প্ল্যাটফর্ম নিউজ
১৩ মে, ২০২০, বুধবার
কঠিন এই মহামারীর সময়ে দেশের সম্মুখ যোদ্ধারা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। যাদের রাত-দিন শ্রমের কারণে আজও আমরা সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে সুস্থতার সাথে দিনাতিপাত করছি। কথা বলছি এমনই একজন যোদ্ধা ডা. সাকলাইন রিফাতের সাথে।
• সম্প্রতি আপনি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল, রংপুরে কাজ করে এসেছেন। হাসপাতালের দিনগুলো কেমন ছিল আপনার?
– প্রথমেই বলতে চাই, সবমিলিয়ে আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা।
হাসপাতালের ডিউটির ১০ দিনের সময়গুলো অনেক ব্যস্ত আর কর্মচঞ্চল ছিল আমার জন্য, আলহামদুলিল্লাহ সুস্থতার সাথে আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে গেছি প্রতিনিয়ত করোনা আক্রান্ত মানুষগুলোর জন্যে।
• করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল শুরুর গল্পগুলো জানতে চাই।
– এই হাসপাতালের শুরুর গল্প টা অন্যরকম। মূলত এটি ১০০ শয্যা শিশু হাসপাতাল হিসেবে উদ্বোধনের অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু যাত্রা শুরুর আগেই, এই করোনা ক্রান্তিকালে ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল হিসেবে এটিকে ঘোষণা করা হয়। গুটি গুটি পায়ে একদম শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে আজ এই হাসপাতাল অনেকটাই পরিণত হয়ে নিরলস ভাবে রংপুর বিভাগের মানুষের আস্থা আর আশার আলোকবর্তিকা হয়ে এগিয়ে চলেছে।
বিভাগীয় কমিশনার মহোদয় থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ, বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগ, সকল সরকারি অফিসের আন্তরিক সহযোগিতা এবং একই সাথে আমাদের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), রংপুর বিভাগের সম্মানিত পরিচালক মহোদয়, রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়, পরিচালক (হাসপাতাল) মহোদয়, সিভিল সার্জন, ডেপুটি সিভিল সার্জন মহোদয় সহ রংপুরের সকল স্তরের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, রংপুর সিটি কর্পোরেশন, মেট্রো এবং জেলা চেম্বার অফ কমার্স এর সহযোগিতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজ এই ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালের গতিময় পথচলা।
• শুরু থেকে যারা হাসপাতালে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের ব্যাপারে কিছু বলেন। কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন
হাসপাতালে কাজ শুরুর পর?
– ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালের শুরু থেকেই তত্ত্বাবধায়কের সাথে যে দুইজন মানুষ নিরলস ভাবে তার চালিকাশক্তির ভূমিকায় থেকে সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছেন, তারা হলেন আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোঃ মাহমুদুর রহমান রিফাত এবং ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মোঃ মোর্শেদুল ইসলাম পিউল। তারা দিনের পর দিন এই ক্যাম্পাসে রয়েছেন, পরিবার পরিজন ছেড়ে। সকল ব্যবস্থাপনা কাজের দেখভাল করে যাচ্ছেন যা সত্যিই প্রশংসনীয় মহৎ কাজ। এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক স্যার থেকে শুরু করে আর.এম.ও, ই.এম.ও এবং আমার কলিগ ডা. মোঃ শিহাব সারার অভি সহ হাসপাতালের নার্সিং স্টাফ, সকল স্টাফের সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি। আমি তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই এবং সুস্থতা কামনা করি।
• ডাক্তারদের শিডিউল কিভাবে তৈরি করা হয়েছে?
