বৃহস্পতিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২০
কিছুদিন আগে উপজেলার করোনা গ্রুপে একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম- আপনার প্রতিবেশী করোনা আক্রান্ত হলে কি করবেন?” আপনাদের উত্তর ছিলো না বললেই চলে। যারা উত্তর দিয়েছিলেন তাদের বেশীরভাগই ডাক্তার এবং তাদের কাছে এর উত্তর চাইনি আসলে। চেয়েছিলাম আপনাদের কাছেই। আপনারা যারা উত্তর দিয়েছিলেন তাদের বেশীর ভাগেরই ছিলো গৎবাধা যেমন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে জানাবেন। আমি প্রশ্নটি রেখেছিলাম ভেবে চিন্তেই। কারণ আপনাদের উত্তর দেখেই আমি স্ট্রাটেজি ঠিক করবো। আমি আগে থেকেই ঠিক করতে চেয়েছিলাম কি করতে হবে যখন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী পাবো।
গত কয়েকদিন ধরে ব্যস্ত আছি করোনা রোগী নিয়ে। করোনা রোগীরা ভালোই আছে। ভালো নেই আপনারা যারা করোনা আক্রান্ত নন। আপনাদের ফোনের জ্বালায় আমরা অস্থির। আপনারা চান যে কোন করোনা রোগী হলে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিই। তার পরিবারের সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে আসি কলেেজে কিংবা কোন প্রতিষ্ঠানে।
আমরা যেদিন প্রথম কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী পেলাম সেদিনটা ছিলো দেখার মতো। আপনাদের প্রতিবেশী ঐ রোগীকে কখন ওখান থেকে নিয়ে আসবো সেই চিন্তায় আপনারা অস্থির। শতশত ফোন দিয়ে আমাকে পাগল করে তুললেন আপনারা। সম্ভবত আপনারা ধর্ষক কিংবা মানুষ হত্যাকারীর জন্য ও এই পরিমান বিচলিত নন যেটুকু ছিলেন আপনাদেরই প্রতিবেশী চাচা কিংবা দাদাকে নিয়ে। আপনারা তারই পিছনে নামাজ পরেছেন, তারসাথে এতোদিন খেয়েছেন, ঘুমিয়েছেন, গল্প করে কাটিয়েছেন কত সকাল সন্ধ্যা! এমনকি তার পরিবারকে রাখতে ও আপনাদের প্রবল আপত্তি। শেষমেশ রোগীর ঠাই হলো আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হয়ে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল,ঢাকায়। আপনারা সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।
পরবর্তী রোগী হয়ে গেছে বেশ কয়েকজন।একটি অল্পবয়সী মেয়েকে রাখলাম তার পরিবারের সাথেই আইসোলেশনে আলাদা একটি রুমে। তার সব কিছুই আলাদা। সে একটি লক্ষ্ণী মেয়ে। আমি যখন দেখতে যাই সে তখন কোরান শরীফ পড়ছিলো। তার কোন শারীরিক সমস্যা নাই। আমি দেখতে যাওয়ায় খুব খুশী হলো। আমি অভয় দিলাম। বললাম,
