প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৯ নভেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর,
সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার,
ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার, বাংলাদেশ।
শুভ্র আর দীপা- তিন বছর সম্পর্কের পর বছরখানেক হলো বিয়ে করেছে। ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকে নিজেদের মতো। দুজনেই ভীষণ রকম অসাম্প্রদায়িক ও শিল্পপ্রেমী বলে সংসারে সাধারণ গোঁড়ামি নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কাজ করার সুবাদে শুভ্রকে স্বাভাবিকভাবেই নারী সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটাতে হয়। কাজের বাইরেও তার কিছু সুসম্পর্ক রয়েছে। বিয়ের আগে শুভ্র ও দীপার মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে খুব একটা অসুবিধা না থাকলেও বিয়ের পর একসঙ্গে থাকার কারণে ছোটখাটো অনেক ঘটনাই চোখে পড়ছে দীপার। যা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে । যেমন-
– বাড়ি ফেরার পর শুভ্র অধিকাংশ সময়ই ল্যাপটপ বা ফোনে সোশাল মিডিয়ায় সময় কাটায়।
– দীপাকে ঘরের কাজে সাহায্য করে না।
– ইদানিং কথাবার্তাও কম হয়।
– গভীর রাত অবধি শুভ্র লিভিং রুম বা বারান্দায় ফোনে কথা বলে।
– রাত চারটা পাঁচটার সময় ঘুমাতে আসে।
– সকালে বেরিয়ে পড়ে।
– পরের দিন আবার একই নিয়ম।
শুভ্রর অমনোযোগিতার কারণ খুঁজতে দীপা কয়েকবার শুভ্রর ফোন চেক করে। যেখানে সোশাল মিডিয়ায় বিভিন্ন জনকে করা নানান মেসেজ ভেঙে দিয়েছে দীপার মন। কারো সঙ্গে লং ড্রাইভে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে শুভ্র, কখনওবা ইনবক্সে কোনো নারীর ছবিতে ঝাঁঝালো মন্তব্য করেছে, আবার কখনো নানান তরিকায় ছবি তুলে ইনবক্স করার কথা বলেছে শুভ্র। দীপা ক্ষত বিক্ষত হয়ে একদিন শুভ্রর সঙ্গে আলাপ করতে বসলো। স্বাভাবিকভাবেই সব অস্বীকার করলো শুভ্র।
দীপা বিছানা আলাদা করে নিল। এরপর থেকে দীপা খেয়াল করলো শুভ্র তার ইনবক্স থেকে সব নারীদের মেসেজ ডিলেট করে ফেলে। শুভ্র স্নানে গেলে মাঝেমধ্যে দীপা তার ফোন চেক করতো। সেখানেই বিষয়গুলো ধরা পড়তো। এভাবে চেক করার বিষয়ে নিজের কাছেই খারাপ লাগত দীপার। বিয়ের আগে কিন্তু শুভ্র অনেক পজেসিভ ছিল। দীপার ফোন চেক করত, দীপা চারুকলার স্টুডেন্ট ছিল, বন্ধুবান্ধবও কম ছিল না। শুভ্রর পজেসিভনেসের কারণে দীপা ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমায়, পোশাকে পরিবর্তন আনে, নাচও ছাড়ে। কিন্তু শুভ্র কিছুই ছাড়েনি। বলে, “আমি আমার প্যাশন ছাড়ব না।” তর্কাতর্কিতে শুভ্র দীপার গায়ে হাতও তোলে। দীপা পারিবারিক বন্ধুদের সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করলে তারা উল্টো দীপাকে বোঝায়। বলে, “শুভ্রর পেশাটাই এমন যে উদারভাবে কাজ করতে হবে।” এটিকে ইতিবাচকভাবে নেয়ার পরামর্শ দেয় দীপাকে। বলে সন্দেহ কমাতে। লিবারেল হওয়া শিখতে অনুরোধ করা হয় দীপাকে। কিন্তু দীপা যখন নিজের কম্প্রোমাইজের কথা তোলে তখন ফ্যামিলি ফ্রেন্ডরা বলেন, “এতই যখন সমস্যা তখন বিয়ে করলে কেন? যেটা গেছে তা গেছে। থাকতে না পারলে ডিভোর্স দাও নয়ত লিবারেল হও।” এরা নিজেদের উদারনৈতিক মনোভাবের উদাহরণ দেয়।
দীপা একে একে সব ছেড়েছে। প্রথমে বন্ধু, পরে প্যাশন তারপর শুভ্রর সঙ্গে একান্তে সুন্দর সময় কাটানোর আশা। এতো সবকিছুর পরও দীপা শুভ্রকে ছাড়তে চায় না। তার সঙ্গেই সুন্দর সংসার করতে চায় যেভাবে অন্যান্য সুখী দম্পতিরা করে।
দীপা আমাকে প্রশ্ন করে, “এর সমাধান কী?”
এরপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প-
কাউন্সিলর কিন্তু সমাধান বলে দেয় না, শুধু যিনি এসেছেন তাঁকে তাঁর পরিস্থিতি অনুযায়ী যে যে অপশনগুলি আছে সেইগুলি অ্যাডাল্ট ম্যাচিউরিটি নিয়ে ভাবতে সহায়তা করে। সিদ্ধান্ত ক্লায়েন্টের নিজের, কারণ তার অবস্থা তার থেকে কেউ ভালো বুঝবে না।
এখন দীপার বিবেচ্য কি কি ?
– এই সম্পর্ক থেকে দীপা কি চায় ৫/১০/২০ বছর পরে ?
– কেউ কাউকে বদলাতে পারে না যদি না সে নিজে নিজেকে বদলাতে চায়, দীপা কি ছেলেটাকে বদলাতে চায় ?
– আরও কতদিন টাইম, এনার্জি খরচের এফোর্ট দীপা এই সম্পর্ককে দিতে চায়? কিভাবে দিতে চায়? কোন চিন্তা থেকে দিতে চায়? দিলে কি হবে ?
– দীপা কি শুভ্রকে রেস্পেক্ট করে? ০- ১০ স্কেলে কতটুকু রেস্পেক্ট করে? কতটুকু ভালোবাসে? এই রেস্পেক্ট কত দিন ধরে রাখতে পারবে?
– ওদের সন্তান আসলে এই পরিস্থিতির কি পরিবর্তন আসবে?
– দীপা কি Couple Counseling এর কথা ভেবেছে? শুভ্র কি এটাতে রাজি হবে?
– সম্পর্ক ভাঙলে দীপা কি সেই জের ধরে তার পরবর্তী সব আসা সামাজিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি সমাধান করতে সাহস রাখে?
– দীপা কি নিজেকে দুর্বল ভাবে? ভাবলে কোন জিনিসটা সে পারে না?
এই প্রশ্নগুলির জবাব কিন্তু দীপা ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না। কাজেই নিজের মনের গভীরে ডুব দিয়ে তুলে আনতে হবে।
সম্পর্কের বুনন হলো পারস্পরিক সম্মানবোধ ও বিশ্বাস। মতের অমিল থাকা স্বত্ত্বেও যাঁরা সঙ্গীকে সম্মান করেন তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা।