাস্ক পরতে বলা হয়েছে।

এই যুবক- যুবতী, বালিকাবধু, শিশু সবাই করোনা আক্রান্ত হয়। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকায় কেউ মারাত্মক অসুস্থ হচ্ছে না বা মারা যাচ্ছে না, কিন্তু ঘরের বয়স্ক বাবা, চাচা, দাদা, দাদী ঠিকই মরে যাচ্ছেন। আর তখন তারা বলেন “আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে গেছে”। আর আমাদের ফেরেশতারা করোনা বিতরন করবেন শুধু।

এই অজ্ঞতা যে কত ভয়ংকর তা কিভাবে বুঝাই!

অনেকের করোনাকালীন সমস্যা বেশী না হলেও হুটহাট হার্ট অ্যাটাক এ্যাটাকে মারা যাচ্ছেন, কিছুদিন পরেই যাকে আমরা বলছি পোস্ট কোভিড সিন্ড্রোম। এভাবে অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বিশেষত যাদের ব্লাডপ্রেসার বেশী ছিলো, ডায়বেটিস ছিলো অথবা অন্য কোন জটিল রোগ ছিলো। করোনা থেকে মুক্তি পেলেও এর পরবর্তী ইফেক্ট থেকে মারা যাচ্ছে অনেকে যাকে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক অথবা স্ট্রোকে স্বাভাবিক মৃত্যু। করোনার ছোবলে না পড়লে তারা হয়তোবা এভাবে মারা যেতেন না। তাছাড়া কোভিড আক্রান্ত হলে সম্পূর্ণ সুস্থ হলেও অনেকদিন বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা থেকেই যায়। ঘুম না হওয়া, ক্ষুধামন্দা, মারাত্মক শারীরিক দূর্বলতা, চুল পড়া খুবই সাধারণ সমস্যা।

শীতকাল শুরু হতেই করোনা মারাত্নক আকার ধারন করেছে। আগে বয়স্করা মারা যেতো শুধু, এখন মারা যাচ্ছে যুবক যুবতীরাও। মেডিকেল ছাত্র, সদ্য পাশ করা ডাক্তার মারা গেছেন গত কিছুদিনের ভিতরে।

আমি নিজে বেশ কজনকে ঢাকায় রেফার করেছি।তাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম ছিলো।

সেদিন তো এক ডায়াবেটিক রোগী এবং তার ছেলেকে দেখলাম আমার চেম্বারে। সেই মা করোনা পজিটিভ। বারডেম থেকে কনফার্ম করা। ছেলের পরীক্ষা করলেও পজিটিভ পাবার কথা। ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়েছে কোভিড ডেডিকেটেড কেন্দ্র হিসেবে।

তারা যাননি। তারা গ্রামে এসেছেন। আমার উপর নাকি প্রচন্ড কনফিডেন্স! তাই দেখাতে এসেছেন সাথে এটিও স্বীকার করছেন বারডেমে কি হয়েছিলো। ডায়াবেটিক ফুট। ঘা এর অবস্থা খুব একটা খারাপ না। এখন ঘরে বা হাসপাতালে না থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন।

তারা অবশ্য হাফমাস্ক পরেছেন। মা-ছেলে দুজনেরই পুরনো মাস্ক, ধৌত করা মনে হলো। দুজনরেই নাক খোলা। এই ধৌত করা হাফমাস্ক পরে কতজনকে করোনা বিলিয়েছেন আল্লাহ জানেন। আমাকেও দিলেন কিনা জানিনা। আমি অবশ্য তাদের দু’জনকেই মাস্ক পরতে বাধ্য করেছি। আমি নিজে মাস্ক পরি এবং মাস্ক পরিহিত ছাড়া রোগী দেখিনা।

তারা চেয়েছিলেন অপারেশন করাতে। আমি আরো পরে করতে বলেছি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে। তারা মনে হয় রুস্ট হয়েছেন। তাদের মেডিকেল চিকিৎসা অবশ্য দেয়া হয়েছে।

ডাক্তার কেন অপারেশন করবে না!এরকম একটা ভাবনা থাকতে পারে তাদের মনে। তাদের ধারনা যুদ্ধ মনে হয় সৈনিকরা করে আর সারা জাতি বসে পান চিবায়। তারা কি করছেন এটি তো বলাই যাবে না।

তারা আমাদের কাছে আসবেন আর আমরা তাদের জড়িয়ে ধরে দেশপ্রেমের পরিচয় দিবো। কোভিড পজিটিভ হলে তো কোন কথাই নেই! তাদেরকে জড়িয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে কিংবা কোভিড আক্রান্ত হতে প্রস্তুত থাকতে হবে। তবেই না মিডিয়া এবং বড় কর্তারা বলবেন “সাব্বাস! বাঘের বাচ্চা একখান!”

আমার অবস্থা তখন,

“আমি যেন খড়গ শানের পাথর

ঘষে ঘষে ক্ষয়ে যাবো

মুখটি তবু খোলবো না”

আসলেই বলতে পারি না কিছু। পাছে লোকে কিছু বলে!

ডাক্তার ছাড়া অন্য যারা নিজেদের কোভিড হিরো দাবী করেন, কিংবা করান তাদেরকে কোভিড ডিউটি দিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে কয়টা প্যান্ট ভিজায়!

যুদ্ধ মানে এই নয় যে খালি হাতে শত্রুর সামনে বুক খোলে বলা “শয়তান যদি সাহস থাকে তো গুলি কর!” বুদ্ধিমত্তার সাথে উপযুক্ত অস্ত্র নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করাই যুদ্ধ।

এখনকার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো মাস্ক। দশ টাকার সার্জিকেল মাস্কই অনেক জীবন বাঁচাতে পারে।

আপনারা মাস্ক পরবেন না কোভিড পজিটিভ জানার পরেও আর আমরা……. নাই বা বললাম।

আরেক গ্রুপ বেশ মজার। তারা মাস্ক পরবেন না কারন তারা মুমিন মুসলমান। এটি তাদের চোখে বিধর্মীদের অসুখ। এই মুমিন মুসলমানরা মসজিদমুখো হয় না কিংবা নামাজ পড়ে না কখনো।তাও মুসলমান হিসেবে তারা করোনামুক্ত থাকবে মনে করে।

অবশ্য কারো একবার করোনা হয়ে গেলে সেরে গেলেও মাস্ক আর খোলেন না।

একটি মাস্ক আপনার আমার রক্ষা দিতে পারে। আর এটি না পরলে আপনারা আমাদেরকে সহ জীবন মরনের লটারীতে ফেলে দিলেন।

আল্লাহ জানে কিভাবে পাড়ি দিবো এই অজ্ঞতা আর অসময়কে।

 

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯ টেস্টে "NILMRC" এর নতুন মাইলফলক স্পর্শ

Mon Dec 14 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, সোমবার করোনা সংক্রমণ শনাক্তকরণে আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় ২৪ ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৪১৭৭ টি নমুনা পরীক্ষার এক নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে NILMRC( ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টার)। এর আগে ২৪ ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৩৪৪৬ টি নমুনা পরীক্ষার রেকর্ড এই প্রতিষ্ঠানেরই ছিল। গত ৩১ মার্চ, ২০২০ থেকে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo