প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮শে জুলাই, ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. ফাহমিদা রশীদ স্বাতি
সহকারী অধ্যাপক
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
কোভিড রোগীর প্রসব:
কোভিড সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে, ইদানিং আক্রান্তের মধ্যে গর্ভবতীর সংখ্যাও কম নয়। এদের অনেকেই আবার প্রেগন্যান্সির শেষ দিকে। কারো সিজারের ডেট বা কারো ডেলিভারি ডেট সন্নিকটে। অথবা কেউ কেউ কোভিডের কারণে প্রিমেচিওর প্রসব বেদনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তাই এসময় আক্রান্ত গর্ভবতীকে জানিয়ে রাখতে হবে যে গর্ভকালীন শেষের দিকে কোভিড হলে অনেক সময় প্রিমেচিউর লেবার পেইন উঠতে পারে। সবাইকে নির্দেশনা দিতে হবে- ডেলিভারির ব্যথা ওঠার সাথে সাথে যেন হাসপাতালে ভর্তি হয়।
কোভিড রোগীর ডেলিভারি কখন?
-কোভিড রোগীর কোভিডের কারণে ডেলিভারি/সিজারের আগে ভাগে ব্যথার ওষুধ দিয়ে ব্যথা তুলে ডেলিভারি করানোর কথা কোন গাইডলাইন বলে না। ডেলিভারির জন্য প্রতিটি রোগীকে আলাদা ভাবে বিবেচনায় আনতে হবে। রোগীর শারীরিক অবস্থা, গর্ভস্থ শিশুর বয়স- সব বিবেচনায় এনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি করতে হবে। রোগীকে বলে রাখতে হবে সিজার বা নরমাল যেভাবেই হোক না কেন পেটের ভেতর থাকা অবস্থায় মায়ের কাছ থেকে শিশুর শরীরে ভাইরাস যাওয়ার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি।
নরমাল ডেলিভারি:
বর্তমান সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে কোভিড রোগীর সেবায় “ট্রায়াজ” শব্দটা খুবই জনপ্রিয়। আসলেই এ ব্যাপারটা খুবই জরুরি। রোগী হাসপাতালের গাইনী ওয়ার্ডে আসার পর ট্রায়াজ করে, রোগী ও বাচ্চার অবস্থা যাচাই করে দুজনেই ভাল আছে কিনা দেখে নিতে হবে। এরপর ব্যথাটা ডেলিভারির ব্যথা কি না কনফার্ম করতে হবে এবং ডেলিভারি নরমাল না সিজার করতে হবে তা যাচাই করতে হবে।
-কোভিড পজিটিভ কিন্তু কোন উপসর্গ নেই, এমন রোগীর ডেলিভারির সময় যদি সর্বক্ষণ সিটিজি সুবিধা থাকে, তাহলে তা দিয়ে মনিটর করতে হবে। তা না থাকলে কিছুক্ষণ পর পর হাতে ধরা যে ছোট ডপলার আছে তা দিয়ে মনিটর করতে হবে। এখনো পর্যন্ত উপসর্গবিহীন রোগীর প্রসবের সময় কোভিডের কারণে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হয় এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তবে ডেলিভারির সময় যদি মায়ের শ্বাসকষ্ট হয় বা সেচুরেশন কমে যায় তখন মায়ের অবস্থার উন্নতির জন্য হয়তো সিজার লাগতে পারে সাথে সাথে।
-ডেলিভারি অন্যান্য সব ডেলিভারির মতোই পার্টোগ্রাফ দিয়ে মনিটর করতে হবে।
-লেবার যদি ধীর গতিতে আগায় প্রয়োজনে অক্সিটোসিন দিতে বা এআরএম করতে কোন বাঁধা নাই।
-কোভিড সাসপেক্ট/কনফার্ম যাই হোক না কেন, আইডিয়ালি তাদেরকে ডেডিকেটেড নেগেটিভ প্রেসার রুমে ডেলিভারি বা সিজার করানো উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের ৯৯.৯% হাসপাতালেই সে ব্যবস্থা নাই।
-কোভিড রোগীর সাথে প্রসবের সময়টায় লেবার রুমে তার বাসার কাউকে রাখা উচিত না (সংক্রমণ এর ঝুঁকি কমানোর জন্য)। যদি রাখতে হয় তবে তাকে লেভেল-২ পিপিই পরিয়ে রাখতে হবে।
-ডেলিভারি রুমে ডেডিকেটেড প্রেসার মেশিন, পালস অক্সিমিটার থাকতে হবে।
-ডেলিভারি বা সিজার রুমে যত কম স্বাস্থ্যকর্মী রাখা যায় তত ভাল।
-প্রতিটি কোভিড রোগীকে ডেলিভারি/সিজারের সময় মাস্ক পরিয়ে রাখতে হবে।
