প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. সোনিয়া জেমিন প্রীতি
রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল
স্বর্ণ একটি ধাতু বা মৌল। আসলে এর বেশি কিছুই না। কিন্তু স্বর্ণকে এই উপমহাদেশের নারীরা যতটা যত্ন আত্তি করেন বা এর পেছনে যা ব্যয় করা হয়, তার সিকিভাগও যদি লোহা নামক মৌল বা ধাতুর জন্য করা হতো, তাহলে এড়ানো সম্ভব হতো মারাত্মক কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য যদি কোনো ধাতুকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে হয়, তার সবটুকু লোহার প্রাপ্য। বিশেষ করে নারীদের স্বর্ণের প্রতি আকর্ষণ থাকে বেশি। কিন্তু তাঁদের সুস্থ থাকার জন্য লোহার প্রয়োজন সব চেয়ে বেশি। স্বর্ণ বলতে অনেকেই অজ্ঞান। অথচ কেউ এই লোহাতে গুরত্ব দিয়ে বিনিয়োগ করে না।
অনেক গিন্নি তো স্বামীর কাছে অভিযোগ করেন সোনার গয়না উপহার না পেয়ে। স্বর্ণকে সম্ভব হলে নারীরা কবরে বা চিতায় নিয়ে যেতেও প্রস্তুত। একজন আত্মীয়া কে কাছ থেকে দেখা। মৃত্যুকালে তিনি একটি থলে আঁকড়ে ছিলেন। সে অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। থলেতে ছিল তাঁর জীবনভর ব্যবহার করা ও জমানো স্বর্ণালংকার। আহা স্বর্ণ! সাথে নিয়ে যেতে পারলেন না।
এক ভদ্রমহিলার গল্প জানি তাঁর বাড়িতে ডাকাত পড়ে। একটা ঘরে সবাইকে বেঁধে রেখে সব লুট করে নিয়ে যায়। কয়েকজনকে জখমও করে। ভদ্রমহিলা দোয়া করছিলেন যেন ডাকাতেরা তাঁর গয়নার নাগাল না পায়। ওরা পালিয়ে যাবার পর দেখেন সারা বাড়ি তছনছ। পরিবারের আহতদের দেখেও তিনি স্থির ছিলেন। যখন দেখলেন গয়নার বাক্সটি নেই, তৎক্ষণাৎ মূর্ছা যান এবং বাজে ধরনের স্ট্রোক করেন।
হাসপাতালে একবার এক রোগিনীর হ্যান্ডওভার পাই, একটা মাল্টোফার ইঞ্জেকশন দিতে হবে। (পড়ুন রক্তনালী বা শিরায় দেয়ার উপযোগী লৌহ দ্রবন) হাসপাতালের মত জায়গাতেও তার আপাদমস্তক স্বর্ণালংকারে সজ্জিত। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় তাকে হুলুস্থুল করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। রক্তের হিমোগ্লোবিন এর মাত্রা তাঁর ৭। যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা কমসে কম ১১ থাকতে হবে। জানালেন গয়না না পরলে পরিবারে শান্তি আসে না। লক্ষ্মী থাকে না ঘরে। স্বামীও রাগ করেন। বনেদি পরিবারের রেওয়াজ। স্বর্ণের আলাদা কদর সেখানে। আফসোস হলো। লোহার হয়তো কোনো কদর নেই। সুস্থ থাকতে যে কোন ধাতুটার দরকার তার ধারণা কয়জন রাখে! স্বর্ণ গয়নার অভাবে শরীরের কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু এই লোহার অভাব মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দিতে পারে।
লোহা কি করে আসলে?
মানবদেহের লোহিত রক্তকণিকা লোহিত বা লাল হয় হিমোগ্লোবিন এর কারণে। এই হিমোগ্লোবিন এর মূল উপাদান লোহা বা আয়রন। অক্সিজেন শরীরে একাকী চলাফেরা করতে পারে না। হিমোগ্লোবিন তার দিকে বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দেয়। তৈরি করে অক্সিহিমোগ্লোবিন জুটি। এরপর সমস্ত শরীরে পরিবাহিত হয়। সব কোষ হয়ে ওঠে সজীব প্রাণবন্ত।
জীবন বাঁচিয়ে রাখছে এই লোহা। শরীরকে সুস্থ ও দীর্ঘায়ু করতে পারে এই লোহা, স্বর্ণ না। লোহার অভাবে হতে পারে রক্তশুন্যতা, আর রক্তশুন্যতা শুরু করতে পারে আরো মারাত্মক সব উপসর্গ। ফলে দুর্বলতা, সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়া, মেজাজ খিটখিটে ভাব, মাথাব্যথা, গায়ে ঝিমঝিম, বুক ধড়ফড় করা, ক্ষুধামন্দা দেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন খুব সহজেই শরীরে বাসা বাঁধে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হয়ে পড়ে দুর্বল।
লোহার অভাব কাদের বেশি হতে পারে?