“তোমার ভয় নেই ছোট বোনটি। এটি তোমার কোন সমস্যা করতে পারবে না। যেমনটি পারে নি তোমার ভাইটিকে যে নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছে। তোমার বাবা ভালো আছে। তোমার কোন শারীরিক সমস্যা হবে এই চিন্তাই আমরা করছি না।তুমি ভয় পেয়ো না।”
না আসলেই সে ভয় পাচ্ছে না। তবে আপনাদেরকে নিয়ে সব রোগীরাই ভয় পায়। এই ছোট মানুষটি ও পাচ্ছে। আমাদের আরেকজন করোনা সাসপেক্টেড ছিলো যে কিনা আমাদের প্রথম রোগীর পল্লী চিকিৎসক। তিনি তার দোকানঘরেই থাকতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আপনারা আমাকে হাজার হাজার ফোন দিলেন তাকে এখান থেকে সরানোর জন্য। তাই বাধ্য হয়ে আমরা নিয়ে এলাম আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রে। তিনি অবশ্য খুব ভালো আছেন। তিনি অন্য একজনকে বলেছেন তাদেরকে দেখতে যাচ্ছি না তাই এটি তিনি ফেসবুকে জানিয়ে দেবেন। আমি হেসে বললাম
“জানিয়ে দিতে পারেন। তবে এটি কোন চিকিৎসা কেন্দ্র নয়। এটি শুধুমাত্র আপনাদের নিরাপদে আলাদা থাকার ব্যবস্থা।পজিটিভ হলে এবং আপনার শারীরিক সমস্যা হলে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। তখন আমরা নিয়মিত দেখবো। বেশী সমস্যা হলে ঢাকায় রেফার করবো। না হয় এখান থেকেই কোয়ারেন্টাইন শেষ করে বাড়ী যাবেন। তাঁর অবশ্য কোভিড-১৯ পজিটিভ এসেছে। যেহেতু তিনি সম্পূর্ন সুস্থ আছেন তাই ওখানেই আইসোলেশনে থাকবেন। তিনি অবশ্য প্রথম দিন থেকেই এরকম আছেন। তিনি বললেন তার তো কোন সমস্যাই নেই। আমি বললাম আলহামদুলিল্লাহ বলেন। তিনি সহমত হলেন।আমি তাকে যথাসম্ভব মানসিক সাপোর্ট দিলাম। এটিও বুঝালাম যে আপনার শরীরে হয়তো কিছুই হবে না তবে এটিই অন্যকে মেরে ফেলবে। ৮০% মানুষেরই কিছু হয় না। কাজেই অন্যদের স্বার্থে সংযত থাকবেন। আপনার কাছে থেকে যেন আর কারো না হয়। তিনি খুশি হলেন মনে হয়। তার পরিবারের ব্যাপারে উম্মা প্রকাশ করলেন। আমি অভয় দিলাম এবং পরদিনই চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সেটি পূরন ও করলাম।
গতদিনটি ছিলো সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতার। এক বাচ্চা রোগী পরীক্ষার স্যাম্পল দিলো শিশু হাসপাতালে গিয়ে। তাকে আগে দেখেছিলাম আমি। মাঝে একবার মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলো মেয়েকে নিয়ে পেট ব্যাথার জন্য। ওখান থেকে আক্রান্ত হয়েছে মনে হয়। প্রথমে ফোন দিয়ে তাদের পাইনি কারন মোবাইল বন্ধ। জটিল ব্যাপার, কোথায় খুঁজবো বুঝতে পারছিলাম না। মনে করেছিলাম ঢাকায় বাসা। পরে ভুল ভাঙলো। এই রোগী মাতুয়াইল থেকে আসার পর থেকেই কোয়ারেন্টাইনে আছে। মাঝে একবার হাসপাতালেও এসেছিলো জরুরী বিভাগে। কখন আবার ঢাকা গেলো বুঝতেই পারলাম না। কোয়ারেন্টাইন ভেঙ্গে হাসপাতাল পারমিট করেছিলাম ,কিন্তু কখন ঢাকা শিশু হাসপাতাল গেলো জানালোই না।
