প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৭ আগস্ট, ২০২০, বৃহস্পতিবার
প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার
একাদশ ব্যাচ,
শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম), বরিশাল
টোনাটুনির গল্প পড়েছি ছোটবেলায়৷ তারা স্বামী স্ত্রী অন্যদের দাওয়াত দিয়ে নিজেরা রান্না করে পেট ভরে খেয়ে, মেহমান পশু পাখিদের বঞ্চিত করে এবং আগ ডালে টুন টুন ডেকে ওঠে এক ধরনের বিকৃত মজা নেয়৷ কেন এসব গল্প ছিল জানি না৷ কেউ কোনদিন পড়িয়েছিল কি না তাও মনে নেই৷ শিক্ষণীয় বিষয় কি তুলে ধরেছিলেন শিক্ষক মহাশয়, তা আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে৷ এসব আজগুবি গল্প আমাকে কখনো টানে নি, তবে প্রতারণার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে আমার মানসপটে সেই বাল্যকাল থেকেই দাগ কেটে আছে৷
আজ সকালের টেলিফোন পাওয়ার পর থেকেই দুপুরে চমৎকার একটা মধ্যাহ্ন ভোজের মুখোমুখি হতে যাবার সুখানুভুতি লেপ্টে আছে চিন্তায়৷ করোনার কারণে দিনক্ষণ ভুলে গেছি৷ কোন একজনের টেক্সট এ বুঝতে পেরেছি আজ শুক্রবার৷ প্রতি শুক্রবার এই ছোট্ট ভাইটি সূরা কাহাফ পড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়৷
আজান হল৷ অপেক্ষা করতে থাকলাম৷ একটা বেজে গেছে৷ আমি গরম পানির ভাপ নিয়ে সময় ব্যয় করছি৷ ক্ষুধা লেগে গেছে৷ হাসপাতালের বেডে অসুস্থ রোগীর জিহ্বায় স্বাদ ফিরে এলে, তাকে মজার খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে এভাবে সাগর পাড়ের শুটকি মাছের মতো ঝুলিয়ে রাখার মানে কি! আরে ভাই আমি কি তোমার কাছে আবেদন করছি একটু ভালোমন্দ খাবারের জন্য? অভুক্তদের নিয়ে বিত্তবানদের এমন মশকরায় সম্ভবত আলাদা আনন্দ আছে৷ যাই হোক এমন দুষ্টামি মেডিকেলের প্রথম বর্ষে কেন্টিনে দাওয়াত দিয়ে করলে, আজ হয়তো ভুলতে বসতাম বড়জোর স্মৃতিচারণ করতাম৷ কিন্তু সারা শরীরে করোনা ভাইরাস নিয়ে আজ ওদের করুণা সত্যি খুব পরিতাপের৷ হাসপাতালের খাবার দিয়ে গেল৷ রাগে সেই খাবারটা রেখে দিলাম৷ দরকার হলে আজ উপোস থাকবো, রোজা রাখার অভ্যাসতো আছেই!
