প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৭ এপ্রিল ২০২০
একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। করোনা রোগীদের অনেকেই রোগ ডায়াগনোসিস হবার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে মারা যাচ্ছে। রোগী আপনার কাছে এসেছে পেট ব্যথা নিয়ে, আপনি তাকে পেটের এক্স-রে করতে দিলেন। এক্স-রে তে বুকের যতটুকু দেখা যায় সেখানে দেখা গেল নিউমোনিয়ার মতো স্পট। আপনি দ্রুততম সময়ে তাকে করোনা টেস্ট করতে দিলেন- সেটা আসলো পজেটিভ। বিকালে বা পরদিন সকালে খবর নিয়ে জানলেন রোগী মারা গেছে।
দুদিন আগে সার্জারি ওয়ার্ডে একজন রোগী ভর্তি হয়েছিল। সিস্টার তাকে ক্যানুলা করার সময় রোগী দিল কাশি। তার আগ পর্যন্ত কেউ জানতো না তার কোন কাশির সমস্যা আছে। সন্দেহবশত করোনা পরীক্ষা করানো হলো। সেটাও আসলো পজেটিভ। রোগীকে কোভিড হাসপাতালে পাঠানো হল। কিন্তু সেখানে যাবার আগেই তার মৃত্যু ঘটে।
এত দ্রুত কেন ঘটছে মৃত্যুগুলি? যেটা আবার এক্স-রে বা সিটি-স্ক্যানের নিউমোনিয়া দ্বারা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। কারো কারো অক্সিজেন কমতে কমতে খুব দ্রুত মারাত্মক শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাচ্ছে যেটা আবার বুকের এক্সরে বা সিটি-স্ক্যান এর সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। তাহলে কি ঘটছে করোনা রোগীদের দেহে?
এখন দেখা যাচ্ছে শুধু নিউমোনিয়া বা এআরডিএস (একিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রম) এ শুধু রেসপিরেটরি ফেইলিওর দিয়েই এই হঠাৎ মৃত্যুগুলি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, তার হঠাৎ মৃত্যু (Sudden death) এর আছে আরও বিবিধ কারণ।
লক্ষ্য করা যাচ্ছে করোনা নিজে একটা hypercoagulable state অর্থাৎ এটি রক্তনালিতে জায়গায় জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধিয়ে ফেলে। সেদিন এই ঢাকা শহরেই এক করোনার রোগী একদিকে নিউমোনিয়া আরেকদিকে ব্রেইন স্ট্রোক একই সময়ে। নিউমোনিয়া খুব একটা মারাত্মক ছিল না কিন্তু হঠাৎ করেই তার মৃত্যু ঘটে। তার বুকের সিটি-স্ক্যান ও শ্বাসকষ্টের মাত্রা অনুযায়ী এত দ্রুত মৃত্যু প্রত্যাশিত ছিল না। ঘটনা হয়েছে কি, তার ব্রেনের রক্তনালী জমাট বেধে স্ট্রোক করেছে আর ফুসফুসের রক্তনালী জমাট বেঁধে ব্লক হয়ে গিয়ে হঠাৎ মৃত্যু হয়েছে। ফুসফুসের রক্তনালী ব্লক হওয়াকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে Pulmonary embolism (PE)। হঠাৎ রহস্যজনক মৃত্যু ঘটাতে এই Pulmonary embolism এর মত অদৃষ্ট আততায়ী আর দ্বিতীয়টি নেই। শুধু ফুসফুস বা ব্রেইন নয়, এটি হাত-পাসহ শরীরের যে কোনো রক্তনালী ব্লক করে দিতে পারে। তবে তাতে হঠাৎ মৃত্যু না হলেও জমাটবদ্ধ এরিয়াটা কালচে বা গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। তাই স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসায় সিলেক্টেড কেইস এ হেপারিন দেয়াটা রুটিন প্রেক্টিস এর মধ্যে চলে এসেছে চিকিৎসা পদ্ধতিতে।
হঠাৎ মৃত্যুর আরেকটা যে কারণ এখনো দৃষ্টির আড়ালে তা হলো এই করোনা কিন্তু হৃদযন্ত্রকেও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করতে পারে। দেখা যাচ্ছে ফুসফুসে তেমন একটা সমস্যা নাই কিন্তু রোগীর হঠাৎ শ্বাসকষ্ট, হঠাৎ প্রেসার কমে যাচ্ছে। BNP (Brain Natriuretic Peptide) লেভেল দেখা গেল অনেক বেশি। সরাসরি প্রমাণ যেটা হল ইকো পরীক্ষা, তাতে দেখা গেল তার হার্টের সক্ষমতা যেখানে থাকার কথা ৬৫% সেটা ২০, ২৫, ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। করোনার মাধ্যমে ঘটা হৃদযন্ত্রের প্রদাহ (myocarditis) জনিত হার্ট ফেইলিউরে রোগী হঠাৎ মারা যেতে পারে। অথবা সেই অসুস্থ হৃদপিন্ডের হঠাৎ ছন্দপতন (arrythmia) রোগীর হঠাৎ মৃত্যু ঘটাতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে তেমন সিরিয়াস না এমন রোগীও এসব কারণে হঠাৎ নাই হয়ে যাচ্ছে। তুখোড় চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে যদি কেউ বেঁচে যায় তখন দেখা যায় হৃদযন্ত্রের সক্ষমতা আবার সেই আগের অবস্থানে চলে গেছে। ভাইরাস সরাসরি হৃদযন্ত্রকে আক্রান্ত করছে নাকি সাইটোকাইন নামের কোন রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে হার্টকে দুর্বল করে দিচ্ছে সময়ের সাথে সেটা প্রতিভাত হবে। যাদের আগে থেকে হৃদযন্ত্রের সমস্যা তারা থাকেন এ হৃদযন্ত্রের প্রদাহ হবার অধিক ঝুঁকিতে।
দ্রুত মৃত্যু না ঘটালেও করোনা লিভার, কিডনিকে সমভাবে আক্রান্ত করতে পারে। আমেরিকার হাসপাতালগুলিতে ভর্তি অর্ধেক করোনা রোগীর ইউরিনে, ব্লাড কিংবা প্রোটিন পাওয়া যাচ্ছে, যা কিডনি আক্রান্ত হবার চাক্ষুষ প্রমাণ। এক-চতুর্থাংশ হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীর কিডনি ফেইল করছে, ডায়ালাইসিস লাগছে। নিউইয়র্কের মতো স্থানে ডায়ালাইসিস টেকনিশিয়ান এর সল্পতা চলছে।
চীনের একটা কেইস: রোগী এসেছে হলুদ প্রস্রাব ও জন্ডিস নিয়ে। সব হেপাটাইটিস ভাইরাস টেস্ট নেগেটিভ। দুদিন পর আসে জ্বর। করোনা টেস্ট করে দেখা গেল সেটা পজেটিভ।
অর্থাৎ করোনা কোনো সর্দি-কাশি নয়, কোনো বিশেষ অঙ্গের রোগ নয়। ফুসফুস, হার্ট, ব্রেইন, কিডনি, লিভার, পরিপাকতন্ত্র কোনোটাকেই ছাড় দিচ্ছে না এ সব্যসাচী ভাইরাস। এ যেন বহিরাঙ্গের পৃথিবীটার মতো শরীরের অভ্যন্তরে প্রতিটা অঙ্গে দিকেদিকে তার বিজয় পতাকা উড়ানো চাই।
ডা. আমিনুল ইসলাম
মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়