প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৬ জুলাই, ২০২০, বৃহস্পতিবার
অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার
একাদশ ব্যাচ,
শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম), বরিশাল
শ্রাবণ মাসে বৃষ্টির সাথে দমকা হাওয়া বেশ কমন। বাতাসে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া সেই বৃষ্টিদেহ ছন্দ ও তরঙ্গায়িত রূপ প্রকাশে ব্যস্ত। শহুরে জীবনে এমন দৃশ্য চোখ এড়িয়ে গেলেও গ্রামের দোতলা বাড়ির দখিনা বারান্দায় যখন মন ও শরীরকে ভিজিয়ে দিয়ে যায় তখন চোখ বুজে থাকার সুযোগ কই!
এমনভাবেই জীবনের বিভিন্ন প্রান্তে দাঁড়িয়ে আপনাকে আমাকে মৃত্যু চিন্তা আচ্ছন্ন করে ফেলে। এর কোনো ক্লিনকাট উত্তর আমরা কখনো পাইনি। গোজামিলের উত্তর পেয়ে পেয়ে বড় হতে থাকা মানুষগুলো তাই জীবন ও মৃত্যুর সঠিক সংজ্ঞা, এর বৈশিষ্ট্য বিস্তৃতি না জেনেই চলছে তো চলছেই৷
সক্রেটিসদের মতো কিছু লোক খুব রিচ পারসেপশন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন বলে তাদের বেঁচে থাকা, মারা যাওয়ায় কোন আপত্তি ছিল না৷ বেঁচে থাকার স্বার্থকতা তারা খুঁজে পেতেন- কাজের মাধ্যমে, নিজেকে জানার মাধ্যমে, এবং এ সমস্ত কথা বলা ও তা অনুসরণ, অনুকরণের মাধ্যমে৷ যুগে যুগে এমন মানুষরা পৃথিবীকে শান্তির আধার বানাতে ব্যাকুল ছিলেন- তারা তাদের কর্তব্য জানতেন। তাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল মানুষ-মানুষের কল্যাণ; তার সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনায় আন্দোলিত হওয়া। তারা তাদের মিশনে যখন বাধাগ্রস্থ হয় অতি সহজেই মেনে নেয় এবং জানান দিয়ে যায়- এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া৷
বিভিন্ন ধর্মের প্রচারকদের মধ্যে এই নিজের কাজ নিজে সম্পাদন করার গুণাবলী আমরা দেখতে পাই। ইসলাম ধর্মের নবী রাসূলদের (স.) মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বানের আসল বক্তব্যটি আমরা মিস করি বলে অনেক ইবাদাত বন্দেগী করে ফেলার পরও না বাহ্যিক কোন প্রবৃদ্ধি হয় না মনোজগতে আসে কোন তৃপ্তি। পৃথিবী আমাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের স্থান নয়, এখানে আল্লাহ অল্প সময়ের জন্য পাঠিয়েছেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য। নবী রাসূলগণ (স.) যেভাবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে আল্লাহর পথে ডেকেছিলেন সেই আহবান আজ অনুপস্থিত। তাই আহবানকারীদের কেউ বিশ্বাস করে না। গোজামিলে ভরা, অপরিচ্ছন্ন ডাক – সঠিক রেফারেন্সের অভাব আমাদেরকে আশান্বিত করে না, আস্থা অর্জনে দ্বিধা কাজ করে৷
আমরা বেঁচে থাকার জন্য বৈধ অবৈধ যে প্রক্রিয়া চালাই তা কোনভাবেই শুদ্ধ ও সুস্থ আচরণ নয়। কেন পৃথিবীতে অনেক লম্বা সময় ধরে বেঁচে থাকতে হবে? প্যারালাইজড অবস্থায় কেন ১০৫ বছর বেঁচে থাকতে হবে, কেন সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করে বেঁচে থাকা লাগবে অথচ একজন মানুষের উপকারে লাগবো না আমি! কেন আমি মানুষের অশ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ভেন্টিলেটর দখল করে রাখবো আরও কিছুদিন৷
স্বাভাবিকভাবেই কয়েকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন সামনে চলে আসে:
১) কবে তবে আমি আমার মৃত্যুর দিনটা কামনা করবো?
২) মৃত্যু থেকে বেঁচে থাকতে চাওয়া কি অপরাধ?
৩) নিজের বেঁচে থাকার প্রত্যাশায় কতটুকু সম্পদ খরচ করা যাবে?
৪) সকলের জীবনের মূল্য কি এক?
আমি কেন সুস্থাবস্থায় মৃত্যু কামনা করবো?