– শুরু থেকে দুইজন মেডিকেল অফিসার শিফট অনুযায়ী ১০ দিন করে কাজ করে কোয়ারেন্টিনে থাকছেন ১৪ দিন। এখন রোগীর সংখ্যার অনুপাতে আরও চিকিসৎক সংযুক্ত করার কাজ প্রক্রিয়াধীন।
• হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার মান এবং পদ্ধতি যদি বলতেন।
– আমাদের এই করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ১০০ শয্যা বিশিষ্ট। এখানে ১০টি বেড (আই. সি. ইউ) প্রস্তত রয়েছে সাথে রয়েছে ৯০টি সাধারণ বেড। এখানে রোগী ভর্তির জন্য ভর্তি নিয়মাবলী অনুসরণ করা হয়, যা রোগীর সামগ্রিক শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল।
রোগীর করোনা সংক্রমণের মাত্রা অনুযায়ী, জাতীয় করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এর নির্দেশিকার আলোকে, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সকল বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকবৃন্দের সার্বক্ষণিক পরামর্শ এবং সহযোগিতায় রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করছেন এই হাসপাতালের ধরনের চিকিৎসকবৃন্দ। প্রসঙ্গত, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সম্প্রসারিত অংশ/ইউনিট হিসেবে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও এই আইসোলেশন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এস.এম.নূরুন নবী এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়নে এই করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
• হাসপাতালে ডাক্তারদের জন্য কি কি সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে? পিপিই কেমন পাচ্ছেন, পিপিই পরে কাজ করতে কেমন লাগছে? স্যানিটাইজ করছেন কিভাবে? থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা কেমন?
– হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে। যার গুণগত মান ভাল তবে পিপিই পরে কাজ করা অনেক কঠিন। কিন্তু এই নিরাপত্তা সামগ্রী করোনা আক্রান্ত রোগী দের সংস্পর্শে কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তাই অনেক কষ্ট হলেও সঠিক নিয়মে পিপিই পরেই সবসময় কাজ করে যাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড স্টাফ সহ সকল পরিচ্ছন্নতাকর্মী।
আর করোনা হাসপাতালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ। এই কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে শুরু থেকে ট্রেনিং সেশন পরিচালনা সহ হাসপাতালে জীবানুনাশক প্রয়োগ বিষয়ক মনিটরিং কাজ নিরলস ভাবে করে আসছেন হাসপাতালে নিযুক্ত কারিগরি বিশেষজ্ঞ ডা. মোঃ জয়নাল আবেদিন জুয়েল স্যার।
করোনা হাসপাতাল চত্ত্বরে অবস্থিত ৩ টি সরকারি আবাসিক ভবনে সকল সম্মুখ সারির কর্মীর জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে হাসপাতালের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
• প্রাথমিক স্তরের রোগীদের কি কি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে?
ব্যবস্থাপনাপত্রে কি কি প্রদান করা হচ্ছে?
– প্রাথমিক স্তরের রোগীদের শারীরিক লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
তাদের ব্যবস্থাপত্রে জ্বরনাশক, এন্টিহিস্টামিন,
ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট রয়েছে। এর সঙ্গে গাইডলাইন মোতাবেক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
• আপনার কাছে কোন জরিপ আছে কি? যেমন করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা, প্রতিদিন কি পরিমাণে রোগী ভর্তি হয়, সুস্থতার সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা- এরূপ?
– ১৩/০৫/২০২০ তারিখের জরিপ মতে মোট ভর্তির সংখ্যা ৪৫ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৪ জন। এ পর্যন্ত কেউ মারা যাননি।
• আপনি তো ভালভাবে ডিউটি শেষে কোয়ারেন্টিনে আছেন। তো ডিউটি কালীন অবসর সময়ে কী করতেন? কোয়ারেন্টিনে কোথায় আছেন? কেমন কাটছে কোয়ারেন্টিনের দিনগুলো? কীভাবে সময় যাপন করছেন? পরিবার পরিজন ছেড়ে থাকতে কেমন বোধ করছেন?