-কোভিড রোগীর প্রসবের শেষ ধাপের (২য় ধাপ) সময় কমানোর জন্য ফরসেপ বা ভেন্টোজ নামক যন্ত্রের সহায়তা নেয়া যায়। কেননা অন্তিম সময়ে যখন পুশ করতে হয় তখন মাস্ক পরার কারণে মা পুশ করতে পারে না। তাই এ যন্ত্রগুলোর সাহায্য নিলে মা ও বাচ্চা দুজনের কষ্ট কমানো যায়। এছাড়া এর ব্যবহারে প্রসবে এরোসল কম তৈরি হয় ও সময় কম লাগার কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকিও কমে যায়। তাছাড়া প্রসবের শেষ দিকে হঠাৎ যদি বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হয় বা মার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, তখন এ যন্ত্র দুটোর যে কোন একটার সাহায্যে ডেলিভারি তাড়াতাড়ি করিয়ে বাচ্চাকে বিপদ মুক্ত করা যায়।
-যদি এরোসল বক্স থাকে তাহলে পুশ করার সময় সংক্রমণ কমানোর জন্য তা ব্যবহার করা যায়।
-ডেলিভারির পর এএমটিএসএল সবারই করতে হবে, সিজার বা নরমাল যাই হোক না কেন।
-ডেলিভারিতে কোন প্রতিষ্ঠানে সুযোগ থাকলে এপিডুরাল এনেস্থিসিয়া দেয়া যাবে।
-ডেলিভারির পর প্রোফাইলেকটিক ট্রানেক্সামিক অ্যাসিড বা মিসোপ্রসটোলও দেয়া যাবে। কারণ শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে ঘন ঘন দেখার সুযোগ কম।
সিজার:
যদি কোন কোভিড আক্রান্তের ইলেকটিভ সিজারের ডেট থাকে তাহলে ঝুঁকি যাচাই করে ডেট পেছানো যায় কি না চিন্তা করতে হবে। কারণ কয়দিন অপেক্ষার পর মা যদি নেগেটিভ হয়ে যায়- এরপর সিজার হলে মা ও শিশু দু’জনের ঝুঁকিই কমে যায়।
-কিছু কিছু ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি সিজার লাগতে পারে যেমন -মা যদি শকে চলে যায়, মায়ের তীব্র কোভিড চিকিৎসার জন্য বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হলে বা মার সাপোর্টিভ কেয়ারে সমস্যা হলে বা বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হলে।
-স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকির কথা চিন্তা করে স্পাইনাল এনেস্থিসিয়া দেয়াটা নিরাপদ ও বিবেচনায় রাখতে হবে। কিন্তু দরকার হলে অবশ্যই জেনারেল এনেস্থিসিয়া দেয়া যেতে পারে। তবে এতে এরোসল তৈরি করে বলে পুরো টিমকে সঠিক পিপিই পরিধান করতে হবে।
-কোভিড রোগীর সিজারের জন্য ডেডিকেটেড ওটি ও লেবার রুম প্রয়োজন। যদি তা না থাকে তাহলে যে ওটি রুম আছে তাতেই করে এরপর জীবানুনাশক (১% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড) দিয়ে পরিস্কার করে ৪-৬ ঘণ্টা রুম বন্ধ রেখে আবার ব্যবহার করা যাবে- আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে।
-কম সময়ে নিরাপদ ভাবে ওটি সম্পন্ন করতে হবে।
-লোক যত কম রাখা যায় তত সুরক্ষা।
-ভালো হয় যদি এনেস্থিসিয়া দেয়ার পর সার্জন ও টিম ওটি রুমে যায়।
-ওটি চলাকালীন সময়ে সর্বক্ষণ দরজা বন্ধ রাখতে হবে।
-যত কম কটারি মেশিন ও সাকার ব্যবহার করা যায় তত সংক্রমণ এর ঝুঁকি কমবে।
স্টেরয়েড:
বাচ্চা প্রিমেচিওর হলে ডেলিভারির আগে বাচ্চার ফুসফুস ম্যাচিওর হবার জন্য মাকে স্টেরয়েড ইনজেকশন দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে তীব্র শ্বাসকষ্টের মায়ের ক্ষেত্রে। কেননা এই ইনজেকশন কাজ করার জন্য যত সময় লাগে ততক্ষণ ডেলিভারি দেরি করলে ওই সময়ের মধ্যেই মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাই এই ইনজেকশন দেয়ার আগে শিশু ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত।
প্রসবে মা’র মনিটরিং:
