রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২০
সেদিন একটি ফোনে আমার চৈতন্যদয় হলো। ফোনটি করেছেন আমার এক সাবেক ডাক্তার সহকর্মী। তিনি এক রোগীর জন্য ফোন করেছেন, রোগী তার নিকটাত্মীয়। রোগীর সমস্যা সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট। এই রোগী নিয়ে কি করবে এটিই তার প্রশ্ন। তার ধারনা এটি করোনাই। আমি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে বললাম। সে একটু অবাকই হলো। এরকম রোগী নাকি সারা ঢাকাশহর ঘুরে ঘুরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে কোন চিকিৎসা না পেয়ে। আর এই উপজেলায় কিনা বলছি হাসপাতালে পাঠিয়ে ভর্তি করে দিতে!
রাতে রোগীটি না এলে ও পরদিন সকালে এসে উপস্থিত হয়। আমরা জরুরী বিভাগের জন্য দুটি রুম ব্যবহার করছি মার্চের আট তারিখের পর থেকেই। সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য একটি রুম আর একটি বাকি সবার জন্য। সর্দিকাশির রুমটিতে যথাসম্ভব পিপিই পড়েই সার্ভিস দেয়া হয়। আমরা নির্ধারিত রুমে তাকে দেখে ভর্তি দেই আইসোলেশন ওয়ার্ডে এবং তার স্যাম্পল কালেকশন করে ঢাকা পাঠাই। চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হয়ে উঠে দুদিনেই। রেজাল্ট আসে কোভিড নেগেটিভ। তার মা বাবা ছুটি নিয়ে বাসায় নিয়ে যায়। রোগী এখনো ভালোই আছে। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যেই ইনশাল্লাহ্।
আসলে আমরা প্রথম থেকেই কোন রোগীকে ফিরিয়ে দেইনি। রেফার করি না যথেষ্ট কারন ছাড়া। সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট থাকলে ও প্রশ্নই আসে না রেফার করার। আমরা আগে প্রাথমিক চিকিৎসা দেই, প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো করি, পরে প্রয়োজন মোতাবেক রেফার করি অথবা ভর্তি রেখে দেই। সিস্টেম সোজাসাপ্টা। আমাদের সব ডাক্তার, নার্স কাজ করছি একটি ইউনিটের মতো। আমরা কোন রোগীকে চিকিৎসা না দেয়ার চিন্তা দুঃস্বপ্নে ও করিনি। কাজেই কোন জরুরী রোগী এখান থেকে চিকিৎসা না নিয়ে ফিরে যেতে হয়নি, তিনি করোনা আক্রান্ত হোন আর নাই হোন। আমাদের প্রথম করোনা রোগী ও এভাবে চিকিৎসা নিয়েই ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। পরে তার করোনা ধরা পড়ে আমাদের পাঠানো স্যাম্পলে।
আমাকে আরো কিছু ফোন ফেস করতে হয় রোগী ভর্তির জন্য। ম্যাক্সিমাম ফোনের আগেই রোগী ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো এবং আমরা চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছিলাম। আমাদের করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীরা আমাদের তত্ত্বাবধানেই সেলফ আইসোলেশনে আছেন। কেউ কেউ বাড়ীতেই থাকছেন হোম আইসোলেশনে। তারা সবাই ভালো আছেন। ইতিমধ্যেই তিনজনের প্রথম স্যাম্পল নেগেটিভ চলে এসেছে। দ্বিতীয় স্যাম্পল ও কালেক্ট করা হয়ে গেছে। আমাদের জনগণ অনেক সহযোগিতা করছেন।
