প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৫ জুলাই ২০২০, রবিবার
ডা. ফাহমিদা রশীদ স্বাতি
সহকারী অধ্যাপক
গাইনি
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
“কাছে যাওয়া বড্ড বেশি হবে
এই এখানে দাঁড়িয়ে থাকাই ভালো,
তোমার ঘরে থমকে আছে দুপুর
বারান্দাতে বিকেল পড়ে এলো।”
সন্তানের অসুখে মা কি কাছে যাবেননা? উত্তরটা এমন – প্রয়োজন না হলে সুরক্ষা ছাড়া কাছে যাওয়া যাবে না, এটাই চিকিৎসার নিয়ম।
অনেক কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত গর্ভবতী নতুন মা হয়েছেন, অনেক মায়ের দুগ্ধপানরত শিশু আছে। সব মা পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময়ে নিজের সন্তানকে নিরাপদে রাখতে চান। মায়েরা ভীতি থাকে এই ভেবে যে, “আমি আমার সন্তানকে আক্রান্ত করে ফেলবো না তো?”
বিজ্ঞান কি বলে এ ব্যাপারে জেনে নেই-
ফিডিংরত কোভিড মায়ের শিশুকে তিনভাবে পাওয়া যায়ঃ
১) হাসপাতালে কোভিড মায়ের নবজাতক শিশু।
২) ছয় মাসের কম বয়সী কোভিড মায়ের শিশু, যে শুধু মায়ের বুকের দুধের উপর নির্ভরশীল।
৩) ছয় মাসের বেশি বয়সী ফিডিংরত শিশু, যে মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবারও খাচ্ছে।
কোভিড আক্রান্ত মা কি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন?
এই ব্যাপারে সকল পরিষদের (CDC,WHO) মতের অমিল নেই।
“মা কোভিড আক্রান্ত থাকা অবস্থায় শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবে। কারণ, এখনো পর্যন্ত কোন গবেষণায় বুকের দুধে ভাইরাস পাওয়া যায়নি। তাই বুকের দুধ খাওয়ানো সম্পূর্ণ নিরাপদ।”
কেন বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে ?
ব্রেস্ট ফিডিং করাবে কি না সেটা মায়ের কিংবা পরিবারের ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্ত হলেও বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন মা যেন আক্রান্ত অবস্থায়ও ব্রেস্ট ফিডিং অর্থাৎ বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যান। কেননা, মায়ের বুকের দুধ বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বলা হয়, যত সংক্রামক রোগ আছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই। মায়ের কোভিড-১৯ সংক্রমণ হলে এর বিরুদ্ধে যে এন্টিবডি তৈরী হয় তা দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে গিয়ে তাকে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ হওয়া থেকে সুরক্ষা দেয়।
কিভাবে বুকের দুধ খাওয়াবেন?
WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) ও RCOG এর তথ্যানুসারেঃ
জন্মের সাথে সাথে ১ ঘন্টার মাঝে সতর্কতা অবলম্বন করে মা শিশুকে কোলে নিয়ে, বুকের সাথে বুক লাগিয়ে (skin to skin contact) বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।
CDC এর মতেঃ
সংক্রমণ কমানোর জন্য জন্মের পর পর বাচ্চাকে সাময়িক আলাদা করে রাখা উচিত। মা ভাল না হওয়া পর্য়ন্ত (প্রায় ১০-১৪ দিন) আলাদা রাখতে বলেছেন তারা। তবে আলাদা থাকা অবস্থায় অন্য একজন দায়িত্ব নিয়ে মায়ের এক্সপ্রেস দুধ খাওয়াবে শিশুকে।
আমরা বাংলাদেশে কি করব তা আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রিস্ক কোথায় হবে সেই সাথে লাভ কোথায় হবে পরিবারকে তা বুঝে এগোতে হবে। তবে “ওজিএসবি” বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পথ ধরে এগোনোর জন্য আমাদের উপদেশ দিয়েছেন।
ফিডিং / বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মা এর সতর্কতাঃ
১) মা নিঃশ্বাসের হাইজিন মেনে চলবেন খাওয়ানোর সময়। মাস্ক পরে শিশুকে দুধ খাওয়াবেন, তবে শিশুর নাক-মুখ ঢাকার দরকার নেই।
২) শিশুকে খাওয়ানোর আগে ও পরে হাত ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে অথবা ৬০% এলকোহল সমৃদ্ধ হ্যান্ড-স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।
৩) যদি খাওয়ানোর সময় হাঁচি-কাশি হয় তাহলে হাতের কনুই বা টিস্যুতে কাশি দিতে হবে। এরপর ব্যবহৃত টিস্যু ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে এবং হ্যান্ড-স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিস্কার করে নিতে হবে। যদি মায়ের বুক খোলা অবস্থায় হাঁচি-কাশির ড্রপলেট/কণা মায়ের বুকে পড়ে সাথে সাথে তা সাবান পানি দিয়ে পরিস্কার করে নিয়ে তারপর শিশুকে কোলে নিয়ে আবার দুধ খাওয়াতে হবে।
৪) রুমের যে সব জায়গায় বার বার মা বা শিশুর হাত লাগার সম্ভাবনা আছে সেসব জায়গা জীবাণুনাশক দিয়ে প্রতিদিন পরিস্কার করতে হবে।
৫) মায়ের মাঝারি শ্বাসকষ্টের কারণে মা নিজে শিশুর যত্ন নিতে না পারলে বা দুধ খাওয়াতে কষ্ট হলে, বাচ্চাকে এক্সপ্রেসড দুধ খাওয়াবেন। যেখানে তার একজন সহকারী এ কাজে সাহায্য করবেন।
৬) দুধ এক্সপ্রেস করার সঠিক নিয়ম অবশ্যই মানতে হবে।
৭) যদি তীব্র শ্বাসকষ্টের কারনে ফিডিং করানো কিংবা মিল্ক এক্সপ্রেস করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়, তাহলে বুকের দুধ খাওয়ানো সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে পুনরায় দুধ খাওয়ানো অর্থাৎ মা সুস্থ হলে দুধ খাওয়ানো (relactation),
দুধ মা (wet nutsing) অথবা অন্য একজনের তোলা দুধ (donor milk) খাওয়ানোর কথা মাথায় রাখতে হবে। কোনভাবেই পাউডার দুধ দেওয়া যাবেনা।
সর্বোপরি, উপরের কোনটা করবে তা মায়ের সার্বিক অবস্থা চিন্তা করে পরিবার সিদ্ধান্ত নিবেন।
৮) মায়ের যদি পরপর তিনদিন কোভিড-১৯ এর কোন উপসর্গ না থাকে অথবা উপসর্গ শুরু হওয়ার পর থেকে ১০ দিন অতিবাহিত হয়, তাহলে মা সরাসরি শিশুকে বুকের দুধ দিতে পারবেন।
৯) সরাসরি বা পাম্প যেভাবেই হোক না কেন সারাদিনে শিশুকে ৮-১০ বার দুধ খাওয়াতে হবে।
হাসপাতালে নবজাতকের কোভিড-১৯ আক্রান্ত মাঃ
১) আক্রান্ত মায়ের শিশুর জন্য ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা কোনোভাবেই যেন পটের দুধ খেতে বলা না হয়।
২) স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিশুকে হাসপাতালে একই রুমে রাখার কথা বলেছে WHO। বিশেষ করে শিশুর ল্যাকটেশন প্রতিষ্ঠিত হবার আগ পর্যন্ত। যদিও CDC বলেছেন আলাদা রুমে রাখতে। আলাদা রুমে যদি সম্ভব না হয় তাহলে একই রুমে ৬ ফুট দূরত্বে মা এবং শিশুকে রাখতে হবে। সম্ভব হলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায় এরকম Baby Cot এ রাখতে হবে (Temperature Controlled Isolette)। এটা অবশ্য আমাদের দেশে নেই। যখন মা কোভিড নেগেটিভ হয়ে যাবেন তখন আর এটার দরকার হবে না।
ব্রেস্ট পাম্প করা/ এক্সপ্রেস করার নিয়মঃ
১) বোতল ধরা বা বোতল দিয়ে খাওয়ানোর আগে, ব্রেস্ট পাম্প করার আগে, ব্রেস্ট পরিস্কার করার আগে মা ভালোভাবে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিবেন।
২) পাম্প করার আগে মা মাস্ক পরে নিবেন।
৩) পাম্পযন্ত্র পরিষ্কার করবে মা বা তার সাহায্যকারী।
৪) দুধ এক্সপ্রেস করে বোতলে নেয়ার সাথে সাথে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং বোতলের গায়ে দুধ এক্সপ্রেসের তারিখ ও সময় মার্কার দিয়ে লিখে সাথে সাথে ফ্রীজে রেখে দিতে হবে।
৫) হাসপাতালে ভর্তিরত কোন শিশুর বেলায়, যে জায়গায় এক্সপ্রেস করছেন, মা কাজ শেষে সে জায়গাটা পরিষ্কার করে নিবেন।
৬) পাম্প করার পর পাম্পের সব পার্ট আলাদা করে রানিং পানিতে ধুতে হবে। এরপর সব পার্ট সাবান ও গরম পানি দিয়ে ধুয়ে শুকনো করে নিয়ে একটা বড় পাত্রে ঢাকনা দিয়ে রাখতে হবে, যাতে জীবানুর সংস্পর্শে না আসে।
৭) পাম্প যে পাত্র ও ব্রাশ দিয়ে ধুবে তাও পরিস্কার করে ধুয়ে শুকিয়ে রাখতে হবে।
৮) সম্ভব হলে স্যানিটাইজার মেশিন দিয়ে সবকিছু দিনে একবার হলেও জীবানুমুক্ত করতে হবে।বিশেষ করে ঝুকিপূর্ণ শিশুদের বেলায়।
৯) নির্দিষ্ট একজন লোক পাম্প করা দুধ শিশুকে খাওয়াবে প্রতিদিন এবং সবসময় পরিষ্কার বাটি-চামচ দিয়ে খাওয়াবেন, বোতল দিয়ে নয়।
ফিডিং এর ব্যাপারে মাকে বলা ও বুঝানোঃ
মা বা শিশু যারই কোভিড হোক না কেন, পরিবারকে পাশে থাকতে হবে। মাকে পর্যাপ্ত সাপোর্ট ও মানসিক শক্তি যোগানো খুবই জরুরি। বাচ্চাকে কীভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করবে বা চালিয়ে যাবে তার যৌক্তিক সমাধান পরিবারকে স্বাস্থ্য কর্মীদের সাথে পরামর্শ করে বের করতে হবে। যদি মা সবসময় ভয়ে থাকেন যে সে তার শিশুকে আক্রান্ত করতে পারেন বা সে নিজে যদি মনে করেন যে তিনি সরাসরি খাওয়ানোর সতর্কতা অবলম্বন করতে পারবেন না তাহলে এক্সপ্রেসড দুধ খাওয়ানোই যৌক্তিক হবে। কেননা আক্রান্ত মায়ের যে কোনো দুশ্চিন্তা তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দিবে।
বিশেষ সতর্কতা কোভিড আক্রান্ত মায়ের শিশুর বেলায়ঃ
CDC নীচের কয়েক গ্রুপের শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানোর সময় অবশ্যই আলাদা রুমে রাখার কথা বলেছেন-
১) প্রিম্যাচিওর শিশুকে। এদের মায়ের বুকের দুধ পান করানো না গেলে মায়ের অসুস্থতার জন্য CDC তাদের পাস্তুরিত ডোনার দুধ খাওয়ানোর কথা বলেছেন। আমাদের দেশে এটি কতটুকু সম্ভব তা অবগত নয়।
২) শিশুর বয়স তিন মাসের কম হলে কিংবা দূর্বল শিশু যার অন্য সমস্যা আছে তাদেরকেও আলাদা রাখা আবশ্যক।
সদ্য প্রসব হওয়া আক্রান্ত মায়ের শিশুঃ
প্রসবের পর কোভিড মায়ের শিশুকে কোভিড পজিটিভ ধরে নিতে হবে এবং প্রতিটি নবজাতকের RT-PCR করতে হবে মুখ বা নাক থেকে সোয়াব নিয়ে। তা করতে হবে বাচ্চার ২৪ ঘন্টা বয়সে একবার। তখন যদি নেগেটিভ রিপোর্ট আসে তাহলে ৪৮ ঘন্টা বয়সে আরো একবার করতে হবে। তবে বাচ্চা পজিটিভ হলে আর আলাদা রুমে রাখার দরকার নেই CDC এর মতে।
৩) যে সব যায়গায় নবজাতকের টেস্ট এর সুবিধা নেই সেখানে মা নেগেটিভ হওয়া পর্যন্ত আলাদা রাখতে বলেছেন CDC।
৪) নবজাতককে হাসপাতালে অন্য শিশু থেকে আলাদা রাখতে হবে।
৫) এ পর্যন্ত গবেষণায় ১২ মাসের কম বয়সী শিশুদের কোভিড হলে ঝুঁকি আছে বলে জানা গেছে। দেখা গেছে অনেকের Guillain-Barre Syndrome, Kawasaki Disease ও হয়েছে। বড় বাচ্চাদের সাধারণত কোভিড কম হতে দেখা গেছে বা হলেও উপরের সমস্যা গুলো হতে দেখা যায়নি।
তবে সিডিসি হোক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হোক, RCOG বা OGSB হোক- এক ব্যাপারে সবাই একমত কোভিড আক্রান্ত মা অবশ্যই শিশুকে দুধ খওয়াতে পারবে, তবে সতর্কতা মেনে। সরাসরি হোক বা এক্সপ্রেস দুধ হোক, মায়ের দুধের চেয়ে বিকল্প কিছু পৃথিবীতে এখনো তৈরী হয়নি, কোনদিন হবেও না।এটা স্রষ্টার বিশেষ দান- শিশুকে পৃথিবীর সব জীবাণু, সব রোগ থেকে রক্ষা করার জন্য।।