করোনা পরিস্থিতি এবং একজন ডাক্তারের দীর্ঘশ্বাস

লিখেছেন ডা. আমিরুজ্জামান মোহাম্মদ শামসুল আরেফিন

২৯শে মার্চ,২০২০

“ইয়েস আই কুইট অ্যাজ এ কাওয়ার্ড।

বাবামায়ের কাছ থেকে দুআ নিয়ে অনেক আশা নিয়ে এবার গিয়েছিলাম কর্মস্থলে। ভেবেছিলাম সর্দিকাশির রোগী কেউ না দেখলেও আমি দেখব। বলব একটা কর্ণার করতে, সেখানে করোনা সিম্পটমের রুগীদের পাঠাতে। পিপিই পরে আমি দেখব তাদেরকে, আর কেউ না দেখুক। আমার ধারণা ছিল না পরিস্থিতি এতটা খারাপ।
১. গত ২৪ তারিখ দুইজন রোগী, যাদের আগের কোনো শ্বাসকষ্টের হিস্ট্রি নাই। এসে মারা গেল হাসপাতালের ইমার্জেন্সির ভিতর। যে রুমে আমাদের ডিউটি করতে হয় পিপিই ছাড়া। তাদের শেষ নিঃশ্বাসগুলো মিশে রইল ঘরের বাতাসে। কলিগরা উপরে জানানোর আগেই রুগীর স্বজন নিয়ে গেল লাশ, স্বাভাবিক দাফন হল, যেন কিছুই হয়নি। সেই দুজন রুগীকে যারা ধরেছে, তাদের সাথেই সবাই ডিউটি করছি, যেন কিছুই হয়নি।
২. উপরের নির্দেশ, করোনা রোগী সাসপেক্টকে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে। সব ডাক্তারকে রোস্টার-ওয়াইজ সেখানে ডিউটি করতে হবে। সুরক্ষা? ৫টা পিপিই। সেগুলো যে দায়িত্বে থাকবে, সে পরবে। একজনেরটা আরেকজন। হোয়াট?
৩. উপর থেকে নির্দেশ, ডাক্তারদের কোনো ছুটি দেয়া যাবে না। মানে ছুটি সম্ভব না।
৪. ৩ বছর বয়স থেকে আমি এ্যাজমা রোগী। এখনও পকেটে রিলিভার নিয়ে ঘুরি। প্রতি শীতে খাই স্টেরয়েড।
৫. কীসের আশায় মরব আমি? আমি মরলে আমার ৩ বছরের মেয়েকে কী দিচ্ছে সরকার? কোনো ইনসওরেন্স? কোনো প্রণোদনা? কোনো ঝুঁকি ভাতা। আমি একটা বেতনের বিনিময়ে চাকরি করতে এসেছি। জান সওদা করতে না। কমপক্ষে আমার পরিবারের জান সওদা করতে তো নয়-ই।

তাহলে দেশসেবা, জনসেবা, এগুলোর কোনো দাম নেই?
কেন থাকবে না। আলবাত আছে।
১. একটা উপজেলা হাসপাতালে করোনা রোগীকে কতটুকু সেবা দেয়া যায়? ভেন্টিলেটর? কোনো ওষুধ আছে করোনার? কিচ্ছু নেই। সেই শেষমেশ খারাপ রুগী রেফারই করব। মাঝখান থেকে এঁটো পিপিই পরে রুগীকে ছেনে ভাইরাসটা নিয়ে নিলাম। ঘরে গিয়ে বউবাচ্চাকে বৃদ্ধ মা-বাবাকে উপহার দিলাম। এই সামান্য সেবাটুকু দেয়ার জন্য ভর্তি? কেন?
২. কারো অব্যবস্থাপনার দায় নেয়ার নাম জনসেবা না। কোনো বিশেষ দলের ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখার জন্য আমি জীবন দিতে পারবো না। আমার পরিবারকে জীবন দেয়াতে পারব না। হাজার হাজার কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। তিনমাসে সামান্যতম ব্যবস্থাটুকু নেয়া গেলনা? এখন পলিসি করে নার্স-ডাক্তারদের খালিহাতে অবস্থায় যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে? রুগী মরা শুরু হয়েছে, মানে ডাক্তার-নার্স এখন আক্রান্ত হবে। ২-১৪ দিন পর দেখেন স্বাস্থ্যসৈনিকদের কী অবস্থা দাঁড়ায়। দেশের জন্য জীবন দেব, ধর্মের জন্য দেব। কোনো দল/গোষ্ঠীর জন্য দিতে রাজি নই।
৩. একের পর এক প্রস্তুতি নিয়ে, পরিসংখ্যান নিয়ে যে মিথ্যা তথ্য দেয়া হচ্ছে, এটা সবাই বুঝছে। কিন্তু কেউ কিছু বলবে না। এর চেয়ে ভালো একা সেলফ কোয়ারেন্টাইনে থাকা। মনের উপর চাপ কম পড়ে।

