প্লাটফর্ম নিউজ,১৭ইএপ্রিল ২০২০
কোভিড মানেই হাসপাতাল ভর্তি, আইসিইউ বা ভেন্টিলেটর নয়। নয় পারিবারিক বা সামাজিক ভাবে অচ্ছুৎ হওয়া। এই লেখাটিতে কোভিড-১৯ আক্রান্ত পরিবারদের সাথে একটু নিজের (লেখকের) অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য।
মীরার করোনা পজিটিভ হওয়ার খবর পাওয়ার পরপরই তাকে আলাদা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। যেহেতু আমার বাসায় ৪ টা বেডরুম আছে।যে রুমের সাথে বাথরুম সংযুক্ত আছে এবং দক্ষিণমুখী আলোবাতাসপূর্ণ সেই রুমেই সে কমপ্লিট আইসোলেশনে থাকবে। বাইরে থেকে নন টাচ টেকনিকে (সরাসরি হাত দিয়ে না ধরে অন্য কোন জীবাণুমুক্ত মাধ্যম ব্যবহার করা) খাবার ও অন্যান্য জিনিস দেয়া হবে।
অনেকেই বলছে কোভিড পজিটিভ হওয়ায় প্রতিবেশী বা এলাকাবাসী দ্বারা হেনস্তা হচ্ছেন। আমার ক্ষেত্রে সেরকম হয়নি। ফ্ল্যাটের সবাইকে ফোন করে বলেছি মীরার পজিটিভ, তাই আমরা কোয়ারান্টাইন এ আছি। দুয়েকজন ছাড়া সবাই পজিটিভলি নিয়েছেন।
মীরার করোনা আক্রান্ত হবার খবর বিএসএমএমইউ থেকে জানায় শনিবার বিকাল ৫ টার দিকে আর অফিশিয়াল মেসেজ পাই রাত ৮.২১ মিনিটে।প্রথমেই হতভম্ব হবার মতো অবস্থা হলো। কারণ সাসপেক্টেড কেস হ্যান্ডেল করার পর, মীরা টেস্ট করতে চাইলেও আমি না করেছিলাম, যেহেতু পিপিই পরা ছিলো।কিন্তু মীরার যুক্তি ছিলো, যেহেতু
রোগী জ্বর কাশি নিয়ে মারা গেছে, তাই নিজে নিশ্চিত না হলে সোমবার গাইনী এডমিশন ডিউটি করতে গেলে রোগী ও সহকর্মীদের মাঝে অসুখ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকবে।
তাই সে তার ভাইরোলজিস্ট বন্ধু এমএমসি এর ডা. এর পরামর্শে টেস্ট করতে যায়। আক্রান্তের ৪৮ ঘন্টার মাঝেই আরটি পিসিআর রেজাল্ট পাওয়া যায়, মীরা গিয়েছিলো ৫ম দিনে।
পজিটিভ হবার খবর শুনে আমরা দ্রুত পারিবারিক বৈঠকে বসলাম। কুয়েত মৈত্রীতে ফোন করে খবর নিলাম। সেখানে কোনো কেবিন নেই। আমার বাসায় ৪ টা বেডরুম আছে।যে রুমের সাথে বাথরুম সংযুক্ত আছে এবং দক্ষিণমুখী আলোবাতাসপূর্ণ সেই রুমেই সে কমপ্লিট আইসোলেশনে থাকবে। বাইরে থেকে নন টাচ টেকনিকে (সরাসরি হাত দিয়ে না ধরে অন্য কোন জীবাণুমুক্ত মাধ্যম ব্যবহার করা) খাবার ও অন্যান্য দেয়া হবে। সাথে দিলাম প্যারাসিটামল, লোরাটিডিন, ক্লোনাজিপাম (এটা দেয়া যায়, কারণ ভীষণ স্ট্রেসে প্রথম ২ দিন সে ঘুমাতে পারেনি), ওরস্যালাইন। আরো দিলাম ডিজিটাল বিপি ( ব্লাড প্রেশার) মেশিন, পালস অক্সিমিটার, থার্মোমিটার। শুনতে অমানবিক মনে হলেও এটাই আদর্শ।কোনোভাবেই অন্যদের সাথে একরুমে থাকা যাবে না।
এতে সবচেয়ে কষ্টকর হয়েছে পুত্র জোবায়েত ও ভাতিজা জোনায়েতকে দূরে রাখা। খাবার দেবার সময় তাঁরা দুজন টের পেলে এদিক সেদিক লুকিয়ে থাকে আর দরজা খোলা মাত্র মা, বড়মা বলে দ্রুত রুমে ঢুকে যাবার চেষ্টা করে। শারীরিক কষ্টের চেয়ে এই মানসিক কষ্ট কম নয়।
কিছু বেসলাইন টেস্ট করে নিয়েছিলাম। রক্তপরীক্ষা, রক্তের সুগার পরীক্ষা, প্রসাব পরীক্ষা, লিভার ফাংশন পরীক্ষা, বুকের এক্সরে ইত্যাদি সব নরমাল ছিলো।
