প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার
প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার
একাদশ ব্যাচ,
শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম), বরিশাল
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ঢাকায় আমি যখন প্রশিক্ষণ নিই তখন আমাদের আলু ভর্তার মতো চটকে তৈরি করা হতো৷ একটু পর পর সরিষার তেল, লাগলে ঘি আবার চটকানো৷ এমন পীড়নের মাধ্যমে পেশাগত প্রশিক্ষণ সত্যি বিরল! প্রচুর শারীরিক ও মানসিক শক্তি না থাকলে টানা ৪৮ ঘন্টা ইউনিফর্মে ডিউটি করা কঠিন৷ এম আই রুমে সারা রাত ডিউটি করে সকাল থেকেই ওয়ার্ডের কাজ, ক্লিনিক্যাল মিটিং, কখনো জার্নাল ক্লাব; বিকালে হয়তো শুরু হয়ে গেল আইসিইউর ডিউটি এবং পরেরদিন দুপুরে ছাড়া পাওয়া৷ এর মধ্যে খাওয়া দাওয়া, ইউনিফর্ম ইস্ত্রি করে আনার দায়িত্ব থাকতো ব্যাটম্যানের উপর৷ জীবনে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠা পাবার ক্ষেত্রে এই ব্যাটম্যানদের মতো ছেলেগুলোর কি সীমাহীন অবদান তা কোন সেনাকর্মকর্তাই আশা করি বিস্মৃত হবেন না৷
আইসিইউ’র ডিউটিগুলো ছিল রাইডে উঠার অভিজ্ঞতার মত৷ অনেক সময় কল দিয়ে বিশেষজ্ঞদের পাওয়া যেত না, উল্টো বকাবকি করতো৷ তাই আমি প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে উনাদের কম কল দিতাম৷ একরাতে ভেন্ট্রিকুলার ভিব্রিলেশনের রোগী ম্যানেজ করে ফেলার পরদিন সকালে এটা নিয়ে কথা উঠলে, আমাকে বাহবা দিলেও সে রাতের বিশেষজ্ঞ কার্ডিওলজিস্টকে জেনারেল আনিস চোখ রাঙালেন৷
এই একজন ব্যক্তি যার নাম উচ্চারণ না করলে, যার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলে আমাদের সময়ের ট্রেইনীদের অকৃতজ্ঞ বলে ভূষিত করবেন বিজ্ঞজন৷ ক্ষণজন্মা এমন পুরুষ আমার চোখে বিরল। অতি স্মার্ট, সুদর্শন আধুনিক মনের এই মিলিটারি জেনারেল কতটা উদার ছিলেন, তা আমরা টের পেতাম তিনি যখন ক্লিনিক্যাল মিটিং এ দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে তারই ক্লাসমেট ও বন্ধু কনসালটেন্ট সার্জন জেনারেল মোহায়মেন সম্পর্কে এসএমজির গুলির মতো অনর্গল প্রশংসা জ্ঞাপন করতে থাকতেন। অন্যকে কিভাবে বড় করতে হয় তার অনন্য উদাহরণ ছিলেন জেনারেল আনিস ওয়াইজ৷ উনি কথা বললে শুনতেই মন চাইতো।
কথা বলার স্টাইল, বাচনভঙ্গি, উদাহরণ সৃষ্টি ও রসবোধ তার সবগুলো বক্তব্যকে বাণীতে রুপান্তরিত করতো। কত তাড়াতাড়ি স্যার আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন ভাবতেই কষ্ট হয়। শুধু এএমসি নয়, জেনারেল আনিস ছিলেন পুরো সেনাবাহিনীর গর্ব৷