যারা যুদ্ধে স্বেচ্ছায় যোগদান করেন তারা অবশ্যই জাতযোদ্ধা। এই যোদ্ধারা অগ্রগামী হিসেবেই থাকেন। যুদ্ধে তাদেরকে ডেকে আনতে হয় না। যুদ্ধে ডেকে এনে, প্রেশারে রেখে যুদ্ধ করানো যায় না। এটি আসলে স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার। সকল অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধেই প্রথমদিকে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। মনে হয় যেন ডিফেন্স লাইন ভেঙ্গে পড়েছে অথবা কোন প্রতিরোধই গড়তে পারছে না প্রতিপক্ষের সাথে। আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধেও প্রথমদিকে এমনই হয়েছিলো। ডিফেন্স বলতে কোনকিছুই ছিলো না তবে তা দাঁড়াতে কিন্তু বেশীদিন সময় লাগে নি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যোদ্ধা নির্ধারন, মুক্তি যোদ্ধাদের ট্রেনিং, যোদ্ধা বাছাই সব কিছুই হয়ে গিয়েছিলো এবং দলে দলে নতুন যোদ্ধারা যোগ দিয়েছিলো। যার ফলে অর্জিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা।
এই করোনা যুদ্ধে ও প্রথম থেকেই সবাই যোগ দেয়নি। যে যেখানে ছিলো বিচ্ছিন্নভাবেই যোগ দিয়েছে করোনা মোকাবেলায়।অনেক কিছুর অভাব থাকা সত্বেও অনেক ডাক্তার নার্স স্বেচ্ছায় কাজ করে গেছেন ক্লান্তিহীন। উপযুক্ত ট্রেনিং ছিলো না কারোরই। পিপিই না থাকা কিংবা থাকলেও তার ব্যবহার বিধি সম্পর্কে জানতেন খুব কম সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীই। ডাক্তারগণও সবাই জানতেন না। যার ফলে অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন কিছু না বুঝেই। উপযুক্ত ট্রেনিং এবং এর ম্যাচুরিটি আসতে সময়ের প্রয়োজন হয়। আমরা সবাই এই ধরনের সিকিউরিটি ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত নই আগে থেকে। শুধুমাত্র কতিপয় চিকিৎসক যারা সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ করতেন তারা জানতেন কিভাবে এটি পড়তে হয়, কিভাবে খুলতে হয় কিভাবে বর্জ্য হিসেবে ফেলতে হয়। বাকিরা এ ব্যাপারগুলো নিয়ে কিঞ্চিত আইডিয়া থাকলেও পদ্ধতিটা সম্পর্কে জানার কোন কারণ ছিলো না। সাথে ছিলো ইউরোপ আমেরিকার মতো মৃত্যুভয়। কাজেই এই অবস্থায় জীবনঝুকি নিয়ে করোনা যুদ্ধে অনেকে সামিল হয়নি সঙ্গত কারনেই।
এহেন পিপিই পড়া এবং পরিহিত থাকা অবস্থায় ও ইনফেকশন হলে এবং পুরো ঘর আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকা অবস্থায় কেউ যদি এই ডিউটি থেকে পালাতে চায় তাকে দোষ দেওয়া যাবে কি? নিশ্চয়ই নয়। একটি সামরিক যুদ্ধে শুধুমাত্র যোদ্ধা ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকছে, পরিবারের কেউ নয়। অথচ এখানে পুরো পরিবারই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে যদি ডাক্তার/নার্স আক্রান্ত হয়। তার মাধ্যমেই পরিবারের সবাই মৃত্যুর সম্মুখীন হতে পারে। এটি এমন এক যুদ্ধ যেখানে অংশগ্রহন করতে গিয়ে পুরো পরিবার অনেকেরই আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক ডাক্তার পরিবারের বয়ষ্ক সদস্য হারিয়েছেন।নিজে মারা গেলে হয়তোবা তাদের এতো কষ্ট থাকতো না। এখন সারাজীবন তাদের বিবেকের কাছে তারা কান্না করবেন আর প্রশ্ন করবেন,
“কেন যে ডাক্তার/নার্স হয়েছিলাম? তা না হলে তো এরকমভাবে বাবা কিংবা মাকে হারাতে হতো না!”