নারী ও শিশুদের সহজেই লোহা বা আয়রনের অভাব জনিত রক্তশুন্যতা দেখা যায়।
ঋতুচক্রের জন্য নারীর শরীরে, গর্ভকালীন সময়ে বাড়তি চাহিদার জন্য রক্তশুন্যতা দেখা যায়।
শিশুর বৃদ্ধি ও বয়ঃসন্ধিকালে এবং রোগ সেরে ওঠার সময়ে এর চাহিদা শরীরে বেশি থাকে। তাই স্বল্পতা দেখা দেয়।
কৃমির সমস্যায় ভুগেন এমন রোগীদেরও এই ঘাটতিজনিত রক্তশুন্যতা দেখা যায়। বিশেষ করে বাচ্চারা কৃমিতে ভোগে বেশি।
এত গুরুত্বপূর্ণ এক মৌল এই লোহা! তাকে মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণীতে আলাদা সম্মান দিয়ে তালিকাভুক্ত করা উচিত ছিল। নতুন সভ্যতার সৃষ্টি করে লোহা, স্বর্ণ না। সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন লোহা দরকার, স্বর্ণ না।
কোথায় পাবেন এই লোহা?
কেটে রাখলে কালো হয়ে যায় এমন ফল মূল শাকসবজিকে সহজেই চিনতে পারেন লোহার উৎস হিসেবে।
*আপেল বেদানা, তরমুজ, জাম, পেয়ারা বেশ সমৃদ্ধ উৎস, সবচেয়ে সহজলভ্য ও সস্তা উৎস কলা। অন্য কোনো ফল হাতের কাছে না পাওয়া গেলেও সারা বছর জুড়ে কলা পাওয়া যায়। ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতিদিন অন্তত দুটি করে পাকা কলা খাওয়া উচিত।
*কাঁচা কলা, কলার মোচা আর কলাগাছ কাটলে ভেতরে যে সাদা শাস বা নরম কান্ডটা পাওয়া যায় তা আয়রনের দারুণ উৎস।
*পালংশাক পুইশাক সহ বিভিন্ন ধরনের শাকে সহজেই পেতে পারেন। সব চেয়ে সমৃদ্ধ উৎস কচুশাক। সেই সাথে কচু, কচুর মুখী, কচুর লতি।
*খুব সহজলভ্য আরেকটি সমৃদ্ধ উৎস মসুরডাল, যা প্রতিদিন খাবারের মেন্যুতে রাখা সম্ভব।
*বিট, শালগম, ব্রোকলি তে পেতে পারেন প্রচুর লোহা।
*লাল চাল, লাল আটা, যব, ভুট্টা, সাগু, কাউন চালে পাওয়া যায়।
*মিষ্টি কুমড়ার বীজ খুব ভালো উৎস।
*বীজ বা দানাদার শস্য তে সহজে পেতে পারেন। যেমন শিমের বিচি, কিডনি বীন, মটরশুঁটি, অরহর ডাল, সরিষা বাটা বা দানাদার সরিষা।
*শুকনো ফল। যেমন শুকনো কিশমিশ, এপ্রিকটে পেতে পারেন লোহা।
প্রতিদিন খাবারের তালিকায় একটা বা দুইটা জিনিস থাকলেই যথেষ্ট।
অনেক লোহা খাওয়া গেলো খেয়াল করলে দেখবেন কচুর সাথে লেবু খেতে বেশ লাগে। আপেলের সাথে চলে আসে কমলার নাম। শুধু যে লোহা খেলেই হবে তা না। লোহা খেয়ে হজম তো করতে হবে! শরীরে আত্তীকরণ করতে ও রক্তে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে ভিটামিন সি। তাই রোজ লোহার সাথে অল্প ভিটামিন সি-ও খান। লোহাকে উপযোগী করার সাথে সাথে ফ্রি রেডিকেল নামক বর্জ ধ্বংস করে ভিটামিন সি।
আরেকটি সতর্কতা: আহারের পরপরই চা, কফি, চকোলেট, কেক ইত্যাদি (ক্যাফেইন সমৃদ্ধ) খাবার খাবেন না। এতে লোহা খাবার থেকে রক্তে শোষণ বাধাগ্রস্ত হয়।
লোহা এত উপকারি আর এত সহজলভ্য যে হাত বাড়ালেই আর সামান্য খরচেই পেতে পারেন। স্বর্ণ গয়নার মত হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে হয় না।
নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখুন। আপনি সুস্থ তো পরিবার সুস্থ। স্বর্ণের চেয়ে লোহা কে বেশি গুরুত্ব দিন। সুস্থ শরীরে গহনার আধিক্য না থাকলেও তা এক বিশাল আশীর্বাদ। আর রোগে কাতর দুর্বল শরীর যতই অলংকারে সাজানো হোক তা সুখের হয় না। তাই দেরি না করে শুরু করে দিন।
স্বর্ণ তোমার বহিরঙ্গে
বসন জুড়ে রাখো
অন্দরমহল লোহাশূন্য
চেয়ে দেখো নাকো?শুভ জীবন, শুভ লৌহভোজ।