ভাবলাম বান্ধবীকে ফোন দেই – যাতে দুপুরে না খেয়ে ফেলি সেজন্য কল করে সতর্ক করলে, কি হল? ভাবলাম অনেক আইটেম নিজের হাতে বানাচ্ছে তো তাই একটু সময় লাগছে৷ ধৈর্য ধারণের উপর আমার জানা আল কুরআনের সকল আয়াত স্মরণ করলাম৷ ক্ষুধায় যখন আরও ক্লান্ত হয়ে উবুত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে ব্রিদিং এক্সারসাইজ করছি, তখন টুপি মাথায় পাজামা পাঞ্জাবি পড়া এক সৈনিক একটা প্যাকেটসহ আমার রুমে ঢুকলো৷
সালাম দিয়ে বললো,
” স্যার লিজা ম্যাডাম পাঠিয়েছেন ৷”
আমি ধন্যবাদ দিয়ে তাকে বিদায় জানালাম৷ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লিজা চৌধুরী পেশায় প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ৷ সেনাবাহিনীতে আমার এক নম্বর জুনিয়র৷ আমরা দু’জনই শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট৷ লিজা এ ব্যাচ আর আমি ডি ব্যাচের৷ দুজনেই সাভারে জয়েন করি৷ আমি জয়েন করি ১১ ফিল্ড এম্বুল্যান্স আর লিজা সাভার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে৷ লিজার স্বামী মেজর জেনারেল ওমর হাসান স্যার তখন ১১ ফিল্ড এম্বুলেন্সের মেডিকেল স্পেশালিস্ট৷ আমরা যখন সেনাবাহিনীতে টিকে গেলাম, জয়েন করবো কি না জানতে বরিশাল ক্যাডেট কলেজে ওমর হাসান স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম৷ তারপর থেকেই ওমর হাসান স্যারের সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভাল৷ সর্বশেষ আমার চাকরি ছাড়ার সময় বগুড়া সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্যারকে পেয়েছি৷ সবার মতো স্যারকেও সেখানে আমি খুশি করতে পেরেছি বলে আমার বিশ্বাস৷
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লিজার অনেক গুণ৷ ফরিদপুরের ভাঙার মেয়ের যে আস্ত আস্ত এত গুণ, তা আমরা ক্লাসমেটরা টের না পেলেও তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলের মেজর ওমর হাসান টের পেয়েছিলেন৷ পেশায় লিজা চৌধুরী যেমন দক্ষ, ব্যক্তিগত আচার আচরণে তেমন অমায়িক ও মানবিক৷ বন্ধু বান্ধবদের প্রিয় মুখ, যাকে ছাড়া কোন অনুষ্ঠান আশা করা যায় না৷ উন্নত সেনা শৃঙ্খলার অধিকারী এই সেনা কর্মকর্তা, তার কর্মস্থল ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বেশ সুনামের সাথে চাকরি করছেন৷
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে গাইনির ম্যাডামদের একটা অংশ এত বেশি গুণী, যা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ তারা নিজেরাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে শেষ করেন না, স্বামীদের প্রতিষ্ঠিত করেন৷ ছেলেমেয়েদের মানুষ করেন, সুশিক্ষিত করেন৷ ব্রিগেডিয়ার লিজা তারই একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ৷ দুই মেয়ে ও এক ছেলে – ডাক্তার, আইনজ্ঞ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ৷ প্রতিটা ছেলে মেয়ে মেধাবী৷
এরপর আমি খাবারের প্যাকেটের মুখ খুললাম৷ বার বার বলেছি কম দিতে৷ কথা রাখেনি – এটাই মা বোনদের স্বভাব৷ তুমি মনু ঠিকই বলেছ – আমরা ভাই ছেলেরা বোন মাকে চিনতে পারি না, চিনলেও বিলম্ব করে ফেলি চিনতে৷ তাইতো অস্থির হয়ে টোনাটুনির গল্প বলতেও ছাড়িনি, অথচ কত যত্ন করে পাঁচ বাটি ভরে; শিং কাঁচা কলা ঝোল, মাগুর আলু, শৌল মাছ আলু দোপেঁয়াজা, ঘন ডাল, আরেক বাটিতে পোয়া বা কোরাল মাছ পাঠিয়েছে, আর সাথে আম৷
এত ব্যস্ততার মাঝে কিভাবে এতো খাবার পাঠিয়েছে, সে বিষয়ে আমি বিস্ময় প্রকাশ করছি না৷ আমি লিজাদের কর্মক্ষমতা জানি – অবাক হইনি৷ বন্ধুত্ব ভ্রাতৃত্ববোধ টিকে থাকুক – ভালোবাসা, মানবিক আচরণ হোক সম্পর্কের ভিত্তিমূল: এটাই পৃথিবীর কাছে আমার চাওয়া৷