প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর,
সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার,
ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার, বাংলাদেশ।
“It is a wise father that knows his own child.” – William Shakespeare.
ভদ্রলোক ব্যক্তিজীবনে একজন সহজ সরল বন্ধুবৎসল মানুষ। মানুষকে সাহায্য করতে যতটুকু পটু ঠিক ততোটাই অপটু নারী-পুরুষের আন্তঃসম্পর্কজনিত দরকারগুলিকে চিহ্নিত করে একটা সম্পর্ককে দীর্ঘমেয়াদি টিকিয়ে রাখার জন্য যেই যেই চাহিদাগুলো স্ত্রীর থাকে সেগুলো বুঝতে। হেলাল হাফিজের কবিতার মতন, “নিউট্রন বোমা বোঝ মানুষ বোঝ না!”
ভালোবাসার বিয়ের যুগ পেরিয়ে গেছে। সংসার জীবন চলতে চলতে মধ্য বয়সী আজ দুজন। এমন সময় হঠাৎ একদিন ভদ্রমহিলা জানালেন, “আমি আর পারছি না তোমার সাথে,আমাকে মুক্তি দাও।”
ভদ্রলোক কোনভাবেই রাজী নন। ভদ্রমহিলা সামাজিক, অর্থনৈতিক, পেশাগত সবদিক থেকেই নিজেকে এবং সন্তানদেরকে বহনে সক্ষম।
ভদ্রলোক আমাকে বলছেন, “আমি কি তাহলে এতদিনে ইউজ হলাম তার দ্বারা? কারণ এখানে তৃতীয় পক্ষের কোনো অস্তিত্ব আছে বলে আমি নিশ্চিত নই ।”
একটা গান ছিল না “কি আশায় বাঁধি খেলাঘর জীবনের বালুচরে” এই অবস্থা ভদ্রলোকের। এক শব্দে যদি বলি, ভদ্রলোক ভীষণ রিজেক্টেড ফিল করছেন। এখন তার কাছে সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ। তিনি আতঙ্কিত বাবা ছাড়া বাচ্চাগুলোর কি হবে?
এরপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প-
বিবাহ একটি দলিলবদ্ধ সম্পর্ক। এক কলমের খোঁচায় সম্পর্ক তৈরি হয় আবার এক কলমের খোঁচায় সম্পর্ক ভেঙেও যায়। কিন্তু বাবা একটি বায়োলজিক্যাল সম্পর্ক। বাচ্চার শরীরের তেইশটা ক্রোমোজোম বাবার কাছ থেকে আসে। কোনো কিছুতেই এই সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না।
বাচ্চাদের প্রথম হিরো কিন্তু তাদের বাবা। ফলে ওয়াইফের সাথে যদি সম্পর্ক ছিন্ন হয় এবং সেটা হতেই পারে (কিছু কিছু ধর্মে সম্পর্কচ্ছেদের অনুমতি দেয়া আছে আবার রাষ্ট্রীয় বিধানেও সম্পর্কচ্ছেদের অনুমতি আছে)। কাজেই আমার ওয়াইফের সাথে আমার সম্পর্ক ভেঙে গেল দেখে আমার বাচ্চাদেরকে আমি হারিয়ে ফেললাম এই কথাটা ভাবার কোন কারণ নেই।
বাচ্চাদের উপর বাবা এবং মা দুজনেরই অধিকার আছে। অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চারা যার কাছে থাকে তিনি কিন্তু নিজে যা ফিল করছেন, যা ভাবছেন সেই নেতিবাচক চিন্তাগুলো তার সঙ্গীর বিরুদ্ধে বাচ্চাদের মনে ঢুকাচ্ছেন। এই কাজটা একদমই করা যাবে না।
