প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১২ নভেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাব এর নয় মাস পার হতে চলল। চীন থেকে উদ্ভূত এই ভাইরাসটি বাংলাদেশে আসতে সময় নিয়েছে প্রায় তিন মাস। ভাইরাসের এই করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের তোড়জোর চলছে করোনা আবির্ভাবের পর থেকেই। সম্প্রতি বাংলাদেশ নাম লিখিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, দ্য কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সিইপআই) ও দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স (গ্যাভি) এর যৌথ সংগঠন “কোভ্যাক্স”এ।
কোভ্যাক্স একটি যৌথ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ যেখানে, আর্থিক ও বৈজ্ঞানিক সম্পদ ব্যবহারের পাশাপাশি ধনী দেশগুলোকে একত্রিত করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কোভ্যাক্সের মাধ্যমে নিরাপদ ও কার্যকর অন্তত তিনটি টিকা তৈরি করে উদ্যোগের আওতায় থাকা দেশগুলোকে তা সরবরাহ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি দেশ জড়িত কোভ্যাক্সে।কোভ্যাক্স উদ্যোগের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে ২০০ কোটি ডোজ নিরাপদ ও কার্যকর টিকা সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কোভ্যাক্স এর লক্ষ্য – কোভিড-১৯ নির্ণয় ও চিকিৎসা, ভ্যাকসিনের উদ্ভাবন এবং ভ্যাকসিন সরবরাহের লক্ষ্যে সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, উৎপাদনকারী, বেসরকারী খাত, নাগরিক সমাজ এবং জনহিতকর কার্যক্রমকে একত্রিত করা।
বাংলাদেশের করোনা ভ্যাকসিন এবং সার্বিক অবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগ এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব(স্বপ্নীল) বলেন, “কোভিডের দ্বিতীয় ধাক্কাটা আসি আসি করতে করতে শেষমেষ এসেই গেল। ইউরোপে ধাক্কাটা জোরে সোরেই লেগেছে। লকডাউন আর কার্ফিউতে এখন জর্জরিত ইউরোপের অনেক দেশ। কোভিড বাড়ছে ঘরের পাশে ভারতেও। বিশেষ করে ভারতের শীতপ্রধান এলাকাগুলোয়। বাংলাদেশেও বাড়ার ইঙ্গিতগুলো স্পষ্ট। হাসপাতালগুলোয় একটু একটু করে বাড়ছে রোগী, বিশেষ করে খারাপ রোগী। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রথম ধাক্কার মতো এবারও আমাদের হাতে সময় আছে কিছুটা। সরকারি পর্যায়ে যে উদ্যোগগুলো, সেগুলো যথেষ্ট আশা জাগানিয়া। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’টি। একটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ পলিসি গ্রহণ, আর দ্বিতীয়টি ভ্যাকসিনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি।
ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই তিনটি দেশই জি-টু-জি ভিত্তিতে তাদের ভ্যাকসিনে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা জানিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এদের যে কারো একটি ভ্যাকসিন অনুমোদন পেলেই আমরা তার কিছুটা ভাগ পাব। আমাদের সরকার এরই মাঝে নাম লিখিয়েছেন কোভ্যাক্স-এ। সেখান থেকেও পাওয়া যাবে বেশ কিছু ভ্যাকসিন। সরকারিভাবে রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিটি অর্জিত হয়েছে এ মাসের ৬ তারিখে। ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের তৈরি অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি দেশে আনার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সমঝোতাটি এদিন স্বাক্ষরিত হয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয়ে। জানা যাচ্ছে সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ার স্থানীয় প্রতিনিধি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস আগামী জানুয়ারি মাস থেকে প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ করে মোট তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে। যেহেতু ২৮ দিনের ব্যবধানে দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেয়ার প্রয়োজন পড়বে সেই হিসাবে দেড় কোটি মানুষ এ থেকে উপকৃত হবেন। নামমাত্র সার্ভিস চার্জ প্রদান করে