প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৭ জুন ২০২০, বুধবার
অধ্যাপক ডা. মওদুদ আলমগীর পাভেল
অধ্যাপক (সার্জারী), টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ, বগুড়া
প্রাক্তন অধ্যক্ষ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া এবং দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর
সাবেক সভাপতি, সোসাইটি অব সার্জনস অব বাংলাদেশ
করোনা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা।
এসো “ব” কে “সা” শেখাই।
“ব”- তে বদভ্যাস,
“সা”- তে সাবধানতা।
প্রায়ই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হই। আপনারা যে সারাক্ষণ সুরক্ষা, মাস্ক, হাত ধোয়া নিয়ে টিভির পর্দা গরম করছেন। লকডাউন, রেড জোন, শারীরিক দূরত্ব বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলছেন। শুনছে কেউ? সারাক্ষণই তো শুনছি অমুক বিখ্যাত ব্যক্তি করোনায় নাই হয়ে গেছেন, তমুক নমস্য মানুষ ভেন্টিলেটরে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছেন। আর ঐ দেখেন বাজার ভর্তি মানুষ, ভীড়ে হুটোপুটি। রাস্তার দৃশ্য দেখলে বিশ্বাস হবে কারো যে, করোনা বলে সত্যিই কিছু আছে? মাস্কপরা তো দূরে থাক, সাবানেরও ধার ধারে না। বাড়িতে মার্কিন কাপড়ের মাস্ক একটা আছে তবে সেটা এজমালি। বাবা বাইরে যাবার সময় থুতনিতে ঝুলিয়ে যান। বিকেলে ছেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডার সময় ঐ একই মাস্ক হাতে ঝুলিয়ে যায়, পুলিশ দেখলে পরার ভান করে। ছেলে ফিরলে মা পান চিবুতে চিবুতে ঐ একই মাস্ক কানে ঝুলিয়ে পাড়া বেরাতে বের হয়। মাস্কটা বেশ টেকসই, দুই মাস হলো, ছেড়ে নি, শুধু একটু গন্ধ হয়েছে এই যা।
কৈ করোনা তো এদের কাছেও ঘেঁষে না। ছয় ফুটের সামাজিক দূরত্ব? আরে একটাই মাত্র ঘর, দশ ফুট বাই দশ ফুট, থাকে ছয়জন মানুষ। দূরত্ব মানলে তো ঘরের বাইরে থাকতে হয়। সাবান দিয়ে হাত ধোয়া? সারা সপ্তাহে গায়ে সাবান দেয় বড়জোর একবার, বার বার হাত ধোয়া, তাও আবার বিশ সেকেন্ড ধরে! পাগল নাকি। এসব কিছুকেই সারাক্ষণ বুড়ো আংগুল দেখাচ্ছে ওরা। না মানা যদি এতটা ভয়াবহ হয়, তাহলে করোনায় তো লাখ লাখ মানুষের উজাড় হবার কথা। কৈ ওরা তো দিব্যি আছে কিছু না মেনেই, আর আপনারা এত মেনেও, ঠেকাতে পারলেন কিছু। তাবড়-তাবড় ডাক্তার, ব্যবসায়ী, শিল্প পতি মারা যাচ্ছেন এক ধাক্কাতেই টপাটপ। অক্সিজেন, আইসিইউ, দামী দামী ঔষধপত্র, আসলো কোন কাজে? গরীবের কিছুই হবে না।
এসব এড়েঁ তর্ক আর কূট যুক্তির পাল্টা যুক্তি দেয়ার পরিস্থিতি আর সময় এখন নয়।
করোনা নিয়ে আমি আমার সহকর্মীদের একটা কথা প্রায়ই বলি,