কারণ বাচ্চারা কিন্তু ঠিকই ২০ বছর হোক ২৫ বছর হোক একটা সময় পরে নিজেরা যখন নিজেদের পারিবারিক জীবনে ঢুকবে, নিজে যখন বাবা-মা হবে তখন সে বাবা-মায়ের অসহায়ত্বের জায়গাগুলো আরও ভালোভাবে অনুভব করতে পারবে।
তাই বাচ্চাদেরকে নিজের দলে টানার চিন্তা যদি থাকে সঙ্গীকে অপদস্ত করার জন্য তাহলে এটা একটা অসুস্থ চিন্তা।
জীবন সঙ্গীর সাথে বনিবনা হবে না দেখে দুজন দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে বাচ্চাদেরকে নিজের দলে টেনে একজন আরেকজনের দিকে তীর ছুড়ে ফেলাটা খুবই খারাপ একটা জিনিস, কারণ এতে শিশুমনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে এই দাগ সারা জীবন বাচ্চাদের মধ্যে থাকবে। ভবিষ্যতে সঙ্গী নির্বাচনে তারা এই চিন্তাগুলো থেকে নানাভাবে প্রভাবিত হবে।
কাজেই বাচ্চাদেরকে দুজনের সাথেই সমান ভাবে মিশতে দিন। তাদেরকে তাদের বোধবুদ্ধি মতো বেছে নিতে দিন । বাচ্চারা সবই বুঝে। তাদেরকে তাদের বয়সের সাথে সামঞ্জস্য মিলিয়ে সহজ ভাষায় তথ্যগুলো দিন । বাবা-মা অনেকেরই আলাদা থাকে; যতদিন যাচ্ছে এই কালচার আমাদের সমাজেও বাড়ছে। এখানে আপনার বা আমার কিছু করার নেই।
দুটো পরিণত বয়স্ক মানুষ যদি সিদ্ধান্ত নেয় তারা একসাথে থাকবে না সেখানে শুধু শুধু বাচ্চা দিয়ে বেঁধে রেখে প্রতিদিন ঝগড়া তর্ক করে বাচ্চাদের বাবা এবং মা দুজনের সম্পর্কে নেগেটিভ ফিডব্যাক দেয়ার থেকে তারা যদি আলাদা হয়ে বাচ্চাদের সাথে প্রতিদিন হাসিমুখে যোগাযোগ রাখে বাচ্চারা অতটা খারাপ ফিল করবেনা। না হলে এই বাচ্চাই কিন্তু মায়ের কাছ থেকে খারাপ কথা শুনে বাবাকে অসম্মান করবে আবার বাবার কাছ থেকে খারাপ কথা শুনে মাকে অশ্রদ্ধা করবে। বাচ্চাগুলো প্রচন্ডভাবে নিজেদেরকে শেকড় উপড়ানো ভাববে। নিজেকে কচুরিপানার মতো ভাসমান মনে করবে। না ঘরকা না ঘাটকা। নগর পুড়লে দেবালয় ও রেহাই পায়না। সংসারে আগুন লাগলে তার আঁচ বাচ্চাদের উপর ও পড়বে। এর থেকে রেহাই নেই। এখন দেখতে হবে এই ক্ষত যত দ্রুত বাচ্চাদের শুকায়।
তাই বাচ্চাদের বলতে হবে, “তুমি বাবা এবং মা দু’জনের কাছেই অনেক আদরের। আজকে কোনো কারণে তারা একসাথে নেই তার মানে এটা নয় যে তোমাকে আমরা কেউ কম ভালোবাসি। তুমি যখন চাইবে যার সাথে চাইবে তখন সে ভাবেই তার সাথে থাকতে পারবে।”
বাবা-মার ব্রেকআপের কারণে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি যাতে বাচ্চাদের কোমল মনকে আক্রান্ত না করে সেটাই খেয়াল রাখা বাবা এবং মা উভয়ের প্রয়োজন। বাচ্চাদেরকে দলে টেনে যুদ্ধংদেহী বিধ্বংসী চিন্তা করে জীবনসঙ্গীকে বধ করার প্রচেষ্টা আসলেই অসুস্থ মানসিকতা।
যারা বাচ্চাদের অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করেন তাদের জন্য অনেক ভালোবাসা।