– ডিউটি কালীন অবসর সময়গুলো আসলে অনেক ভাল কেটেছে, কারণ আমার সাথে একজন কলিগ ছিলেন একই ফ্ল্যাটে, ডা. শিহাব ভাইয়া। ভাইয়া এবং আমি নিয়মিত ডিউটি শেষে রোগীদের সামগ্রিক পরিস্থিতি আলোচনা করতাম যা কিনা পরবর্তী শিফটে কাজ করার জন্য অনেক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া এই করোনা পরিস্থিতিতে সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে কাজ করার জন্য আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা খুব জরুরী। এজন্য অবসর সময়ে সবসময় আমরা গল্প, ভাল পরিকল্পনা, জীবনবোধ নিয়ে নিজেদের মতামত আদান-প্রদান করেছি, যা এই সময়ে অনেক মানসিক প্রশান্তি যুগিয়েছে। আর ভিডিও কলে ও ফোনে সবসময় পরিবারের সাথে যোগাযোগ এবং ওই সময়ে অনেক বন্ধু, সিনিয়র – জুনিয়র ভাই, শুভাকাঙ্ক্ষী সবসময় মানসিক সাহস যুগিয়েছেন। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ তাদের কাছে।
আলহামদুলিল্লাহ ১০ দিন রোস্টার ডিউটি শেষে এখন পর্যটন মোটেল রংপুরে আছি ১৪ দিন এর কোয়ারেন্টিনে। এখন পর্যন্ত আমি ও আমার কলিগ দুইজনেই ভাল আছি মহান আল্লাহ সুবহানুতায়ালার রহমতে। এখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে থাকা খাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে।
তবে অবশ্যই পরিবার ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয়েছে। কিন্তু সবসময়ে মনে হয়েছে মহান রাব্বুল আলআমিন এই মহৎ কাজে আমাকে মনোনীত করেছেন, আমাকে তাই এই কাজ সঠিক ভাবে সম্পন্ন করতে হবে। এই মনোবল আর চিন্তাভাবনা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছি দেশের এই দুর্যোগ-ক্রান্তিকালে।
• একজন করোনা যোদ্ধা হিসেবে আপনার অনুভূতি কী?
— একজন করোনা যোদ্ধা হিসেবে কথাটা বলার চেয়ে আমি ব্যক্তিগত ভাবে একজন করোনা চিকিৎসায় অগ্রসৈনিক হিসেবে বলতে চাই, আমার এই কাজের অভিজ্ঞতা সত্যিই এতটা তৃপ্তিদায়ক, প্রশান্তিময় এবং ভালবাসামণ্ডিত জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা হবে- আমি শুরুতে ভাবতেও পারিনি। তাই কাজ শেষে আমি এই প্রাপ্তিতে আবেগাপ্লুত এবং তৃপ্ত কারণ কাজের দিনগুলিতে আমি সহকর্মী, সকল স্টাফসহ রোগীদের অনেক দোয়া ও ভালবাসা পেয়েছি, আর তাই এটা আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে মূল্যবান স্মৃতি।
• দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে, করোনা যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলেন।
– আমি মনে করি করোনা যুদ্ধে কাজ করা সকল সৈনিক নিঃসন্দেহে মহৎ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন এই দেশমাতৃকার কঠিন সময়ে। তাই সম্মুখ সমরে কাজ করার জন্য আমাদের যেমন পর্যাপ্ত রসদ দরকার তেমনি দরকার আমাদের দৃঢ় মনোবল ও সাহস। আন্তরিক সেবার মনোভাবে অটল থেকে কাজ করে যেতে হবে আর স্বপ্ন দেখি ইনশাআল্লাহ অচিরেই আমাদের দেশ তথা বিশ্ব এই করোনা মহামারী কাটিয়ে আবার নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাবে নতুন সোনালী ভোরের দিকে।
আমাদের এই কঠিন সময়ে সবাই সবার জন্য দোয়া করি এবং আরও মানবিক হই।
দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমাদের এই দুর্যোগকালীন কঠিন বাস্তবতার দিনগুলি সবাই মিলে মোকাবিলা করতে হবে। একা সরকার অথবা করোনা যুদ্ধের সকল স্তরের কর্মী এখানে যত ভূমিকাই রাখুক না কেন, আপামর জনসাধারণ স্বাস্থ্যবিধি, নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব, সচেতনতা জোরদার না করলে আমাদের সকলের সকল পরিশ্রম আশানুরূপ আশার আলো দেখতে পারবেনা তাই আমি দেশবাসীকে বিনীত অনুরোধ জানাই, আমাদের সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে আরও সক্রিয়ভাবে এই করোনা যুদ্ধ মোকাবিলায়। ঘরে থাকি, নিরাপদে থাকি এর পাশাপাশি বলতে চাই ‘করোনার_বিরুদ্ধে
চলো লড়ি একসাথে।’
আমাদের সময় দিয়েছেনঃ
ডা. সাকলাইন আরেফিন
মেডিকেল অফিসার (সংযুক্তি আদেশে)
ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতাল
নিজস্ব প্রতিবেদক/ মো সারোয়ার জাহান