প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন,
বুধবার, ১৩ মে, ২০২০
কখনো কখনো কোন সংবাদ আমাদের করে দেয় মূঢ়, নাড়া দেয় প্রবলভাবে। গত ১২ তারিখ রাত ৩ঃ২৫ মিনিটে অগণিত শুভাকাঙ্খী ও গুণগ্রাহী রেখে না ফেরার দেশে চলে গেলেন কিংবদন্তী প্রফেসর ডা. মীর মাহবুবুল আলম। সিরাজগঞ্জের রায়পুরে ১৯৫৩ সালের ১ আগস্ট জন্ম নেয়া এই নক্ষত্র শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের আইসিইউতে। চলে গেলেন সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে। তার জীবন নিয়ে ও তার অসংখ্য গুণগ্রাহী, সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের থেকে কিছু স্মৃতিচারণ এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হল।
“উনি ৭৭ এর গ্রাজুয়েট আর আমি ৭৮ এর। তৎকালিন আই পি জি এম আর, বর্তমান বি এস এম এম ইউ এ ৮১ সালের জানুয়ারিতে এফ সি পি এস পার্ট-১ এ দেখা। পার্ট-১ পাশ করে আমি আমার পথে, উনি উনার পথে। মধ্যে ১৭ বৎসর আর দেখা নাই। আমি ৯৮ সালে ওসমানী মেডিকেলে আসি। এর কিছুদিনের মধ্যে উনিও সিলেটে আসেন। উনি সার্জারী বিভাগের প্রধান আর আমি মেডিসিন বিভাগের। অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত একসাথে ছিলাম। মধ্যেখানে ১২ বৎসর। কত সমস্যা, ছাত্রদের সেন্ট আপ নিয়ে, পাস/ফেল নিয়ে। উনাকে নিয়ে বসতাম। সমাধান একটা বেরিয়ে আসত। আজ সবই স্মৃতি। উদ্ভুত যেকোন সমস্যায় না বলতে কিছু তার অভিধানে ছিল না।”
ডাক্তার হিসেবে অধ্যাপক ডা. মীর মাহবুবুল আলম ছিলেন কিংবদন্তি। ডা. শান্তনু তালুকদার বলেন,
“স্যার- দ্যা লিজেন্ড, এভারেস্ট অফ সার্জারী, টিচার অব দ্যা টিচার’স, মেডিকেল সাইন্স এর আমার দেখা সাইন্টিস্ট। স্যার আমার ফাইনাল পরীক্ষার এক্সটার্নাল ছিলেন, আমি স্যার এর মেডিকেল অফিসার ছিলাম, সহকারী রেজিস্ট্রার ছিলাম আর রেজিস্ট্রার থাকা অবস্হায় স্যার না ফেরার দেশে চলে গেলেন। বিদায় বেলায় হাজারো স্মৃতি কষ্টের দাবানলের মতো পুড়ে পুড়ে কাঁদাচ্ছে।”
“সিলেট এর নক্ষত্র অধ্যাপক মীর মাহবুবুল আলম স্যার আর নেই। দেশ এমন একটি নক্ষত্র হারালো।”
” স্যার নিজে এমবিএ করেছেন ডাক্তার হয়ে। ছাত্র হয়ে এমবিএ এর ক্লাস করতে যেয়ে প্রফেসরকে বললেন, আপনি বসুন, আমি পড়াই। সেই প্রফেসর এর পাগল হবার দশা ছিলো স্যারের ক্লাস করানো দেখে।”
“স্যার শল্যবিদ্যার চেয়ে বেশী পড়াতেন জীবন দর্শন। প্রথম শোনা, “Common sense is very uncommon. স্যার কখনো টানা পড়াতেন না। বলতেন আমাদের ব্রেইন একবারে ১৫ মিনিটের বেশী কিছু শুনলে সেটা দ্রুত ভুলে যায়। ক্লাসের ফাঁকে নিজের এমবিএ করার গল্প, এলএলবি করার গল্প করতেন। ক্লাসে আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য। অসম্ভব নিপুণতায় মস্তিষ্কে গেঁথে দিতেন প্রাথমিক শল্য-বিদ্যার প্রতিটি অক্ষর। কলেজের এমন কোন কমিটি নেই যেটাতে ছিলো না স্যারের সক্রিয় অংশগ্রহণ, কি একাডেমিক কাউন্সিল, কি খেলাধুলা-গানবাজনা কমিটি, কি কলেজের পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটি।”
“স্যার জ্ঞ্যান বিলাতেন ক্লাশে, সেমিনারে অপারেশন এর টেবিলে, আউটডোর এ গল্পের মাঝে, অথবা হাটতে হাটতে কোন আলাপচারিতায়। স্যারের ক্লাশ যেন একেকটা সেমিনার ছিলো। সারা মেডিকেল এর বড় বড় স্যার ম্যাডাম বসতেন লেকচার গ্যালারির সামনের সারির বেঞ্চে, সকল ইয়ারের ছাত্র ছাত্রীর সাথে। সব বয়সের সবাই যার থেকে কিছু শিখতে চায়। বাংলাদেশের মেডিকেল সেক্টরে স্যারের অবদান অপরিসীম৷ বর্তমান ইন্টার্নিশিপ লগবুক স্যারের চিন্তার ফসল। একাধারে গাইনি, সার্জারী, পরিসংখ্যান, আইনশাস্ত্র, আবহাওয়াতত্ত্ব সহ নানা বিষয়ে স্যারের মত দক্ষ আর সত্যিকার জ্ঞ্যান পিপাসু মানুষ দেখার সৌভাগ্য কম মানুষেরই হয়৷”
“স্যার অসাধারণ ক্লাস নিতেন। ১ ঘন্টার ক্লাসে কেতাবি পড়া থাকত ২০ মিনিট, বাকি সময়ে যা বলতেন সেগুলোই চিকিৎসা জীবনে বেশি কাজে লেগেছে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম স্যারের ক্লাস। সকাল ৭.০০ টার আগেই গ্যালারি পূর্ণ হয়ে যেত। আমার সার্জারিতে আসার মূল প্রেরনা স্যার। সেই সময়ে ওসমানীর যারা সার্জারীতে পড়তে চাইতো, সবারই আইডল ছিলেন স্যার।”