প্রসব বেদনাকালীন সময়ে মায়ের জ্বর, শ্বাস রেট, সেচুরেশন মনিটর করতে হবে প্রতি ঘণ্টায়-ঘণ্টায়। মাথায় রাখতে হবে সেচুরেশন যাতে ৯৪% এর উপরে রাখা যায়।
-ডেলিভারি শেষে ৬ ঘণ্টা মাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। কেননা মায়ের পোস্টপার্টাম হেমোরেজ (পিপিএইচ) হয় এ সময়ে সবচেয়ে বেশি।
-জন্মের পরপর সব শিশুকে নিওনেটাল ওয়ার্ডে পাঠাতে হবে।
সতর্কতা:
-সিজার/নরমাল ডেলিভারিতে ২ জোড়া গ্লাভস পরা উচিত এবং কাজ শেষে সংক্রমিত বাইরের গ্লাভস জোড়া রুম থেকে বের হবার আগেই ক্লোরিন সলিউশনে ফেলে আসতে হবে।
-প্রসবের পর মা ও শিশুর যত্নের জন্য হাসপাতালে রোগীর সাথে যে লোক থাকবে বা রোগীর স্বামীকে সঠিক সুরক্ষা নিতে হবে এবং সম্ভব হলে তাদেরও কোভিড টেস্ট করিয়ে নিতে হবে।
– রোগীর সাথের লোকদের সাবধান করে দিতে হবে যেন হাসপাতালে যত্রতত্র ঘুরাঘুরি না করে। এতে তাদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়াবে।
-রোগী পরীক্ষা, ট্রান্সফার এর সময় সংশ্লিষ্ট সবার লেভেল-২ পিপিই পরিধান করতে হবে।
-রোগী ট্রান্সফার এর সময় ডেডিকেটেড ট্রলি বা হুইল চেয়ার ব্যবহার করা উচিত।
-ডেলিভারি (সিজার/নরমাল) এর সময় স্বাস্থ্যকর্মীকে লেভেল-৩ পিপিই পরতে হবে।
-কাজ শেষ হবার সাথে সাথে ডফিং করতে হবে অতি সতর্কতার সাথে। কেননা স্বাস্থ্যকর্মীর বেশিরভাগেরই আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে এ সময় এবং সব ব্যবহৃত জিনিস বন্ধ বিনে ফেলতে হবে।
-অপারেশন/ডেলিভারির পর সব যন্ত্রপাতি ১% হাইপোক্লোরাইড সলিউশন-এ ৩০ মিনিট চুবিয়ে রেখে তারপর অটোক্লেভ করতে হবে।
-অপারেশন/ডেলিভারি পরবর্তী সব জৈব বর্জ্য বন্ধ কন্টেইনার এ ফেলতে হবে। এরপর যিনি তা পরিষ্কার করবেন তাকে লেভেল-২ পিপিই পরে কাজ করতে হবে।
-কোন আক্রান্ত রোগীর এবরশন এর পর বের হওয়া প্রোডাক্ট বা ডেলিভারির পর গর্ভফুলকে সংক্রামক হিসেবে ধরে নিতে হবে এবং এসব ১% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড দিয়ে জীবানুমুক্ত করে তবেই ফেলতে হবে নিদিষ্ট জায়গায়। সম্ভব হলে এগুলো থেকে স্যাম্পল নিয়ে আরটি-পিসিআর করতে পাঠানো উচিৎ।
-নরমাল বা সিজার যে উপায়েই ডেলিভারি হোক না কেন, কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে কোন তাড়াহুড়ো করা যাবে না। যে ধরনের সেবাই লাগুক না কেন উপযুক্ত পিপিই পরিধান করে সঠিক সুরক্ষা নিয়ে কাজ করলে রোগী, বাচ্চা ও স্বাস্থ্যকর্মী সবাই নিরাপদ থাকবে।
-বেশিরভাগেরই আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে এ সময় এবং সব ব্যবহৃত জিনিস বন্ধ বিনে ফেলতে হবে।
-অপারেশন/ডেলিভারির পর সব যন্ত্রপাতি ১% হাইপোক্লোরাইড সলিউশন-এ ৩০ মিনিট চুবিয়ে রেখে তারপর অটোক্লেভ করতে হবে।
-অপারেশন/ডেলিভারি পরবর্তী সব জৈব বর্জ্য বন্ধ কন্টেইনার এ ফেলতে হবে। এরপর যিনি তা পরিষ্কার করবেন তাকে লেভেল-২ পিপিই পরে কাজ করতে হবে।
-কোন আক্রান্ত রোগীর এবরশন এর পর বের হওয়া প্রোডাক্ট বা ডেলিভারির পর গর্ভফুলকে সংক্রামক হিসেবে ধরে নিতে হবে এবং এসব ১% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড দিয়ে জীবানুমুক্ত করে তবেই ফেলতে হবে নিদিষ্ট জায়গায়। সম্ভব হলে এগুলো থেকে স্যাম্পল নিয়ে আরটি-পিসিআর করতে পাঠানো উচিৎ ।
নরমাল বা সিজার যে উপায়েই ডেলিভারি হোক না কেন, কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে কোন তাড়াহুড়ো করা যাবে না। যে ধরনের সেবাই লাগুক না কেন উপযুক্ত পিপিই পরিধান করে সঠিক সুরক্ষা নিয়ে কাজ করলে রোগী, বাচ্চা ও স্বাস্থ্যকর্মী সবাই নিরাপদ থাকবে।