কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার জন্য আর কতো চিৎকার করবো? চিৎকার করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। আমাদের প্রতি কারো নজর নেই। না সরকারের না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের । সিনিয়র ডাক্তারদের কাছ থেকেও তেমন কোন সমর্থন পাইনা। সবাই মুখে আশ্বাস দিয়ে বলে দেয়…বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু তারা আন্দোলনে নামেন না। একটা দিন চেম্বার বন্ধ করে আমাদের সাথে রাস্তায় নামেন না। দূরে দাড়িয়ে দেখেন সব। বুঝেন সব। কিন্তু কিসের টানে আমাদের পাশে এসে দাড়ান না তারা? ইন্টার্নদের কি মানুষ মনে করেন না তারা? নাকি বড় বড় ডিগ্রীধারী,ক্ষমতার ট্যাগধারী মানুষরাই তাদের জন্য সব। এমপির রোগী ভর্তি হলে ১০জন ডাক্তার ছুটে আসেন ওয়ার্ডে রোগীকে দেখতে ! আর আহত ইন্টার্নের খোজ নেন এসি রুমে বসে চেয়ার দুলাতে দুলাতে। আমরা যে তাদের সন্তানতুল্য সে কথা তারা বেমালুম ভুলে যান।
আবারো কর্তব্যরত ইন্টার্ন চিকিৎসকের উপর হামলা।এবার ঘটলো খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ।
তারিখ ০৪.০৯.২০১৫ সময় রাত ১০.৫০মিনিট। মেডিসিন ইউনিট ৩ তে এক রোগী ভর্তি হলো আন্সটেবল অ্যাঞ্জাইনা নিয়ে ! সে দুদিন আগে ইউনিট ৫ এ ভর্তি হইছিলো কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসায় ‘আরাম প্রাপ্তি’ না হওয়ায় DORB দিয়ে রোগী নিয়ে যায় বাসায়। রোগীর অবস্থা বেশী ভালোনা জেনে তাকে CCU তে পাঠানোর কথা বলা হয়। কিন্তু সেখানে কোন বেড খালি ছিলো না ! রোগীকে দেয়ার জন্য কোন অক্সিজেন সিলিন্ডারও পাওয়া যাচ্ছিল না ! রোগী অ্যাটেন্ডেন্সকে সব অবস্থার কথা জানিয়ে কাউন্সিলিং করা হলো ! তখন রোগীর লোক সব মেনে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার কথা বলল। সকল চেস্টা কে ব্যার্থ করে দিয়ে দুই ঘন্টা পর রোগীর মৃত্যু হয় !
এবার রোগীর স্বজন জানোয়ারগুলো তাদের আসল রুপ দেখায় ! অক্সিজেন কেন নেই(যেন অক্সিজেন আমরা পকেটে নিয়ে ঘুরি) ! কি চিকিৎসা দিলো যে রোগী মারা গেলো এরুপ হরেক রকম অভিযোগ করতে করতে কর্তব্যরত ইন্টার্ন চিকিৎসক ডাঃ প্রিন্স কুমার ঢালীর উপর অতর্কিত হামলা চালায় ! রক্তাত্ত অবস্থায় ডাঃ প্রিন্সকে যখন উদ্ধার করা হচ্ছিল তখন আবারো ১৫-২০জন তেড়ে আসে তাকে মারতে। তখন বাজে ১২.১০। ওয়ার্ডে ইন্টার্ন মাত্র দুইজন। রেজিস্ট্রার অনুপস্থিত। খবর পেয়ে অন্য ইন্টার্নরা পৌছানোর আগেই দোষী পলাতক। লাশ হ্যান্ডওভার করা হবেনা এমন সিদ্ধান্ত নিলে পুলিশ এসে বলে-লাশ দিয়ে দেন আর তাদের উপর এগুলো ছেড়ে দিতে ! কথা ছিলো লাশ আটকে রাখা হবে এবং রোগীর ছেলেকে আটক করা হবে। কিন্তু পরে জানা গেলো পুলিশ সাধারন ডায়রী করে তাদের ছেড়ে দিয়েছে। রাতে থানায় জিডি করা হলো। সকালে হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়কের কাছে এই ঘটনার বিচার চাইলাম ! সব সময়ের মতো তিনি কিছু আশ্বাসের বানী শুনিয়ে দিলেন আমাদের ! যে সব আশ্বাস আমরা হাজার বছর ধরে শুনে আসতেছি। বুঝলাম আমাদের গরম মাথা ঠান্ডা করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালালেন । তিনি বললেন প্রয়োজনে হাসপাতালের জরুরী বিভাগ বন্ধ করে দেয়া হবে যদি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা না হয়। অথচ তিনি চাইলে সবই সম্ভব। পরে খুলনা BMA এর সাথে মিটিং হলো,সেখানে তুলে ধরা হলো আমাদের সকল দাবী। সবার আশ্বাস শুধু শুনেই গেলাম আমরা। নানা জনের নানা মত। কিন্তু এমন কোন কথা শুনলাম না যে, এই ব্যবস্থাটা কালকেই নেয়া হবে।
আজ সকালে আবার উপস্থিত হলাম হাসপাতাল সুপার স্যারের দ্বারে। পেশ করলাম আমাদের দাবীর আবেদন পত্র। স্যার পত্রখানিতে এক বার চোখ বুলিয়ে রেখে দিলেন। কোন কিছু সম্পর্কে কোন মন্তব্য করলেন না। জানিনা আমাদের দাবীগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি কতটুকু করতে ইচ্ছুক বা আদৌ ইচ্ছুক কিনা। হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়কের নিকট আমাদের দাবীগুলো ছিলো-
১। হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক বাদী হয়ে ডাঃ প্রিন্সের উপর হামলাকারীর বিরুদ্ধে মামলা করবেন ও হামলাকারীর উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করবেন।
২। অনতিবিলম্বে হাসপাতালে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের ব্যবস্থা করতে হবে । অথবা কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে হাসপাতালে নিয়োগের ব্যাবস্থা করতে হবে এবং ২৪ঘন্টা সকল ওয়ার্ডে টহলের ব্যাবস্থা করতে হবে।
৩। প্রতিটি ইউনিটের গেটে সার্বক্ষনিক গার্ডের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অ্যাডমিশনের দিনগুলোতে গার্ডদের ডিউটি আরো জোরদার করতে হবে।
৪। অ্যাডমিশনের রাতে সহকারী রেজিস্ট্রার অথবা রেজিস্ট্রারকে সার্বক্ষনিক ওয়ার্ডে উপস্থিত থাকতে হবে।
৫। ওয়ার্ডে ঢোকার জন্য ভিজিটিং কার্ডের ব্যাবস্থা করতে হবে,ভিজিট এর জন্য নির্দিস্ট সময় বেধে দিতে হবে ও ভিজিটরের সংখ্যা কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
৬। বিপদাবস্থা ঘোষণার জন্য হাসপাতালে সকল ওয়ার্ডে এল্যার্ম/ইন্টারকমের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬। পর্যাপ্ত পরিমানে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও যাবতীয় দরকারী ইকুপমেন্ট যা জরুরী অবস্থায় প্রয়োজন হয় তা সরবরাহ করতে হবে।
৭। দায়িত্ব পালনের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের ফোন,হুমকি,হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
তারপর আমরা প্রায় ১.৩০ঘন্টা মানববন্ধন করি। এখনো পর্যন্ত প্রসাশনের পক্ষ থেকে আশানুরূপ কোন পদেক্ষেপ আমরা দেখতে পাইনি। আমাদের কথা ছিলো ২৪ ঘন্টার মধ্যে দাবী না মানা হলে আমরা লাগাতার কর্মবিরতিতে যাবো ! আমাদের আজকের কর্মসুচী শেষ হতে না হতেই সার্জারী ইউনিট ২ তে একজন মহিলা ইন্টার্নের উপর চড়াও হয় রোগীর স্বজন। কিছুক্ষন পর রেজিস্ট্রার ইন্টার্নকে অনিরাপদ অবস্থায় রেখে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। রোগীর লোকজন আবারো এসে বলে যায় যে তারা দেখে নিবে। অতচ এই রোগীর জন্য নাকি কয়েজন নেতা,কয়েকজন বড় বড় ডাক্তারের সুপারিশ ছিল। কিভাবে একজন মিড লেভেল ডাক্তার এমতাবস্থায় হাসপাতাল ত্যাগ করতে পারেন আমার বোধগম্য হয়না।
তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? এর শেষ কোথায়? কর্মবিরতি কখনো এমন সমস্যার সমাধান হতে পারেনা। কয়দিন কর্মবিরতি দিবো? দুই-চার-পাঁচ দিন? তারপর মানবতার খাতিরে। স্যারদের কথায় আবারো কাজে ফিরে যেতে হবে? আমরা আর কতদিন বলবো হেন করলে তেন করবো ! আমাদের কি কোন ক্ষমতা নেই? কবে দেখাবো সেই ক্ষমতা? কবে আমরা একযোগে রুখে দাঁড়াবো ধ্বজভঙ্গ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। কুৎসিত রাজিনীতির বিরুদ্ধে?
যদিও এমন ঘটনা আমদের কাছে নতুন নয়। ডাক্তারদের কষ্ট দুর্দশার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। টার্সিয়ারী লেভেলের হাসপাতালে আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনা প্রশাসন ! উপজেলাতে কিভাবে করবে। আজকের ভিক্টিম ডাঃ প্রিন্স । তার প্রধান পরিচয় সে একজন ডাক্তার। অর্থাৎ ভিক্টিম আমরা সবাই । অপমানটা আমাদের সবার। আজকে প্রিন্সের জায়গায় আপনি থাকলে কি চাইতেন? কোন বিচারে আপনার অপমান ঘুচতো একটু ভেবে বলবেন।
কঠোর কিছু পদক্ষেপ দরকার। আজো কি সেই সময় আসেনি? প্ল্যাটফর্মের সকল সদস্যের প্রতি আমাদের এই আহবান থাকলো।
লেখাটি পাঠিয়েছেন: ডা. সুদীপ পাল (খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল)
পরিমার্জনা: বনফুল
সিনিয়রদের গুস্টি কিলিয়ে কর্মবিরতিতে যাওয়া উচিৎ। মানবিকতা জাহান্নামে যাক যদি ডাক্তাররা চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে মার খায়।
Sorry to say সম্মানিত সিনিয়রদের Date over হয়ে গেছে, ওনাদের বিশ্রাম প্রয়োজন