“করোনা প্রানঘাতী সড়ক দূর্ঘটনার মত। নিজের শরীরকে ভূল ভাবে চালালে যেমন দূর্ঘটনা ঘটতে পারে, তেমনি অন্য শরীরের ড্রাইভার তার শরীর ভূলভাবে চালালেও দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে বাচতে হলে দুই ড্রাইভারকেই সাবধানে গাড়ী চালাতে হবে। আমার গাড়ী ঠিক ঠাক চালালেই আমি বেঁচে যাব, এমন ভাবলেই খবর আছে।”
আর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষিত ব্যক্তিগণ সচেতনতার গাড়ী ঠিক ভাবেই চালায়।
সমস্যা “ব” তত্ত্ব নিয়ে —
ব – বেকুব – কোন সতর্কতা নেই, কিছু বললে হাসে। মাস্ক নেই।
ব- বলদ – হাসার সাথে নাকের ভিতরে আঙুল দেয়।
ব- বোরকা – বোরকাটাকে মাকস(!)ও লেভেল ৩ পিপিই হিসেবে ব্যবহার করে।
ব – বাচাল – মাস্ক না পরার কারন ব্যাখ্যা করে।
ব- বাহাদুর – করোনা আমাগো ধরবো না।
ব- বেহায়া – নাকের সিকনি কাপড়ে ঘষে।
ব – বেশরম- বার বার শব্দ করে নাক ঝাড়ে।
ব- বেখেয়াল – মাস্ক থুতনিতে লটকায়।
ব- বদ – কথা বলার সময় একটানে মাস্ক সরায়, আর অন্যের মুখের কাছে গিয়ে কথা বলে।
ব – বখাটে – অন্যে মাস্ক পরলে টিটকারি মারে।
ব – বদমাস – মাস্কের তলা দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে নাক মুখ চুলকিয়ে লুঙ্গি বা প্যান্টের পিছনে মোছে।
ব – বিশ্বাসহীন – মেসওয়াক করতে করতে মাটিতে থুতু ফেলে বলে করোনা এই এলাকায় আইবো না।
ব – বিবেচনাহীন – হাত ধোয় না, মাস্কও পড়ে না। হ্যান্ডসেক/কোলাকুলি করতে চায়।
ব – বেআক্কেল – দশ মিনিট করোনা সতর্কতার বক্তৃতা শোনার পর দাত বের করে হাসে।
সতর্কতা ১- একটি ‘ব’ এর সামনে পড়লে- হলুদ চিহ্ন – এ্যাকশন -সাবধান।
সতর্কতা ২ – দুটো ‘ব’ একসাথে দেখলে- কমলা চিহ্ন – এ্যাকশন -ঘুরে দাঁড়াও, তৈরী থাক। আশপাশের রাস্তা ফাকা কি না দেখ।
সতর্কতা ৩ – তিনটা ‘ব’ এর মাঝে পড়লে – লাল চিহ্ন, এ্যাকশন – ঘুরেই মারো দৌড় ।
সতর্কতা ৪ – চার বা ততোধিক ‘ব’ এ একসাথে ঘেরাও হলে – কিছুই করার নাই। চিহ্ন কালো। এ্যাকশন – দোয়া- দরূদ। সাথে সাথে কোভিড পিসিআর টেস্টের জন্য অনলাইনে ফরম পূরণ। কপালে থাকলে তিন দিন পরে টেস্ট।
তাই কোন কূট আর এড়েঁ তর্ক নয়। আসুন সবাই সাবধান হই। ‘ব’ এর হিসাবটাকে “সা” এর হিসাবে পাল্টে দিই, সব “ব” দের “সা” শেখাই।
“সা”- সাবধান-সব “ব” দের সাবধান আর সচেতন করি।
“সা” – সাবান – সাবান দিয়ে নিজে হাত ধুই, অন্যকে ধুতে বলি।
“সা” – সারাক্ষণ – সারাক্ষণ মাস্ক পরি। নিজে পরি, অন্যকে পরতে বলি।
“সা” – সামাজিক – সামাজিক দূরত্ব মেনে চলি, বাজার- সমাবেশ এড়িয়ে চলি।
“সা” – স্বাস্থ্য – স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলি।
