প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৫ জুলাই, ২০২০, বুধবার
প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার
একাদশ ব্যাচ,
শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম), বরিশাল
একজন কোভিড রোগীর হাসপাতালে সময় খুব দ্রুতই কেটে যায়, বিশেষ করে যার সাথে কোন এটেন্ডেন্ট থাকে না৷ সারাদিনের অনেক কাজ৷ প্রথম দিকে অজানা আতংক বিরাজ করে, ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্ট কি আসে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা লাগে৷ পরিচিত অপরিচিত ফোন কল রিসিভ করতে হয়৷
এমন টেক্সট এসে ভরে যাচ্ছে:
এখন কেমন আছেন? প্রতিদিন একটু বিরক্ত করবো ভাই৷
অক্সিজেন স্যাচুরেশন কত?
ডি ডাইমার করিয়েছেন?
আপনার তো কো মরবিডিটি নেই, তবে ওষুধটা কেন দিচ্ছে?
বড়লোকি হাসপাতালে রাজার হলেই আছেন – রাজকপাল আপনাদের৷
আপনার অবস্থা আপনার লেখা পড়ে জানতে পারি, তাই জ্বালাই না৷
অনেক মানুষের দোআ আছে, আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন৷
ডাক্তাররা কিন্তু ব্যাড পেশেন্ট, মাইন্ড ইট।
এমন অজস্র মেসেজের জবাব দিতে হয়৷ মানুষের ফোন পাওয়াটাকে কখনই খারাপ ভাবে নেয়নি৷ এই অসুস্থতার সময়ে যারা খোঁজ নিতে ফোন করেন, তাদের ফোন রিসিভ করা ও নিজের সম্পর্কে জানানো দায়িত্ব মনে করি৷
সকালে ফজর পড়ে ঘুমাই৷ উঠে আদা, তেজপাতা, লবঙ্গ, দারচিনি, এলাচ, লেবু সিদ্ধ পানির ভাপ নেই৷ সেই গরম পানির গড়গড়া করি – সেই পানি মধু কালিজিরা মিশিয়ে খাই৷ এই কঠিন কাজটা দিনে চারবার অন্তত করি৷ পাউরুটি জেলি, বাটার, দুটো সিদ্ধ ডিম, সেজান জুস – প্রতিদিনের প্রাতরাশ। এর ফাঁকে সিস্টার এসে ব্লাড প্রেশার মেপে যান, অক্সিজেন স্যাচুরেশন দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, পেটে ইনজেকশন দেন৷ এরপর নাস্তা সেরে বসি ওষুধ খেতে৷ ব্রিদিং এক্সারসাইজ করি – তাও দিনে চারপাঁচ৷
সময় পেলে লিখি৷ আগের লেখার মন্তব্যে রেসপন্স করি৷ বেডে শুয়েশুয়ে সেনা জীবন আর অতীত জীবনের হিসেব নিকেশ মিলাই৷ কেন এতো ওষুধ খাই, কেন ভাপ নেই, কেন হাঁটাহাঁটি করি – কেন সিলিন্ডারের সাথে নাক লাগাই? আরো কয়েকটা দিন এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য৷ পরপারের জীবনে কেউ আস্থাবান নয় বলেই এই কসরত৷ আমরা কি কেউ জানি আরও বিশ বছর বেঁচে থাকলে জীবন ঝাঁঝরা ও বিষময় হবে না? তবুও বাঁচতে চাই!
দুপুরে ডাক্তার আসে- রাউন্ড দেয়৷ বন্ধুদের শুভেচ্ছা পৌঁছে দেয়- কেউ তার পরিচয় দেয়, আমার ভাগ্নের বন্ধু বলে৷ দিন হিসেব করে নেক্সট টেস্টের তারিখ নির্ধারণ করে৷ গোসল, খাওয়া, নামাজ – গরম ভাপ ও ব্রিদিং এক্সারসাইজ৷ বাসার, ক্লিনিকের, বন্ধুদের ফোনের রিপ্লাই দেয়ায় মধ্যেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসে৷ কখনো চোখ লাগাই, কখনো পারি না৷ বিকালে আবার ভাপ নেই, মালটা টাইপের ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাই৷ প্রিয় আম খাই৷ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লে. কর্নেল জেসমিন আম পাঠিয়েছে৷ বোনের বাসা থেকে ইলিশ, পোয়া মাছ, ঢেঁড়স ভাজি – ইলিশের ডিম/ পেটা পাঠিয়েছে আজ৷ মজা করে রাতে খেলাম৷ রুচি ফিরতে শুরু করছে৷
রাতে আবার ইনজেকশন নেই, এক হাড়ি ওষুধ খাই৷ ফেইসবুকিং করি৷ ডাক্তারদের মৃত্যু সংবাদ দেখতে দেখতে এখন আর অনুভূতিতে লাগছে না৷ মনে হচ্ছে এটাই স্বাভাবিক! অবশ হয়ে যাচ্ছে সব অনুভূতি৷ কয়েকদিন ধরে হাঁটি, আজ হাঁটতেও যাইনি৷ এই লেখার মধ্যেই অতি প্রিয় ডা. সাইফুল ইসলাম ভাইর মৃত্যু সংবাদ পেলাম – অন্যদের জানিয়ে ফিরলাম৷ আল্লাহ ভাইটিকে জান্নাতবাসী করুন। আমাদের ক্ষমা করুন, এই দুঃসহ অবস্থা থেকে পরিত্রান দিন৷