প্ল্যাটফর্ম নিউজ, বুধবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২০
[ঢাকার কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটালের (CMH) সম্মানিত আইসিউ কনসালট্যান্ট মেজর ডা. খালিদ মাহবুব করোনা ভাইরাসের সাথে তাঁর যুদ্ধ করে ফিরে আসার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন।]
কোভিড-১৯: এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা
( A story of survival from Corona Virus)
শুরুটা ছিল হাল্কা কাশি আর নাকে পানি দিয়ে। কয় দিন ধরে কেমন যেন ক্লান্ত লাগছিল। মাংসপেশীতে এবং হাড্ডিতে ব্যথা হচ্ছিল। দেরি না করে প্যারাসিটামল আর অ্যান্টিহিস্টামিন খাওয়া শুরু করলাম। সারাদিন অনেক দৌড়াদৌড়িতে থাকতে হতো তাই ভাবছিলাম হয়তো এর জন্য বেশি দুর্বল লাগছে। প্যারাসিটামল খাওয়ার পর মাংসপেশির ব্যথা কমে গেল আর এন্টিহিস্টামিন এর জন্য নাকের পানিও কিছুটা কমে গেল। কিন্তু এখন জানি কেমন মনে হচ্ছে যে একটু হাটাহাটি করলে খুব দুর্বল লাগছে। হালকা কাশিও। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পর কেমন যেন শরীরটা একটু গরম গরম লাগতেছিল। থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখি ১০২ জ্বর। কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না। সিনিয়র স্যারকে জানালাম। স্যার সাথে সাথে বললেন হসপিটালে চলে আসতে এবং টেস্ট করাতে। সেদিন রাতে হাসপাতালে চলে আসি। পরেরদিন স্যাম্পল দেই টেস্ট করতে। সবাই আশ্বস্ত করছিল যে এটা নরমাল ভাইরাল ফিভার হবে এবং রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে। কিন্তু সন্ধ্যায় জানতে পারলাম রিপোর্ট পজিটিভ। এটা শোনার পর কিছুক্ষণ মাথার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। মাথা কাজ করছিল না। কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না। পুরা বাকরুদ্ধ অবস্থা। নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করলাম।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে এই রোগে ৮০% রোগিই থাকে Asymptotic, মানে ৮০% রোগির কোন লক্ষণই থাকে না। তারা বুঝতে পারে না যে তারা করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অথবা হাল্কা কাশি আর জর দিয়েই এরা সেরে যায়। এই রোগীরা হচ্ছে খুব ভয়াবহ কারণ এরা কখন কাকে সংক্রমিত করে দেয় বোঝা মুশকিল। বাকি ২০% রোগীর জটিলতা হয়। এদের একাধিক অঙ্গহানি হবার ঝুঁকি বেশি। এর মদ্ধে ৫% এর আইসিইউ লাগে।
রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর আরও কিছু চিকিৎসা শুরু করা হলো। পরের দিন বুকের পরীক্ষা করে নিউমোনিয়া পাওয়া গেল। যুক্ত হল আরো নতুন কিছু ওষুধ।
জ্বর তখনও কমে নি, ১০২ থেকে ১০৪ পর্যন্ত জ্বর থাকে। প্যারাসিটামল সাপোজিটরি, ইঞ্জেকশন, ট্যাবলেট কোন কিছুতেই জ্বর কমছে না। প্যারাসিটামল দিনে চারবার করে নিয়েও জ্বর কমে না। একটানা ৭ দিন জ্বর ছিল। এর মধ্যে একবারও জ্বর পুরোপুরি ছেড়ে যায় নি। সুতরাং প্যারাসিটামল যত কম খাওয়া যায়, ততই ভালো। না হলে লিভারের ক্ষতি হবে, লিভার এনজাইমগুলো বেড়ে যাবে।
এরপর আসা যাক অন্য পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা। লিভার ফাংশন টেস্টসহ বাকি টেস্টের ফলাফল অস্বাভাবিক হওয়া শুরু করল। আরও নতুন নতুন ওষুধ যোগ হতে থাকলো।
পরের দিন শরীরের দুর্বলতা আরো বেড়ে গেল। একটু নড়াচড়া করতেই ব্রেথলেসনেস শুরু হলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না এটা কি শ্বাসকষ্ট নাকি ব্রেথলেসনেস। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছিল না যে এটা এজমা জাতীয় শ্বাসকষ্ট। পালসঅক্সিমিটার এনে অক্সিজেন স্যাচুরেশন দেখার চেষ্টা করলাম। দেখি অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮৩-৮৪%। প্রথমে ভাবলাম মেশিন নষ্ট তাই আরেকটা মেশিন নিয়ে আসলাম কিন্তু তাতেও দেখি একি রিডিং দিচ্ছে। পালমোনোলজিস্ট স্যারকে জানালাম। উনি সাথে সাথে অক্সিজেন শুরু করলেন। অক্সিজেন দেয়ার পর দেখি কিছুটা আরাম লাগছে। পরে বোঝা গেল যে আমি হাইপোক্সিয়াতে চলে যাচ্ছিলাম। অক্সিজেন সেচুরেশন ফল করছিল। হাই ফ্লো (৪-৬ লিটার) অক্সিজেন দেয়ার পর অক্সিজেন স্যাচুরেশন আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করলো। আইসিইউতে শিফট করা হলো।
এদিকে ফুসফুসের জটিলতা বেড়ে গেল। ফুসফুসের বায়ুথলিগুলো বন্ধ হওয়া শুরু করছে। হাই ফ্লো অক্সিজেনেও স্যাচুরেশন ৯০-৯২%। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বুকটা চেপে আসছে। মনে এক অজানা ভয় কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল কখন যেন ভেন্টিলেটরে চলে যাই। সে এক ভয়ঙ্কর অনুভূতি। শুরু করলাম প্রোন ভেন্টিলেশন। প্রতি ২ ঘন্টা পর পর শোয়ার ভঙ্গি বদলাতে থাকলাম। পানি খাওয়া কিছুটা কমিয়ে দিলাম। অক্সিজেন সাপোর্ট সবসময়ই লাগতো। অক্সিজেন দিয়ে রাখতাম কারণ নইলে হাইপোক্সিয়ার জন্যে হিমোগ্লোবিন বেড়ে যেত, যা ফলশ্রুতিতে একাধিক অঙ্গহানি করতে পারতো।
৩-৪ দিন পর থেকে ফুসফুসের কিছুটা উন্নতি হওয়া শুরু করল। এর পর শুরু করা হলো শাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম। আর প্রোন ভেন্টিলেশন তো আছেই। এতদিন একদম বিছানায় পড়ে ছিলাম। এখন একটু একটু করে হাটাহাটি শুরু করলাম। আস্তে আস্তে অক্সিজেন স্যাচুরেশন বাড়তে শুরু করল। এর সাথে অক্সিজেনের ফ্লোও কমায়ে নিয়ে আসা হলো। এখন মোটমুটি ২ লিটার ফ্লোতে ৯৫-৯৬% হয়।
এতক্ষণ যা বললাম গল্পের মতন মনে হলেও পথটা এতোটা সহজ ছিলনা। এক দিকে মানসিক দুঃচিন্তা আর অন্যদিকে শারীরিক দুর্বলতা, সব মিলিয়ে কোনঠাসা ছিলাম। নিজে আইসিইউ ডাক্তার হয়েও রোগীর বিছানায় শুয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমার। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি যে আল্লাহ আমাকে রোগ থেকে শেফা দিয়েছেন। সেই সাথে ধন্যবাদ দিতে হয় আমার চিকিৎসকদের, বিশেষ করে কনসালটেন্ট ফিজিসিয়ান মেজর জেনারেল ডা. আজিজ, চীফ ফিজিসিয়ান ব্রিগেডিয়ার ডা. আসিফ, পালমনোলজিস্ট ব্রিগেডিয়ার ডা. আজিজ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. ফাইজ ইমন এবং ইন্টেনসিভিস্ট কর্নেল ডা. মাসুদুল আলম মজুমদার, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. সাদাত বিন সিরাজ, মেজর ডা. আরিফুল হক শাওনদের যাদের সময় উপযোগী চিকিৎসা, সিদ্ধান্ত, মনিটরিং এবং যথাসময়ে সকল প্রকার ওষুধের ব্যবস্থা করা আমার জন্যে, যা ছাড়া হয়তো আমার অবস্থার উন্নতি সম্ভব ছিল না। সে সাথে ধন্যবাদ জানাই প্যাথলজিস্ট এবং মাইক্রোবায়োলজিস্টদের। সাথে কৃতজ্ঞতা জানাই সিএমএইচের কমান্ডেন্ট, ডেপুটি কমান্ডেন্ট এবং এমওআইসি করোনা ওয়ার্ডদের, যারা সবসময় আমার খোজখবর রেখেছেন এবং সাথে আমার পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
তবে সব চিকিৎসার মূলে হলো মনোবল শক্ত রাখা এবং আল্লাহর উপর অগাধ আস্থা রাখা। আইসিইউ তে থেকে মনোবল শক্ত রাখা আসলেই খুব দুরুহ ব্যাপার। তারপরও চেষ্টা করেছি মনোবল শক্ত রাখার। পরিবারের কথা চিন্তা করলেও মনটা ভেঙ্গে আসতো। জানি আমার স্ত্রী, মা বাবা, ভাই বোন, শাশুড়িসহ সকল আত্মীয়-স্বজন আমার সামনে খুব শক্ত থেকে আমাকে মনোবল দেবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু এর অন্তরালে লুকিয়ে ছিল অশ্রুসিক্ত চোখ, মানসিক দুশ্চিন্তা ও আল্লাহর নিকট দোয়ার হাত।
অনেকেই অনেক উৎসাহ অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানাই। অনেকেই ফোন করেছেন, মেসেজ দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন। চেষ্টা করেছি রিপ্লাই দেবার। অনেক ক্ষেত্রে পেরেছি অনেক সময় পারিনি। কথা বলতে কষ্ট হতো তাই হয়তো অনেক সময় ফোন রিসিভ করতে পারিনি। আসলে আপনারা আমার এত খোঁজখবর নিয়েছেন যে আমি কখনো একাকীত্ব অনুভব করি নি। সবসময় নিজেকে ডাইভার্ট রাখার চেষ্টা করেছি। আপনাদের ফোন এবং মেসেজ আমাকে ডাইভার্ট করে রাখতে অনেকাংশে সাহায্য করেছে সে জন্য আবারো আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। আমার কোর্সমেটদের কথা না বললেই নয় তারা আমার জন্য যা করেছেন সেটা গভীরতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি গর্বিত এমন কোর্সমেট পেয়ে।
গতকাল আমার দ্বিতীয় বারের মত টেস্ট করে নেগেটিভ পাওয়া গেল রিপোর্ট। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আজ হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ বাসায় আসলাম।
(পরিমার্জিত)/নিজস্ব প্রতিবেদক