সরকারিভাবে এই টিকা নেয়ার সুযোগ পাবেন দেশের চিকিৎসকসহ অন্যান্য ফ্রন্টলাইনাররা। নানা কারণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। দেশের ওষুধ শিল্পের অন্যতম পুরোধা প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস আরও একবার অভিনন্দনের দাবিদার। করোনাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিপিই রপ্তানি করে আর বাংলাদেশের বাজারে প্রথমবারের মত রেমডিসিভির নিয়ে আসার কৃতিত্ব তাদের। সেই তালিকায় এবার যুক্ত হলো দেশের মানুষের জন্য সবার আগে ভ্যাকসিন নিয়ে আসার বিষয়টিও। জানা যাচ্ছে ভারত এবং বাংলাদেশ, এই দু’দেশের সরকারই একই দাম, অর্থাৎ পাঁচ থেকে ছয় ডলারে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন পাবে। একই দাম নির্ধারণ করাটাও নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। পাশাপাশি জানা গিয়েছে বেসরকারিভাবেও বেক্সিমকোর উদ্যোগে পাওয়া যাবে ভ্যাকসিনটি। ফলে বঞ্চিত হবেন না দেশের সাধারণ মানুষও। অক্সফোর্ডে ভ্যাকসিনটি নানা কারণেই ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দের তালিকায় উপরের দিকে। প্রথম কারণটি অবশ্যই ‘অক্সফোর্ড’। বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাপকাঠি এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। একসময় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছেছিল তখন তাকে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’-ই বলা হতো। এই ভ্যাকসিন ট্রায়ালের ব্যাপারেও অক্সফোর্ডের সতর্কতার জায়গাটি আমরা দেখেছি। ট্রায়ালে অংশ নেয়া একজন ভলান্টিয়ারের সাইড এফেক্ট দেখা দিলে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল পুরো ট্রায়ালটি। পরে জানা যায় তিনি সুস্থ রয়েছেন। পরে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে ট্রায়ালটি আবার শুরু হয়। কাজেই ভ্যাকসিনটি যে নিরাপদ আর অক্সফোর্ডও যে সতর্কতায় কোনো ঘাটতি রাখছে না তা বলা যেতেই পারে। তাছাড়া আমাদের দেশে ইপিআই কর্মসূচির আওতায় যে ভ্যাকসিন অবকাঠামো আছে সেটি ব্যবহার করেই সারা দেশে এই ভ্যাকসিনটির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যাবে। এজন্য নতুন করে কোনো অবকাঠামো ডেভলপ করার প্রয়োজন পড়বে না।
পাশাপাশি ভ্যাকসিনটির উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া শুধু ভারতেরই নয়, এটি বিশ্বেরও বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। বছরে তারা ১৫০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা রাখে আর বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর ১৭০ টি দেশের ইপিআই প্রোগ্রামে যেসব ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয় তার বেশিরভাগটাই আসে এখান থেকে। আসারই কথা, কারণ বর্তমান বিশ্বে ব্যবহৃত টিকার দুই তৃতীয়াংশ ভ্যাকসিন উৎপাদন করে সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া। ভ্যাকসিন গবেষণায় ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। র্যাবিশিল্ট নামের এন্টি- র্যাবিস হিউম্যান মনোক্লোনাল এন্টিবডিটি সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স মেডিকেল স্কুল যৌথভাবে উদ্ভাবন করে। এছাড়াও তারা একটা ইন্ট্রান্যাজাল সোয়াইন ফ্লু ভ্যাকসিন নিয়েও গবেষণা করছে। প্রতিষ্ঠানটি দশ কোটি ডোজ অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ। ইউএস এফডিএ অনুমোদিত ভারতের পুনের এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সালে হল্যান্ডের বিখ্যাত বেটোফেন বায়োলজিক্যাল অধিগ্রহণ করে।
এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন নিয়ে আমদের প্রস্তুতির যে অগ্রগতি তা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসছে বেসরকারি খাতও। আলোচনায় আছে দেশে উদ্ভাবিত গ্লোব বায়োটেক-এর ভ্যাকসিনও। আশা করা যায় সামনে আমরা দেশেই দেশের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের খবর পাবো। আমাদের ‘নিউ নরম্যালটাকে’ আমরা কত তাড়াতাড়ি ‘ওল্ড নরম্যালে’ নিয়ে যেতে পারি এখন শুধু তার অপেক্ষা।”