প্ল্যাটফর্ম নিউজ
শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২০
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের নতুন উপকেন্দ্র হতে যাচ্ছে গাজীপুর। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী এই জেলাটিতে। এখন পর্যন্ত জেলাটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৮২ জন, যা দেশে শনাক্ত হওয়া মোট রোগীর শতকরা ৫.২১ অংশ। আক্রান্তদের মধ্যে ৮ জন চিকিৎসক এবং ১৯ জন স্বাস্থ্যকর্মীও আছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১৬ এপ্রিল) পর্যন্ত দেশে মোট ১ হাজার ৫৭২ জন করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০৮ জন ( দেশে মোট আক্রান্তের ৩৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ) রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। আক্রান্তের দিক থেকে এর পরের অবস্থানে আছে নারায়ণগঞ্জ। এই জেলায় এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ২৫৫ জন রোগী, যা দেশের মোট শনাক্ত হওয়া রোগীর শতকরা ১৬ দশমিক ২২ অংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ রোগী গাজীপুরে। এক সপ্তাহের মধ্যে জেলাটিতে শনাক্তকৃত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১৪ গুণ। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর ভাষ্যমতে, গাজীপুরে আক্রান্তদের বড় অংশ নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে সম্পর্কিত। নারায়ণগঞ্জের মতো গাজীপুরও শিল্প-অধ্যুষিত এলাকা। ঘনবসতিপূর্ণ এই জেলাটিতে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ মানুষের বাস বলে ধারণা করা হয়। নারায়ণগঞ্জ ও রাজধানী ঢাকার সঙ্গে গাজীপুরের সীমানা। সংক্রমণ ঠেকাতে ১১ এপ্রিল গাজীপুর জেলা পুরোপুরি লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করা হয়। কিন্তু লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় লকডাউন ঘোষণার পর থেকে বরং সংক্রমণের সংখ্যা দিনদিন দ্রুতগতিতে বাড়ছে। লকডাউন ঘোষণার দিন অর্থাৎ, গত শনিবার (১১ এপ্রিল) পর্যন্ত জেলাটিতে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে ১২ জন শনাক্ত হয়েছিলেন। এর পরের পাঁচ দিনে সেখানে শনাক্ত হয়েছেন আরও ৭০ জন ( প্রায় ৬ গুণ) প্রসঙ্গত, গাজীপুরে ১৬ মার্চ প্রথম ইতালিফেরত ( তিনি মূলত নরসিংদীর বাসিন্দা) ব্যক্তির মধ্যে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর ২৯ মার্চ গাজীপুরের বারবৈকা এলাকায় জেলার ২য় করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। তিনি ইতালিফেরত এক আত্মীয়ের সংস্পর্শে এসেছিলেন। এরপর থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ওই জেলায় নতুন কোনো সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। ১০ এপ্রিল আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয় ৬। পরের দিন আরো ৪ জন নতুন শনাক্ত হন। এরপর থেকে রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রোগী বেড়েছে প্রায় ১৪ গুণ। জেলাটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে গাজীপুরের সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত সেখানে ১১০ জনের মধ্যে সংক্রমণ পাওয়া গেছে। নতুন ২৮ জনের হিসাব আজ (১৭ এপ্রিল) শুক্রবার IEDCR এর হিসাবে যুক্ত হবে। গাজীপুর জেলার মধ্যে কাপাসিয়া উপজেলায় সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। এই জেলায় গতকাল আক্রান্ত ১৮ জনের মধ্যে ১৩ জন কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যকর্মী। ওই উপজেলায় অবস্থিত একটি কৃষিপণ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের ১৭ জন শ্রমিকের মধ্যেও সংক্রমণ পাওয়া গেছে। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও ২ জন পুলিশ সদস্য, ১ জন সাংবাদিক এবং পোশাক কারখানার শ্রমিকের মধ্যেও সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এর মধ্যে বিদেশফেরতও আছেন ৮জন। আক্রান্তদের বয়স ২৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। IEDCR এর পরিচালক ডা. ফ্লোরা বলেন,
“গাজীপুরে আক্রান্ত বাড়ছে। তবে তাঁরা এখনো গাজীপুরকে ‘এপিসেন্টার’ (সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল) মনে করছেন না। এই জেলার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সরাসরি ভালো যোগাযোগ রয়েছে। অনেকে নারায়ণগঞ্জের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছেন।”
গাজীপুর থেকে রোগ ছড়াবে, সেটা তাঁরা এখনো মনে করছেন না। তবে গাজীপুরকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রেখেছেন তাঁরা। গাজীপুরের সিভিল সার্জন মো. খাইরুজ্জামান জানান,
“মানুষ এখন লকডাউন মানছে না। সামাজিক দূরত্বও বজায় রাখছে না। পার্শ্ববর্তী জেলার লোকজন গাজীপুরে যাতায়াত করতে পারছে। পুলিশ শত চেষ্টা করে মানুষকে ঘরে রাখতে পারছে না। ফলে দিন দিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া শুরুতে পরীক্ষা কম হয়েছে, এখন পরীক্ষা বেশি হচ্ছে, শনাক্তও বেশি হচ্ছে।”
এর আগে গত বুধবার (১৫ এপ্রিল) স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন,
“গাজীপুরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সংক্রমণ ঠেকাতে গাজীপুর জেলা পুরোপুরি লকডাউন করা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) তৈরির জন্য এখনো অনেকগুলো পোশাক কারখানা চালু আছে। বেতন-ভাতার দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ হচ্ছে।”
গতকালও (১৬ এপ্রিল) গাজীপুরের বোর্ডবাজার ও চৌরাস্তা এলাকায় তিনটি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বেতন-ভাতার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। স্থানীয় কাঁচাবাজারগুলোতে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রচুর জনসমাগম দেখা যায়। পোশাকশিল্প কারখানার বড় অংশ গাজীপুরে, যার অনেকগুলো এখনো চালু আছে। ইতিমধ্যে এখানকার পোশাকশ্রমিকও আক্রান্ত হয়েছেন। একজন পোশাকশ্রমিক গাজীপুর থেকে নেত্রকোনায় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর সংক্রমণ ধরা পড়ে। ইতিমধ্যে এমন কতজন কত জায়গায় ছড়িয়ে গেছেন, তার কোনো আন্দাজ করতে পারছেন না স্থানীয় প্রশাসনও।
সর্বোপরি, লকডাউন উপেক্ষা করে, পুলিশকে তোয়াক্কা না করে জনসাধারণের রাস্তাঘাটে অবাধ চলাচল, স্থানীয় কাঁচাবাজারগুলোতে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হওয়া লোকসমাগম এবং এই অবরুদ্ধ অবস্থাতেও পোশাক শিল্পকারখানার মালিকদের গাফিলতিতে হাজার হাজার পোশাক-শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতি জেলাটিকে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে!!
নিজস্ব প্রতিবেদক/ অংকন বনিক জয়