-আমি সুস্থ ও স্বাভাবিক চিন্তা করবো৷ আমার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক দায়-দায়িত্ব আছে। সেসবের জন্য আল্লাহ অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন। ওই দায়-দায়িত্ব পালনের ফাঁকে আল্লাহ যখন ইচ্ছে করবেন ডাক দেবেন, নিয়ে যাবেন। একজন ঈমানদার সেই আহবানে সাড়া দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
মৃত্যু থেকে বেঁচে থাকতে চাওয়া অপরাধ কেন হবে কিন্তু আপনি নিজে একাকী বেঁচে থাকার জন্য লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলে সেটা অপরাধ। পরোক্ষভাবে আমরা সবাই এই অপরাধের সাথে জড়িত। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা তার শিক্ষা, স্বাস্থ্য মানবাধিকার, নিয়ে কোনদিন আপনার কোন ভাবনা ছিল? যা ছিল তা হচ্ছে স্বার্থপরতা আর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার রাজনীতি। সুতরাং আপনি এই সমাজকে বিশৃঙ্খল করার দায়ে ইতোমধ্যেই দায়ী। একটা সত্য কথা কোনদিন বলেননি বরং যারা সত্য বলে তাদের গায়ে আপনি লেবেল এঁটে দেন। আপনি যেভাবেই মারা যান না কেন সাধারণ মানুষের অভিশাপ আপনাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে।
আপনার সম্পদ যদি হালাল হয় তবে আপনি নিজেকে বাঁচাতে সব টাকা খরচ করুন আমরা আপত্তি করবো কেন? তবে কিছু টাকা খরচ করে এই দুর্দিনে এলাকায় একটা মানসম্মত হাসপাতাল বানালে কি আল্লাহ বেশি খুশি হবেন বলে আপনার মনে হয় না! যিনি রোগ দিতে পারেন তিনি তো সুস্থ করে দেবেন বিনা খরচেই- এটাই ঈমানের দৃঢ়তা৷
প্রাথমিকভাবে অবশ্য সবার জীবনের মূল্য এক। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, পুরুষ-নারী, হিন্দু-মুসলিম, আমির-প্রজা নির্বিশেষে সবার জীবনের মূল্য সমান৷ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে কিছু জীবনকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়ার কৃষ্টি পৃথিবীতে তৈরী হয়েছে৷ নবীরা তাদের সাহাবীদের জীবনকে নিজেদের জীবনের মতোই সমভাবে মূল্যায়ন করতেন৷ তাই নবী অনুসারীরা তাদের নবীকে নিজেদের জীবনের চেয়ে গুরুত্ব দিতেন। আজ আমাদেরও প্রতিটা নাগরিক জীবনকে সমভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্র যখন ব্যাকুল থাকবে তখনই সে রাষ্ট্রে করোনা কেন কোন বিপদ এসেই স্থায়ী বাসা বাঁধতে পারবে না!
করোনার মতো মহামারী বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বকেই চেপে ধরেছে, নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে৷ এখান থেকে পরিত্রান কিন্তু অনেকেই পেয়ে গেছে। উন্নত দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের নাম নিতে আপনার অসুবিধে থাকলে আপনি তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের নাম উল্লেখ্য করবেন। আরও কাছের দেশ নেপাল, ভুটানের নাম নেন। তারা পেরেছে আমরা কেন পারলাম না৷ এসব নিয়ে একবার নিরপেক্ষভাবে ভাবুন।
আমাদের জীবনের দর্শনটাই ঠিক হয়নি। কি চাই, কেন চাই- এই চাওয়ার শেষ কোথায় তার কোন জবাব নেই। পড়াশোনা করি কিন্তু শিক্ষিত হই না। কুরআন হাদিস নামাজ পড়ি কিন্তু মানুষের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হয় না, কোন দায়বদ্ধতার তাড়া অনুভূত হয় না হৃদয়ে৷ নিজেরা স্বার্থপরের মতো বেঁচে থাকবো আর সারা দেশ ধ্বংসের মুখে পতিত হবে! জাতি-সত্ত্বায় মন-মগজে এটা স্থির হয়ে আছে৷ খুবই রুগ্ন চিন্তা। শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ এই চিন্তা লালন করেন এবং তারা প্রমান করার চেষ্টা করেন তাদের জীবনের মূল্য সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা যেসব দেশকে উন্নত বলে বিবেচনা করি তাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সকল নাগরিকের মানবাধিকার সমুন্নত রাখা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়া, সাম্য ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা৷
কখনোই নিজে নিজে ভাল থাকা যায় না, সম্ভব নয়। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের উচিত দেশের সকল নাগরিককে নিজেদের কাছাকাছি ভাবা, তাদের দায়-দায়িত্ব নেয়া। মনে রাখতে হবে তারা ভালো থাকলেই আমরা ভাল থাকবো। তাদের টেস্টের ব্যবস্থা হলেই আমরা ঝুঁকিহীন থাকবো, তাদের অক্সিজেনের ব্যবস্থা হলেই আমাদের ভেন্টিলেটর পাবার সুযোগ হবে।
আসুন একাকী দীর্ঘদিন অসুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকার চেয়ে অনেককে নিয়ে সুস্থ অবস্থায় কম দিন বাঁচি৷