প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২রা সেপ্টেম্বর, ২০২০, বুধবার
লেখাঃ ডা. সুস্মিতা জাফর
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ (২০০৭-০৮)
নিপসম (২০১৭-১৮)
আমার আজকের লিখাটা কাল্পনিক হলেও এর পিছনে রয়ে গেছে না বলা অনেক কথা। প্রতিটি সম্মুখযোদ্ধার জীবনেই রয়েছে অনেক অনেক স্মৃতি আর না বলা অনেক কথা। করোনার এই দুর্বিষহ মুহূর্তে তাদের জীবনে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, প্রিয়জন ছেড়ে দুরে থাকার অস্বাভাবিক যন্ত্রণা আর মোবাইলের স্ক্রিনে ছুড়ে দেয়া কিছু না বলা অনুভূতিগুলো। ছবিটা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ এর ডা. সাইদ মুহাম্মদ তাওহিদ তপু (১৩ তম ব্যাচের) আর তার সন্তানের। এই ছবিটা অনেক কথা বলছে। এই ছবিটা দেখে করোনার দুর্যোগকালীন সম্মুখ করোনাযোদ্ধা চিকিৎসকদের ত্যাগের অনেক না বলা গল্প মনে পড়ে।
আজ আমার ভীষণ আনন্দের দিন। আজ আমরা বাবার কাছে যাব। কতদিন দেখা হয় না বাবার সাথে, জানো? এই হাতে গুণে ৬৩ দিন! হবে কী করে? রাস্তাঘাটে গাড়ি- ঘোড়া কিছুই নাকি চলছে না। চাঁদ উঠলো, ইদ গেল তাতে কী? বাবা তো এলো না। তাই আমি ঠিক করেছি আজ আমিই যাব বাবার সাথে দেখা করতে। বাবা নাকি বাসা ছেড়ে হোটেলে গিয়ে উঠেছে! কী আজব কান্ড! এত্ত বড় বাসা ছেড়ে কেউ হোটেলে ওঠে বল? আচ্ছা! বাবা কি কোন কারণে মা’র সাথে ঝগড়া করেছে? কিংবা দাদা- দাদুর সাথে রাগ করেছে? তা করলোই বা কিন্তু আমার সাথে কেন রাগ দেখাচ্ছে বাবা? আমাকে কি তার একটুও দেখতে মন চায় না? অবশ্য দেখে বই কী! দেখা হয় তো বাবার সাথে, প্রতি রাতেই হয়। কিন্তু আরে না স্বপ্নে দেখা হয় তা তো বলিনি বাস্তবেই দেখা হয়, তবে সেটা মোবাইলের স্ক্রিনে! হ্যাঁ, বাবা দেখি প্রতিদিনই ভিডিও কল করে মাকে। ওই ফাঁকে আমিও স্ক্রিনের সামনে চোখ মুখ গলিয়ে মাঝেমধ্যে বাবাকে দেখে নিই। কিন্তু, অমন করে দেখে কি সাধ মেটে বল? আচ্ছা, বাবার কি একটা বারও ইচ্ছে হয় না, আমার সাথে একবার হলেও কথা বলতে? আমাকে কি তার মনেই পড়ে না? উহু, তা তো হবে না। আজ আমি বাবার সাথে দেখা করেই ছাড়ব! না, ভিডিও কলে দেখা করে চলবে না আমার। আমি আজ ঠিক ঠিক বাবার সাথে মন-প্রাণ জুড়িয়ে আড্ডা দিব। সেজন্যই তো মা এত বারণ করার পরেও রাজী হইনি আমি। আজ আমি বাবাকে ছোঁবই! বাবা যে হোটেলে থাকে, আমাদের গাড়িটা তার গেটের সামনেই দাঁড়াল। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, বাবা আসবে, দু’হাত বাড়িয়ে আমায় কোলে তুলে নিবে। অথচ মাস্ক পরা এক লোক এল একসময় গেটের একদম সামনে এসে আমার দিকে আনমনে তাকিয়ে রইল। আমি অস্থির হয়ে বললাম, “বাবা কই, মা? এ তো আমার বাবা না!” লোকটা দূর থেকেই আকাশী রঙ এর মাস্কটা খুলে হাতে নিল। অবাক হয়ে দেখি, আরে এটাই তো আবার বাবা! আমি ডাকলাম, “বাবা!” কিন্তু ডাকলেই বা কী? বাবার কান পর্যন্ত কি আর সেই ডাক পৌঁছাবে বল? কেনই বা পৌঁছাবে? বাবা আর আমার মাঝে শত্রু হয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে গাড়ির জানালার কাঁচ। মাকে কতবার বললাম, “মা জানালাটা খুলে দাও, খুলে দাও প্লিজ।” কিন্তু মা কথা শুনল না। খুললো না, জানালার কাঁচ সে খুলল না! মা,আমি তো বাবার কোলে যাব! ও মা, বাবাকে বল না, কাছে আসতে? মাগো, বাবা কি আমার ওপরে রাগ করেছে? ৬৩ দিন হয়ে গেল যে মা, একবার বাবাকে বল না আমি তাকে স্পর্শ করতে চাই, শুধু একবার! সবাই ভাবে আমি বুঝি কিছু বুঝতে পারি না, মাত্র ৮ মাস ১৩ দিন বয়সের আমি বুঝি বাবা- মা’র সাথে কোন কথা বলতে পারি না। আসলেই কি তাই? মুখে না বলতে পারি, ইশারা ইংগিতে আধো আধো বোলে ঠিকই সব বলতে পারি আমি।
গাড়িটা আবার চলা শুরু করেছে, আমার নিষ্ঠুর বাবাটাকে হোটেলের সামনে রেখেই, কাঁচের ওপাশে ৮ মাস বয়সের আমাকে একলা রেখেই গাড়িটা আবার ছুটে চলেছে ড্রাইভার আংকেল একটা গান ছেড়েছে, মনে হয় আমার জন্যই-
“আমার রাত জাগা তারা তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি, আমি পাই না ছুঁতে তোমায় আমার একলা লাগে ভারী।”