তাদের প্রতিবেশীরা তাদেরকে আলাদা টয়লেটও করে দিয়েছে তারপরে ও বাচ্চার বাবা নাকি দোকানে গিয়ে বসে। সবার কান্নাকাটি ছিলো দেখার মতো। সবাই চায় আমরা যেন এখান থেকে এই পরিবারকে সরাই। কমিশনার সাহেব অবশ্য ভয়ে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে থাকেন। তবে নিজেদের আড্ডা মনে হয় কন্ট্রোল হচ্ছে না। তবে তিনি ঐ পরিবারকে ভালো অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন।
আপনারা যারা পত্রিকায় চোরদের দেখছেন, চাল চুরির খবর পড়ছেন তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে দেখেন জনপ্রতিনিধিরা কি করে! অনেকেই নিজের পকেটের টাকা মানুষকে দিচ্ছেন। মানুষের দূর্দিনে পাশে থাকছেন। কাউকে নিরাশ করছেন না ত্রানের বেলায়। কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষকে ত্রান দিচ্ছেন, বাজার করিয়ে দিচ্ছেন। নিজেরা কোয়ারেন্টাইনে দিচ্ছেন, আমাদের স্বাস্থ্য কর্মীদের সহায়তা করছেন। এখানেই তারা ব্যতিক্রম। তারা এখানে অন্যরকম ভালোবাসার দাবী রাখে।
শিশুটিকে তার মা-বাবা সহ আমরা কেন্দ্রে না নেওয়া পর্যন্ত আমরা রেহাই পাইনি। শিশুটি কিন্তু এখন একদমই সুস্থ। আরো দশ-বারোদিন পর হয়তো জীবাণুটি থাকবেই না।
আমাদের আরেক রোগী ছিলো কোয়ারেন্টাইনে। তার পনেরদিনের মাথায় কোভিড-১৯ পজিটিভ পাই। নারায়ণগঞ্জে চাকরী করে সে। সে সম্পূর্ন সুস্থ। প্রথমদিকে কিছু শারীরিক সমস্যা থাকলে ও চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠে। পরিবারটি বেশ শিক্ষিত হওয়ায় তাকে হোম আইসোলেশনে রাখার ভরসা পাই। আমার পূর্ব পরিচিত হওয়ায় ভরসাটা আরো বেশী কারন ওদেরকে যেভাবে বলবো ওরা সেভাবেই শুনবে। কিন্তু জনগন নারাজ। রোগীর ভাই নাকি তাস খেলেছে অন্যদের সাথে।তাসপার্টি সহ সবাই কোয়ারেন্টাইনে এখন। আমার স্বাস্থ্যকর্মী মেম্বারের সহযোগীতায় দিয়েছে এসব কোয়ারোন্টাইন।
এখন জনগন ভয় পাচ্ছে। তারা চায় ঢাকা পাঠিয়ে দেই। ঢাকা যেন খুব সোজা ব্যাপার। ওখানে পাঠালেই গ্রাম করোনামুক্ত হয়ে যাবে। আর তাসের আড্ডা যেন এখন পারমিশন প্রাপ্ত!
জনগনকে জিজ্ঞেস করলাম,
” তাস খেলেছিলেন কেন? ওটার কি পারমিশন আছে? চায়ের সবচেয়ে বড় আড্ডাটা এই গ্রামেই ছিলো যেটি আমিই ভেঙ্গেছি, ওটার কি পারমিশন ছিলো? এখানে এতো মানুষ কেন এসেছেন? আমরা কি ডেকেছি?”