আমাকে ছয়মাসের জন্য স্যারের ইচ্ছায় মেডিসিনের ট্রেইনীদের সাথে ট্রেনিং করতে হল৷ প্রতি বৃহস্পতিবার কনসালট্যান্ট ফিজিশিয়ানের রাউন্ড হতো৷ সেভাবে বুধবার রাতে আমাদেরকে কেইস সরবরাহ করা হতো, ব্যাপক পড়াশোনা করতাম সবকিছু ফেলে৷ এমনিতেই পেশাগত জ্ঞানের যা অবস্থা, তার মধ্যে মেডিসিনের বাঘা ট্রেইনীদের সাথে রাউন্ড – বাড়তি ঝামেলা ইংরেজি – এর পরিশুদ্ধ উচ্চারণ। বুধবার রাতে এমনও মনে হতো – না বলেই কোথাও চলে যাই।
কিন্তু এভাবে চলে গেলে তো আবার ধরে নিয়ে আসবে। রাজশাহীর বেসিক কোর্স থেকে মিজান পালিয়ে এসেছিলো, পরে তাকে আবার ঢাকা থেকে প্যাক করে নিয়ে ফোকলা দাঁতে হাজির করা হয়৷
পালানোর চিন্তা বাদ দিয়ে কেইস প্রেজেন্টেশন ভালভাবে করার চেষ্টা করলাম। আমাকে দিয়েই শুরু হতো, তাতে আমার কোন আপত্তি ছিল না৷ তিন চারটা কেইস এভাবে প্রেজেন্ট করার পর আনিস ওয়াইজ একবার বললেন,
“Why wahab is always first bullet of the barrel?”
কে যেন বলল,
“স্যার ও নিজেই ভলান্টিয়ার করছে। “
একটা ঢাহা মিথ্যা কথা! এমন মিথ্যা কথা ফৌজে জায়েজ। শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম, পায়ের অদৃশ্য দশটা আঙ্গুল দিয়ে বুট আটকে ধরলাম – হায় কী শুনলাম।
স্যার বললেন,
“Thats good, you need not to present further cases.”
এরপর আমার সাথে আরেকজনকে বাদ দিয়ে, বাকি তিনজনের প্রেজেন্টেশন নিতেন৷
আমাদের কোর্স শুরুর আগে স্যার তার রুমে ডাকলেন৷ অনেক পরামর্শের মধ্যে একটা ছিল,
“Those who r unmarried don’t get marry and those who are married don’t make your wives pregnant.”
বলতে সাহস করলাম না, স্যার যার দুটোই হয়ে গেছে?
জেনারেল আনিস ওয়াজের সময় মেডিসিনের বিভিন্ন ব্রাঞ্চগুলোতে অফিসারদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল ভীষণ ভাল৷ স্যারকে ভয় পেলেও প্রতিটা বক্তব্যেই নতুন কিছু পাবার আগ্রহে আমি তার সখ্যতায় ব্যাকুল থাকতাম৷ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাঈদ স্যারের সাথে নিউরোলজি ওয়ার্ডে ছয়মাস কাজ করেছি৷ লে. কর্নেল আব্দুর রহমান সিদ্দিকী স্যার ছিলেন আমার আরেকজন প্রিয় মেন্টর, যিনি অকারণেই আমাকে পছন্দ করতেন ও কাছে ডাকতেন৷
এএফএমআই’র অধীনে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে যে হলিস্টিক প্রশিক্ষণ হয় তা ইউনিক, আমরা এই ফৌজি সদস্যরা তা নিয়ে গর্বিত৷ আর এর প্রধান কারিগর ছিলেন এই জেনারেল আনিস ওয়াইজ। আল্লাহ তুমি এই মহান মানুষটিকে আমাদের মাঝে ফেরত তো আর দেবে না জানি, আমাদের হৃদয়ে যেন আজীবন ধারণ করি কৃতজ্ঞ চিত্তে সেই সুযোগ দাও৷ তুমি তাকে জান্নাতবাসী কর হে রব৷
এই সকল মহান চিত্তের মানুষদের জীবনী রচিত হওয়া উচিত। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে, তাদের অসাধারণ কীর্তি কলাপ। মেজর বরেন চক্রবর্তী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহমান সিদ্দিকী বা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মামুন মোস্তাফী, এই কাজে হাত দিলে আমরা সহযোগিতা করতে পারব।