আমরা জানি, আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন কার জন্য কি ভালো রেখেছেন,তারপরে ও মনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য একটি ভাষা থাকছে না অনেকেরই। এই করোনাতে যদি আমাদের দেশের কোটি কোটি লোক আক্রান্ত হয়ে যায় তবে কোন ডাক্তার কোনভাবেই ঘরে বসে থাকবেন না কিংবা থাকতে পারবেন না। কারণ তখন আক্রান্তের তালিকায় বাবা মা ভাই বোন কিংবা কোন প্রিয় স্বজন থাকবেনই। আবার তারা সকলেই উচ্চশিক্ষিত। অথচ তাদের কেউ কেউ এখন সেফসাইড নিয়ে বসে আছেন। এই বসে থাকা তাদের জন্যই কাল হবে। তারা যদি ভূমিকা নিতো তবে হয়তো জীবাণুটি ঘরে ঘরে ছড়াতে পারতো না। তাদের পচ্ছাৎপসরন তাদেরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তারা এরজন্য নিজেও আক্রান্ত হতে পারেন ঘরে বসে থেকেই।
যে কোন যুদ্ধই দেশের নাগরিককে ভোগাবে। কোন না কোন পয়েন্টে আক্রমন করবেই প্রতিপক্ষের সৈনিকেরা। যার যুদ্ধ কৌশল জানা থাকবে তিনি প্রথম থেকেই যুদ্ধে যোগ দেওয়াই হলো সভ্যতার অংশ। আর না দিলে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পরে যোগ দিতে বাধ্য হবেন আর আফসোস করবেন কেন যে আগে থেকেই শুরু করলাম না! এই যুদ্ধ আগুনের মতোই ছড়ায়। আমরা সবাই জানি যে নগর পুড়িলে দেবালয় এড়ায় না। যুদ্ধ সবাইকে নিষ্কৃতি দিতে পারে না। কোন সৈনিকের সামনে যত সমস্যাই থাকুক না কেন একটি পর্যায়ে এসে তাকে যুদ্ধে নামতেই হয় দেশের প্রয়োজনে। আর সে প্রয়োজন যদি না হয় তবে হয়তো তিনি সেফটি লকে থাকতে পারবেন। তাতেও তিনি সারাজীবন সীমাহীন মানুষিক কষ্ট ভোগ করবেন দেশকে ফাঁকি দেয়ায়।
যারা চরম দুসময়ে যুদ্ধে যোগ দিবেন তারাও কোন সরকারী চাপ কিংবা সামাজিক চাপ নয় বরং মনস্তাত্ত্বিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেই যুদ্ধে নামবেন। আগেই বলেছি যুদ্ধে যোগদান একটি স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার, এখানে জোর করে নামানোর কোন বিষয় নেই। জোর করে কাউকে দিয়ে যুদ্ধ করানো যায় না, এখানে দরকার হয় মোটিভেশন। জগতের বড় বড় জেনারেলগন ভালো মোটিভেট করতে পারতেন। তাইতো তারা যুদ্ধ করে অনেক জয়ের মুখ দেখতেন। সম্রাট আলেকজান্ডার সর্বকালের সেরা জেনারেলদের একজন যিনি মোটিভেশন করে সৈনিকদের টানা দশবছর যুদ্ধের ময়দানে রাখতে পেরেছিলেন। আর কোন জেনারেল এতো দীর্ঘ সময় ধরে সৈনিকদের ময়দানে রাখতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। আবার এমন অনেক জেনারেল আছেন যারা কয়েকদিনের ভিতর হাজার হাজার সৈন্য যোগাড় করে ফেলতেন মোটিভেশন করার মাধ্যমে। যদিও সকল সৈনিকই জানতো যে যুদ্ধ মানেই মারো অথবা মরো।