আসুন আমরা “সা” এর অনুসারীরা সোচ্চার হই, সব “ব” কে “সা” এর দলে সমবেত করি। ফেসবুকের দেয়াল, ভাইবার, হোটাসএ্যাপের পোস্ট, পত্রিকার পাতা, রাস্তার মোড়, হাট বাজারের গলি, যান-বাহনের গা “সা” এ সাবান, “সা” এ সারাক্ষণ মাস্ক, “সা” এ সাবধান, “সা” এ স্বাস্থ্যবিধি লেখা পোস্টার আর দেয়াল লিখনে আমাদের তরুণ বন্ধুদের সৃজনশীল উদ্ভাবনের প্রবল বন্যা দেখতে চাই। এই মৃত্যু মিছিল আর অক্সিজেন হাহাকারের সমাপ্তি দেখতে চাই। শিশুদের কোলাহলে আবার প্রাণোচ্ছল দেখতে চাই ধুলো জমা বিদ্যালয়কে, টিএসসি শাহবাগ চত্বরে তারুণ্যের উচ্ছাস দেখতে চাই, বিপনী বিতানে স্বচ্ছন্দ নিরাপদ কোলাহল দেখতে চাই, রমনার সবুজ গালিচায় প্রাতঃভ্রমণের পদচিহ্ন দেখতে চাই, শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে টাইগারদের বিজয়ের সোচ্চার সাক্ষী হতে চাই, বন্ধুর বিয়ের বরযাত্রী হতে চাই, এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিনে বৃষ্টি কাদায় কিম্ভূতকিমাকার হতে চাই, বসুন্ধরার সিঁড়িতে বসে আইসক্রিমের কাঠি চুষতে চাই, পহেলা বৈশাখের কাক ডাকা ভোরে লাল পান্জাবীতে রমনা বটমূলে হাজার ভক্তের ভীড়ে একাকার হতে চাই, চৈত্রের তৃষার্ত হাসফাস সন্ধায় চকবাজারের লছছি- ফালুদায় আকন্ঠ হতে চাই, ফেব্রুয়ারির পড়ন্ত বিকেলে বাংলা একাডেমির বইমেলায় নতুন বইয়ের সুঘ্রাণ নিতে চাই, নিভু নিভু সন্ধ্যায় নীলক্ষেতের ফুটপাতে তেঁতুল গোলা ফুচকা খেতে চাই, কোয়ারেনটাইন- আইসোলেসন ভেঙে প্রিয়তমা আর সন্তানকে উষ্ণ আলিঙ্গন করতে চাই, পিপিই- মাস্ক ছুড়ে ফেলে মুক্ত বাতাসে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। মুখোশের আড়াল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাই। ডিসেম্বরের গোধূলী বেলায় কক্সবাজারের সৈকতে রক্ত গোলা সূর্যাস্ত দেখতে চাই, সুন্দরবনে কটকা হিরণ পয়েন্টে গোল পাতার আড়ালে লুকানো হরিন শাবকের মায়া জড়ানো চকিত চাহনি দেখতে চাই, জুমার জামাতে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে মুসল্লীদের সাথে দাড়াতে চাই, জানাযার নামাজে প্রিয়জনকে অশ্রু সজল বিদায় জানাতে চাই, ঈদের জামাত শেষে বন্ধুর সাথে কোলাকুলি করতে চাই। শারদ উৎসবে মন্ডপের সামনে পূন্যার্থীদের ভীড় দেখতে চাই, দুঃসহ বন্দীত্ব থেকে মুক্তি চাই। ক্ষুদ্রাতিখুদ্র করোনার বিষ নিঃশ্বাস থেকে মুক্তি চাই। প্রাণভরে আমার না দেখা বাংলাদেশ দেখতে চাই, নিযুত মানুষের সমাবেশে চিৎকার করে বলতে চাই “কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা”।
প্রতিদিন এত এত প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ শোনা থেকে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ আমাদের পরিত্রাণ দাও।