ন্যাশনাল গাইড লাইন অনুযায়ী অনেকে হাইড্রোক্সিক্লোরকুইন দিতে বলেছিলেন, কুয়েত মৈত্রী ও কুর্মিটোলায়ও দেয়া হচ্ছে শুনলাম। কিন্তু আমি কথা বললাম, আমার সবচেয়ে প্রিয় মেডিসিন ও রিউমাটোলজি স্পেশালিষ্ট স্যার এর সাথে। স্যার দিতে নিষেধ করলেন, একই পরামর্শ পেলাম ইউকে ও ইউএসএ বন্ধুপ্রতিম চিকিৎসকদের কাছ থেকেও।
কিছু মাইল্ড সিম্পটম যেমনঃ গায়ে ব্যাথা, হালকা জ্বর জ্বর ভাব, দুর্বলতা, অরুচি, ওরাল থ্রাস ছাড়া প্রথম তিনদিন ভালোই ছিলো। চতুর্থদিন প্রচন্ড বমি ভাব, ডায়রিয়া শুরু হলো। কোভিড এ অনেক রোগীর পেটের সমস্যা বেশি থাকে। চায়নায় এরকম কিছু রোগী পাওয়া গিয়েছিল। তাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। স্যালাইন আর সাথে জিংক সিরাপ দেয়ার জন্য (কয়েকজন সাজেস্ট করেছিলেন)। পঞ্চম দিন অবশ্য সমস্যা কাটিয়ে উঠেছে।প্রচুর পানি, ফলমূল, ভিটামিন সি, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাচ্ছে।
এবার আসি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভূমিকায়। সিভিল সার্জন অফিস থেকে ফোন করে বাসার নম্বর চাইলো। আমাদের টেস্ট করার উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দিলো, এজন্য আমাদেরই আইইডিসিআর ফোন করতে হবে। আইইডিসিআর কোনোভাবেই আমার ও আম্মার কো মরবিডিটি (করোনা রোগীর সংস্পর্শে) থাকলেও টেস্ট করতে রাজি হয়নি। পরে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতায় টেস্ট করাতে পারি। আল্লাহর রহমতে আমার ও আম্মার রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে। আমাদের দুটি শীর্ষস্থানীয় সংগঠন বিএমএ বা স্বাচিপ বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অফিশিয়ালি কেউ কোনো খোঁজ নেননি।
তবে হ্যাঁ, দেশ বিদেশের অসংখ্য চিকিৎসক বন্ধু বান্ধব খোঁজ নিয়েছেন, তাঁদের ভালোবাসায় আমরা ভীষণভাবে আপ্লুত ও কৃতজ্ঞ।
অনেক কোভিড পজিটিভ চিকিৎসকও ফোন করে পরামর্শ চেয়েছেন। আমাদের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে সাহায্য করতে চেষ্টা করেছি এবং সবসময় করবো।
ঢাকার ডাক্তারদের টেস্ট করার জন্য বিএসএমএমইউ সবচেয়ে সহজ, ডিএমসিও করতে পারেন। তবে দুজায়গাতেই গিয়ে দিয়ে আসতে হয়। আইইডিসিআর বাসায় এসে নিয়ে যায় কিন্তুু এখানে অনেক দেরি হয় আসতে।
বিএসএমএমইউ রেজাল্ট মোবাইলয়ে এসমএস এর মাধ্যমে জানায়,আইইডিসিআর জানায় ইমেইলে।
আরেকটা ব্যাপার অনেকেই কোভিড পজিটিভ হওয়ায় প্রতিবেশী বা এলাকাবাসী দ্বারা হেনস্তা হচ্ছেন। আমার ক্ষেত্রে সেরকম হয়নি। ফ্ল্যাটের সবাইকে ফোন করে বলেছি মীরা পজিটিভ, তাই আমরা কোয়ারান্টাইন এ আছি। দুয়েকজন ছাড়া সবাই পজিটিভলি নিয়েছেন। নিচে সুপারস্টোর থাকায় খাবার দাবার, ওষুধ পেতে সমস্যা হচ্ছে না।
৮০% কোভিড পজিটিভ রোগী অল্প সিম্পটম নিয়ে ভালো হয়ে যায়। দোয়া করুন যাতে মীরার তাই হয়। ৭ দিন পর আবার আরটি পিসিআর করার কথা, তখন নেগেটিভ হলে ৩ দিন পর আবার। দুবার নেগেটিভ হলে রোগটি নাই বলা হয়। তবে ৭ দিন পরও পজিটিভ আসলে ৭ দিন পরপর টেস্ট চলতে থাকে। কারো ক্ষেত্রে নেগেটিভ হতে ৩৫ দিন পর্যন্ত লাগে বলে শুনেছি।
সবাই ভালো থাকুন,কোভিড মানেই আইসিইউ, হাসপাতাল ভর্তি বা ভেন্টিলেটর নয়। নয় পারিবারিক বা সামাজিক ভাবে অচ্ছুৎ হওয়া।
মূল লেখক: রাসেল চৌধুরী
অনুলিখন: সিলভিয়া মীম