খবরটা নিয়ে :
১. বৃহঃবার আমার কোনো ইমার্জেন্সি ডিউটি ছিল না। ইমার্জেন্সি ডিউটি ফেলে আসার মত অত দায়িত্বজ্ঞানহীন হইনি এখনও। আমার ইমার্জেন্সি শুধু মঙ্গল আর বুধ। আমার বস কেন এমন কথা বললেন, বুঝলাম না।
২. যে দুটা রুগী মরেছে, তাদের একটা রেজা ভাই দেখেছিলেন তিনদিন আগে জ্বর কাশি নিয়ে। তিনি কাউকে জানান নাই। কেন এটা করলেন, তিনিই জানেন।
৩. আর আমি পূর্বে দায়িত্বে অবহেলা করেছি এমন কোনো রেকর্ড নাই। হাসপাতাল এলাকার যেকোনো মানুষ, ভ্যানওয়ালা, দোকানদার, আমার কলিগ নার্স-স্যাকমো-ডাক্তার সবাই জানে। কাকে ফোন দিয়ে পাওয়া যায় না সেটা সবাই জানে।

চুপচাপ চলে এসেছিলাম। যাতে অন্য ডাক্তাররা কম জানে। জানলে প্যানিকড হবে। ভেবেছিলাম চুপচাপই থাকবে। কিন্তু জানিনা কার ইন্ধনে খবর চাউর হল। তাই আমিও আত্মপক্ষ সমর্থন করলাম।

গ্রামের বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে আছি। সবার থেকে দূরে, একা। থানা থেকে একজন এসআই এসে দেখে গেছেন। এখন পর্যন্ত ভালোই আছি। রিজিক নিয়ে পেরেশান নই। আল্লাহ উত্তম কোনো ব্যবস্থা করবেন।

ডাক্তার-নার্সদের উদ্দেশ্যে:
আপনারা সেবা দেন। জাতির এখন আপনাদের দরকার। আমার অত সাহস নেই। আপনারা আসলেই মহামানব। যে দেশে দুধ আর পানির দাম সমান, সে দেশের মানুষ আপনাদের দাম দেবে সে আশায় থাকবেন না। আপনাদের প্রতি আমার স্যালুট। নিজের প্রতি ধিক্কার।

সবার উদ্দেশ্যে:
ঘরে থাকেন। এই অসময়ে অজায়গায় আর কিছু করার নাই। দান চালা হয়ে গেছে।”

উল্লেখ্য যে উক্ত চিকিৎসক তাঁর ব্যাপারে একাধিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও দৈনিকে খবর প্রকাশিত হলে এই লেখাটি প্রকাশ করেন।

ডা. সজীব কুমার ঘোষ
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ
সেশন ২০১৪-১৫

Publisher

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯: লক্ষ্মীপুরে কর্মহীন মানুষের পাশে মাদ্রাসার ছাত্রগণ

Sun Mar 29 , 2020
২৯ মার্চ ২০২০: কোভিড-১৯ মহামারি রোধে একে একে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, বিপণিবিতান, খাবারের রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। পুরোপুরি লকডাউন করে দেয়া হয়েছে বেশ কিছু এলাকা। এতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কম হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কর্মহীন হয়ে পড়েছে দেশের হাজার হাজার মানুষ। এই কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমজীবী মানুষের পাশে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo