প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৩ জুন, ২০২০, মঙ্গলবার
প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার
একাদশ ব্যাচ,
শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম), বরিশাল
রোগীদের সেবার অভিজ্ঞতা নিয়েই চলেছি এতোদিন৷ রোগীর মন কেমন হয় – বিশেষ করে কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের তা জানা ছিল না৷ আজ নিজে এই খাঁচায় আটকা পড়ে বুঝতে পেরেছি, টের পাচ্ছি কতটা মানসিক পীড়ন ধাপে ধাপে লুকিয়ে আছে!
আমি ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি গত ১৬ জুন, ২০২০ তারিখ৷ আমাকে ফিভার ক্লিনিক থেকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি কি ভর্তি হব না বাসায় থাকবো!
ব্রিগেডিয়ার মুঈদ, ব্রিগেডিয়ার জহির, কর্নেল মারুফ সবাই ভর্তি হয়ে যেতে অনুরোধ করলো৷ সদ্য সমাপ্ত অফিসার কেবিন ব্লককে করোনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে৷ ব্রিগেডিয়ার তৌফিককে ছোট একটা টেক্সট করে জানিয়ে রাখলাম – ভর্তি হয়েছি৷ সে জানে বলে আমায় আশ্বস্ত করে এবং কোন অসুবিধা হলে জানাতে অনুরোধ করে৷
আমার কেবিন সাত তলায়, ৭০৯৷
সেদিন নাকি ৮৫ থেকে হঠাৎ করেই রোগী বেড়ে গেছে ১২০ এর কোঠায়৷ কারো সাথে কারো দেখা নেই – যে যার রুমে আছে৷ আমার শারীরিক অবস্থা আল্লাহর ইচ্ছায় ভালো থাকার কারণে অন্য চিন্তার বাড়তি সুযোগ পাই৷ তার মধ্যে প্রথমেই এই হাসপাতালের সাথে আমার জড়িয়ে থাকা সেই পুরানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে৷ ৯১-৯৬ খ্রিস্টাব্দ৷ মাঝখানে আড়াইবছর তখনকার পিজিতে ছিলাম; ডিপ্লোমা ডিগ্রি ও এফসিপিএস পার্ট ওয়ানের জন্য৷
এই মুহূর্তে আমি শুক্রবারের আজানের সাথে ঝড় ঝড় বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছি৷ বারান্দায় দাঁড়ালেই পুব দিকের অফিসার্স ওয়ার্ড, বিশাল সৈনিক ও জেসিওদের বিল্ডিং এবং তার সামনের পার্কিং চোখে পড়ে৷ দেখা যায়, এই বিল্ডিং ঘেষেই পুরান অফিসার ফ্যামিলি ওয়ার্ড, অদূরে শিশু ওয়ার্ড৷ তার পাশে আরেক নতুন ভবন৷ জানি না কোনটায় কি!
আগের স্টাফ সার্জনের রুমটার ওখানে কেন্টিন, সামনে কিছু এম্বুলেন্স দণ্ডায়মান৷ কত ছুটাছুটি করেছি এই বিশাল প্রাঙ্গণে! যাদের সাথে ট্রেনিং করেছি তাদের একজন গতকাল মেজর জেনারেলের র্যাংক থেকে অবসরে গিয়েছেন৷ ঢাকা সিএমএইচে আমি চাকরি করেছি মাত্র সাত মাস – এম এই রুমে৷ বাকি সময়টাই প্রশিক্ষণে ছিলাম৷ এই হাসপাতালের সিনিয়র, জুনিয়র অফিসারদের সাথে, কোর্সমেটদের সাথে, রোগীদের সাথে – আছে স্মৃতির পাহাড়৷
এখানে করোনা রোগী নিয়ে ডাক্তার, নার্স, আয়া, ওয়ার্ডবয় ও সুইপার যারা কাজ করেন, তাদের কয়েকটা বিষয় খুবই চোখে পড়ার মতো:
- সবাই যথাযথ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে ডিউটি করছে।
- অন্যান্য রোগীদের বেলায় সবাই যেমন আন্তরিক ও প্রাণবন্ত থাকে, আমাদের ক্ষেত্রেও তেমন৷
- ন্যূনতম কোন সংকোচ দেখিনি।
- সকাল দুপুর রাতে একইরকম ফ্রেশ।
- বার বার দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“স্যার কিছু লাগবে? কোন অসুবিধা আছে?”
মনে মনে বলি, আমার মতো সেবা সতেরো কোটি মানুষ পায় না – এটাই আমার একমাত্র কষ্ট, একমাত্র অসুবিধা৷
সময়মত পাঁচবেলা খাবার চলে আসে৷ পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে যা প্রয়োজন৷ সামরিক বন্ধুরা, জুনিয়ররা খোঁজ নিচ্ছে বারবার – কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা!
দিল্লির ম্যাক্স হাসপাতাল, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ, থাইল্যান্ডের বামুনগ্রাথ হাসপাতালের তুলনায় আমাদের এই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসার মান কোন অংশেই খারাপ না৷ নিজেই ঐসব প্রখ্যাত হাসপাতালে আত্মীয়দের চিকিৎসা করিয়েছি, ভিজিটে গিয়েছি৷
আমাদের প্রচার নেই, নিজেদের কাজকে নিজেদেরই স্বীকৃতি দিতে যত অনীহা!