কোন জবাব নেই। সবাইকে চলে যেতে বললাম। ওরা চলে গেলো। মেম্বারদের বুঝালাম সব ব্যাপার। ঢাকা কেন পাঠাবো না সেও বুঝালাম। কখন পাঠাবো সেও জানালাম। সবাই মোটামুটি ঠান্ডা হলো। সমস্যা হলো আপনাদের দ্বিচারিতা এবং দ্বিমুখী স্বভাব। এখনই আপনারা একসাথে চা খাচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন, তাস খেলছেন। যখন দেখলেন তার করোনা থাকার সম্ভাবনা আছে তখনই শত্রু হয়ে গেলেন। অথচ একবার ও চিন্তা করলেন না তার রোগ সেরে যাবার পরে সে আপনারই খেলার সাথী, আড্ডার বিশ্বস্ত সঙ্গী। এতো কাছের মানুষগুলোর সাথে এমন করতে আপনাদের বুক একটুও কাঁপছে না। করোনায় বাংলাদেশে তেমন বেশী মানুষ মারা যাবে না বলেই আমার ধারনা তবে মনুষ্যত্ব অনেকখানি মরে গেছে ইতিমধ্যেই।
আচ্ছা, আমি যে আপনাদের স্বার্থে গত দেড়মাস ধরে কাজ করছি মাঠেঘাটে, করোনা রোগীদের হাটে, এতোদিন আপনাদের মুক্ত রাখতে পেরেছি করোনা থেকে, করোনা রোগীদের সেবা ও দিচ্ছি, আমিও যদি আক্রান্ত হয়ে যাই আপনাদের জন্য কাজ করতে গিয়ে, আমাকে ও আপনারা বের করে দিতে চাইবেন নাকি? সম্ভবত! অনেক উদাহরন ইতিমধ্যেই তৈরী হয়ে গেছে এদেশে।
৮০% রোগীই কোন লক্ষন প্রকাশ করবে না,এবং এরা সুস্থ । ওদের চিকিৎসা লাগবে না। ১৫% রোগী কিছু লক্ষন প্রকাশ করবে এবং এরা ঘরে চিকিৎসা নিয়েই সুস্থ হবেন। ৫% রোগী হাসপাতালে ভর্তি হবে। এর মধ্যেই বিরাট অংশ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরবে। এখানে কেউ কেউ মারা যাবে এবং যাচ্ছে ও। নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি শুরু হয়েছে। এটি হয়তো আরো ভালো ফল বয়ে আনবে। ৫% ভর্তি হলে ও এই উপজেলাতেই ১৭০০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হবার কথা। এতো সিট কি হাসপাতালে আছে? কাজেই আমার সিস্টেমটাই মেনে চলবেন। করোনা কোন অভিশাপ নয় এটি একটি রোগ মাত্র। সবাই সহনশীল হোন।
এখন যারা নিয়ম মানছেন না তারা আক্রান্ত হবেন কারন রোগীরা রোগ ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত অটো, সিএনজি, রিক্সা ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে তারা গাড়ীতে ছড়িয়ে দিয়ে এসেছেন। আপনি বাড়ীর বাইরে বের হয়ে ইচ্ছে করলেই নিয়ে যেতে পারেন আপনার ঘরে। তাই আপনি ও মুক্ত নন। প্রতিবেশী রোগীদের ডিস্টার্ব করবেন না। তাদেরকে খাবার দাবার ঔষধসহ মানবিক সহায়তা করুন। তাদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে সহযোগীতা করুন। আমাদের স্বাস্থ্য কর্মীদের সহযোগীতা করুন। মনে রাখবেন আপনি মাত্র ছয়ফুট দূরে থাকলে কিংবা ভালো মাস্ক পড়ে থাকলে আপনাকে এ রোগ ধরতে পারবে না।
যে কোন কিছু খাবার আগে, নাকমুখ চুলকানোর আগে, চোখ কচলানোর আগে অবশ্যই সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড অপেক্ষা করে হাত ধুয়ে ফেলবেন। আমি অবশ্য যোগ করছি বাইরে থেকে আসলে মুখ মন্ডল সাবান দিয়ে চোখ বন্ধ রেখে ২০ সেকেন্ড পরে মুখমন্ডল ধুয়ে ফেলবেন অথবা গোসল করে নিবেন। আপনারা এইটুকু করতে পারলেই আমরা সবকিছু কন্ট্রোল করতে পারবো। আর যদি ডিস্টার্ব করতেই থাকেন প্রতিবেশীদের তবে সরকারী সংক্রামক ব্যাধি আইনটি প্রয়োগ করতে আমার একটু ও হাত কাঁপবেনা আগেই বলে রাখলাম।
ডাঃমোহাম্মদ আল-মামুন
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া