যুদ্ধ কোন আনন্দের বিষয় নয়। এটি কোন কাবাডি কাবাডি খেলা নয় যে দলে দলে যুদ্ধ করার জন্য লোকজন চলে আসবে।বরং এখানে নিজের সাথে পরিবারের লোকজনও আক্রান্ত কিংবা মারা যাওয়ার ও সম্ভাবনা থাকছে। তাই এমন একটি কন্ডিশন যোদ্ধাদের সামনে তুলে ধরতে হবে যাতে করে দলে দলে যুদ্ধ করতে চলে আসে মানুষেরা। হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করার জন্য প্রস্তুত থাকে লাখো সেনানী। নিজের মৃত্যুকে মনে করবে অত্যন্ত গৌরবজনক একটি ব্যাপার। আমরাই পারি সেই কন্ডিশন তৈরী করতে। এটি কোন প্রকার প্রনোদনা কিংবা টাকার লোভ দেখিয়ে হবে না। এখানে দরকার বড় বড় কর্মকর্তাদের মোটিভেশনাল স্পিচ, মোটিভেশনাল ওয়ার্ক যা সবাইকে উদ্ধুদ্ব করবে যুদ্ধে যেতে। ইতিমধ্যে অনেকগুলো স্টেপ নেয়া হয়েছে যা অনেককে মোটিভেট করতে সক্ষম হয়েছে। ফাইভ স্টার হোটেলের কোয়ারেন্টাইন তেমনি একটি। এটি মর্যাদাপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। প্রনোদনা নিয়ে বলার কিছু নেই। অফিস থেকে যখন নাম চাওয়া হয়েছিলো তখন আমিও আমার ডাক্তার কেউই নাম দেইনি কারন এটি অপমানজনক মনে করেছে সবাই। আমরা বিশ্বাস করি জাতির সূর্যসন্তানদের খাতায় নাম দিয়ে চেনাতে হয় না, ওরা সূর্যের মতোই মধ্য আকাশে জ্বলন্ত। এখন অবশ্য সিস্টেম পরিবর্তন করেছেন যার জন্য অথোরিটি ধন্যবাদ প্রাপ্য।
জাতির দূর্দশায় প্রনোদনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না, টাকাগুলো রেখে দিন যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক পূণর্গঠনের জন্য।জাতির মানুষ যদি মরে যায় তবে টাকা দিয়ে কি হবে? আমাদের জাতি বেঁচে থাকুক এটিই আমাদের চাওয়া। আমরা জাতি হিসেবে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থায় যেতে চাই। বাসস্ট্যান্ডের পাশে মার্কেটের ছাদে আহত “হোয়াইট কোট ওয়ার “এর যোদ্ধাদের জন্য হাসপাতাল করার ঘোষনা নেগেটিভ মোটিভেশনও হতে পারে। যেকোন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে সহজেই ডাক্তারদের জন্য কোভিড হাসপাতালে রূপান্তর করা যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একটি ভালো বিকল্প হতে পারে অথবা স্কয়ার হাসপাতালকেও বেছে নেয়া যেতে পারে। এই দূর্দিনেও মালিকপক্ষের চোখ রাঙানি উপেক্ষা না করতে পারলে আমরা বোধ করি কখনোই অর্গানাইজ হতে পারবো না আর। আমরা জাতিগতভাবে এই দুঃসময়ের মোকাবিলা করতে চাই। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো লড়তে চাই আমাদের দেশের মানুষকে রক্ষার জন্য। শুধু সকলের সহানুভূতিটুকু দরকার।
স্বতঃস্ফূর্ত যুদ্ধে যোগদান না করলেও সময়ের প্রয়োজনে একদিন সব ডাক্তারকে করোনা যুদ্ধে যোগ দিতে হবে ঠিকই, মাঝে থেকে অনেক প্রাণ ঝরে যাবে অকারনেই, এমনকি অনেক স্বনামধন্য লোকের নিজের প্রাণটুকুও ঝরে যেতে পারে বিনা কারনে, বিনা চিকিৎসায়। তবে এখন যোগ দিলে তারা আমাদের মেডিকেল পেশাটাকে যেমনই সম্মানের আসনে তুলে ধরতে পারবেন, তেমনি তারাও জাতীয় বীর হিসেবে ভূষিত হবেন। আমরা যারা প্রথম থেকেই রুখে দাড়িয়েছি তারা ঠিকই জনগণের সাপোর্ট পাচ্ছি, ভালোবাসা পাচ্ছি। ষোল কোটি মানুষের মাঝে শদুয়েক সাইকো ফেসবুকে বাজে কিছু বললো কি না বললো তা দিয়ে জনতার চিত্রটি প্রকাশ পায় না। জনগন সবসময়ই সঠিক। তারা কিছু ভুল না বুঝে করে ফেলেন ঠিকই তবে বুঝাতে পারলে সঠিক কাজটাই করেন। তারা ভালোকাজের পক্ষে থাকেন সর্বদাই। আমরা জনতার ভালোবাসা পেয়ে গর্বিত এবং কৃতজ্ঞ। জয় হোক বাংলার মানুষের।
লেখকঃ ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া