প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৭ এপ্রিল ২০২০, সোমবার:
ডা. বে-নজির আহমেদ
গণস্বাস্থ্যের কিট ব্যবহারের পক্ষে বিপক্ষে বেশ শক্ত গ্রুপ লক্ষ্য করা যাইতেছে। একদল এই কিটের প্রবল সমর্থক এবং সরকার ইহাকে যথাযথ গুরুত্ব দিতেছে না বলিয়া তুলেধুনো করিতেছে, অন্যদল ইহার ঘোর বিরোধী এবং বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সহ ইহার অকার্যকারিতা প্রমাণে বদ্ধপরিকর। এমনকি বিজ্ঞান ল্যাব হইয়া ইহার রাজনৈতিক আনুগত্য লইয়াও বাদানুবাদ চলিতেছে। পঁচিশ বছরের অধিককাল ল্যাব মেডিসিন লইয়া কাজ করিতেছি; পড়াইয়াছি, পড়িয়াছি, গবেষণা করিয়াছি, প্রয়োগ করিয়াছি, ল্যাবরেটরি রিপোর্ট করিয়াছি। তাহার পরেও করোনা পরীক্ষা লইয়া যে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার কালবৈশাখী চলিতেছে, তাহাতে বৃক্ষ শাখা প্রশাখা পত্রপল্লবের আড়ালে লুকাইয়া থাকিতেই নিরাপদ বোধ করিতেছিলাম। কি বলিতে কি বলিয়া ফেলি, শেষে লোটা কম্বল ফেলিয়া পলাইতে হয়। তবে শেষ পর্যন্ত কিছু সুহৃদ আর নিজের আবেগের কাছে লোটা কম্বল হেফাজতে রাখিয়া কম্পিত হৃদয়ে কিছু লিপিবদ্ধ করিবার মনস্থ করিলাম।
করোনা রোগ শনাক্তকরণ দুইভাবে হইতে পারে: প্রত্যক্ষভাবে এবং পরোক্ষ ভাবে। পিসিআর একটি প্রত্যক্ষ পদ্ধতি, যাহাতে সরাসরি ভাইরাসটি প্রত্যক্ষ করা না গেলেও ইহার নিউক্লিক এসিড পিসিআর মেশিনের মাধ্যমে বহু সংখ্যায় বৃদ্ধি করিয়া নিদর্শন করা যায়। করোনা সংক্রমন শনাক্তে এক অর্থে ইহার চাইতে সুদক্ষ পদ্ধতি আর নাই। তবে প্রযুক্তি যত উন্নত আর উত্তম হউক না কেন, টাইটানিক জাহাজ যেরূপ কোনদিনও নিমজ্জিত হইবে না বলিয়া দাবির বিপরীতে প্রথম যাত্রায়ই তলাইয়া যায়, সেই রূপ না হইলেও এই পিসিআর মেশিন পরীক্ষাতেও ভ্রম হইতে পারে। কোম্পানী ভেদে একদিকে যেইরূপ অধম মধ্যম উত্তম পিসিআর মেশিন আছে, সেইরূপ ইহার কিটের উত্তম অধম প্রকারভেদ আছে। বিশেষত করোনা সনাক্তে যে প্রাইমার বা ছাঁচটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ; ইহা যুৎসই না হইলে শনাক্তের হার কমিয়া যাইবে, ভুল শনাক্তের হার বাড়িয়া যাইবে। ইহা ছাড়া সঠিক বা শ্রেয়তর নমুনার বিষয়টিও আছে; শ্বাসনালীর গভীর হইতে সংগৃহীত নমুনায় যেরূপ বেশী হারে পাইবার সম্ভাবনা, নাক বা মুখ হইতে সংগৃহীত নমুনায় তাহার চাইতে শনাক্তের হার কম হইবে। Man behind the machine সর্বোপরি নির্ধারক ভূমিকা পালন করিবে, প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ব্যতিরেকে সকলই ভন্ডুল।
করোনার অপ্রত্যক্ষ পরীক্ষা হইতেছে, এন্টিবডি পরীক্ষা; যাহা সংক্রমনের কারণে শরীর তৈয়ার করিয়া থাকে। গড়ে এই এন্টিবডি তৈয়ার হইতে এক সপ্তাহ লাগে এবং এন্টিবডি উৎপাদনের মাত্রা ও পরীক্ষা পদ্ধতির উপর নির্ভর করিয়া সনাক্তের সময় ও হার নির্ধারিত হইয়া থাকে। খুনের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী থাকিলে যেইরূপ বিচারকের রায় দেয়া সহজ হয়, আর অপ্রত্যক্ষ নিদর্শনে আসামী নির্দোষ বা লঘু শাস্তি পায়, অপ্রত্যক্ষ এন্টিবডি টেস্টের অবস্থাও তদ্রূপ। ইহার সাক্ষ্য প্রত্যক্ষ পদ্ধতি পিসিআরের চাইতে কম। এন্টিবডি শনাক্তে কোম্পানিসমূহ এন্টিজেন তৈয়ার করিয়া থাকেন এবং তাহার মানের উপর রোগ শনাক্তের হার ও মান নির্ভর করে। এন্টিবডি শনাক্তের বহুত পদ্ধতি আছে, তাহাদের মধ্যে Immuno Chromatography Test (ICT) বা সহজ ভাবে যাহাকে আমরা Rapid Diagnostic Test (RDT) বা রেপিড টেস্ট বলা হইয়া থাকে। স্ট্রিট পদ্ধতি দ্বারা ইহা করা হয় বলিয়া ইহা স্ট্রিপ টেস্ট রূপেও পরিচিত। এন্টিবডি টেস্ট দেরীতে রোগ শনাক্ত করিতে পারে এবং ইহার শনাক্তের হারও কম বলিয়া, বহু দেশ রেপিড টেস্টের উপর ভরসা করিতে পারিতেছে না।
যতটুকু সমঝাইতে পারিয়াছি মিডিয়া রিপোর্ট হইতে, গণস্বাস্থ্য প্রস্তুতকৃত পদ্ধতিটি এন্টিবডি সনাক্তকরণ একটি পদ্ধতি হইতে পারে। ইহা আহামরি কোন আবিষ্কার নহে, দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ কোম্পানী এইরূপ টেস্ট হর হামেশা বানাইয়া থাকে। তবে দেশের একটি কোম্পানী করোনার এই দুর্যোগে যে এই পরীক্ষাটি দেশেই বানাইতে উদ্যোগ গ্রহন করিয়াছে, তাহাতে আমাদিগকে সর্বাত্নক সমর্থন ও সহযোগিতা করা আবশ্যক। কিছু দুর্বলতা থাকিলেও তাহার উন্নয়নে সহায়তা দেওয়া এবং তাহা ব্যবহারের ক্ষেত্র নির্ধারণ আবশ্যক। পক্ষে বিপক্ষে না যাইয়া, নিরপেক্ষ দৃষ্টি ভঙ্গি লইয়া আগাইয়া আসা উচিত। বর্তমান পেরে পাটে আমাদের মূলত: পিসিআরের উপর নির্ভর করিতে হইবে, পাশাপাশি অন্যান্য পরীক্ষা প্রচলনের জন্য সবকটা জানালা খোলা রাখিতে হবে।
পুনশ্চ: এই লেখা লিখিবার পর শুনিলাম গণস্বাস্থ্য এন্টিজেন ডিটেকশনের কিটও তৈরী করেছে, সেক্ষেত্রে তাদের তৈরী দুইটি কিটের কার্যক্ষেত্র বৃদ্ধি হইবে।