প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ মে, ২০২১, সোমবার
ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ
জনস্বাস্হ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রধান নির্বাহ, স্বাস্হ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন এবং সিনেসিস হেলথ এবং স্বাথ্য বাতায়ন
গত মে মাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এপ্রিলের তুলনায় বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণরেখা ও মৃত্যুহার নিম্নমুখী। জনস্বাস্থ্য বিধিকে সামনে রেখে লকডাউনের মাধ্যমে চলাচল সীমিতকরণ কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। গত এপ্রিল ৫ তারিখ হতে লকডাউন, জনসচেতনতা ও বাধ্যতামূলক সহায়তায় এখন করোনার সংক্রমণ ৭ হাজার থেকে কমে ১৫’শ তে দাঁয়িয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে সংক্রমণ কমে গেলেও জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে এমন পরিস্থিতিতে স্বস্তি অনুভব করার কিছু নেই বরং শংকিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নতুন করে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল। সংক্রমণ এড়াতে এই ঈদে ‘কর্মস্থলে অবস্থান’ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ছুটি কমিয়ে ৩ দিনে করা হয়। পাশাপাশি বন্ধ করে দেওয়া হয় গণপরিবহন এবং খুলে দেওয়া হয় শপিং মল। সব গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও এ বছর ঈদে ঢাকা ছেড়েছে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যখন মৃতদেহ সৎকারের জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না, নেপালে যখন অসহায় মানুষ চেয়ে চেয়ে প্রিয়জনের চলে যাওয়া দেখছে, তখন আমরা দেখছি কীভাবে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ হেঁটে, রিকশায়, ভ্যানে, মোটরসাইকেল, পণ্যবাহী ট্রাকে চেপে বাড়ি ফিরছে। এমনকি হাজার হাজার মানুষ গাদাগাদি করে কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে তাও দেখতে পাচ্ছি। এসব স্থানে ছিল না কোনও সামাজিক দূরত্বের বালাই, বেশিরভাগ মানুষকে সেই অর্থে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করতেও দেখা যায়নি। দেশে যখন সংক্রমণের হার কমছে, তখন এহেন পরিস্থিতি আবারও আমাদের এপ্রিল মাসের অবস্থায় নিয়ে যায় কিনা, তা দেখার বিষয়। তবে যদি সকল বিষয়ে কঠোর হওয়া যায়, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন অর্থবহ করা যায়। তাহলে করোনা সংক্রমণ আরো অর্থবহ হবে। গত ৪-৫ দিন থেকে সংক্রমণ আবার বাড়ছে। তাই সকলের উচিত আগামী কমপক্ষে দু’মাস সতর্ক থাকা। সেই সাথে মেনে চলতে হবে আরো কিছু জরুরি বিষয়বস্তু।
১) সংক্রমণ হার কমাতে প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা:
আগামী ১৪ দিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ৬৫ লাখ মানুষ ছুটি শেষে আবারও ঢাকাসহ সারা দেশে ঢুকেছে এবং ঢুকছে। যেহেতু গণপরিবহনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়নি, তাই ফেরাটা হবে আগের মতো কষ্ট করেই। এবার শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশকেই পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। এত মানুষকে কোয়ারেন্টিন করাও বিশাল চ্যালেঞ্জ। সেক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার পাশাপাশি সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি চলমান বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে।
২) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার:
করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্ক্রিনিং, কন্টাক্ট ট্রেসিং, বেশি বেশি পরীক্ষা ও আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। অন্তত আগামী ১ মাস কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে যেসব মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন তাদের স্বেচ্ছায় আইসোলেশনে যেতে হবে। এই কাজে স্বয়ংক্রিয় লোকেশন ট্র্যাকিং মোবাইল অ্যাপও সংযুক্ত থাকে, যার মাধ্যমে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। ইতোমধ্যে বেশি সংক্রমিত দেশগুলো এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ফল পেয়েছে। আমরা আমাদের সংক্রমণপ্রবণ এলাকাগুলোতে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারি। টেলিহেলথ সেবা-স্বাস্থ্য বাতায়ন-১৬২৬৩ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
৩) টিকাদান কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি ও বিকল্প টিকার খোঁজ করা:
গণটিকা কর্মসূচি প্রয়োজনের তুলনায় ধীরগতিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আমরা একটা টিকার ওপর নির্ভরশীল এবং বিকল্প টিকা সংগ্রহের ব্যবস্থা হলেও তা এখনও হাতে এসে পৌঁছায়নি। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ইতোমধ্যে যারা প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন, তাদের বড় একটি অংশ দ্বিতীয় ডোজের টিকার অপেক্ষায় রয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে টিকা মজুত আছে, তাতে আর সপ্তাহখানেক টিকা কার্যক্রম চালানো যাবে। কিন্তু এখনও ক্রয়কৃত টিকা হাতে না পাওয়ার কারণে টিকাদান সম্ভব হচ্ছে না। সমন্বিতভাবে এগুলো নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। ১৩ কোটি মানুষের জন্য অন্তত ২৫ কোটি ডোজের দরকার হবে, তবেই আমরা এই করোনা রোগ প্রতিরোধ করতে পারবো। তবে জরুরিভাবে আগে ৫টা শহরে টিকাদান করা প্রয়োজন, তাতে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটাই কমবে।
৪) বয়োজ্যেষ্ঠদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে:
পরিবারে পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তির স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান তথ্য অনুযায়ী, ৮০ ভাগের ওপরে মৃত্যু ৫০ বছরের বেশি বয়সের মানুষের হচ্ছে। বিনা প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। যারা এই মুহূর্তে করোনায় ভুগছেন অথবা মৃদু উপসর্গ দেখা দিয়েছে; দুই পক্ষকেই হাসপাতাল বা ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। রোগীর অবস্থা খারাপ না হলে হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে হবে। টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।
৫) হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায়:
ভারতের অবস্থা থেকে আমাদের দ্রুত শিক্ষা নিতে হবে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের জোগান দিতে হবে। হাসপাতালে করোনার বেড বাড়াতে হবে, আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর ইত্যাদির সংখ্যা বাড়াতে হবে। করোনা প্রতিরোধে তথ্য প্রদান একটি বড় অন্তরায়। এখনও আমরা কোন হাসপাতালে কতগুলো আইসিইউ বেড আছে, কতগুলো ফাঁকা আছে তার কোনও ডাটাবেজ তৈরি করতে পারিনি। যে কারণে করোনা চিকিৎসায় রোগীদের ভোগান্তি বাড়ছে। রোগীরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে আইসিইউ বেডের জন্য ছুটছেন। ডিজিটাল ডাটাবেজের মাধ্যমে এগুলো সমাধান করার উদ্যোগ নিতে হবে। রোগী ব্যবস্থাপনায় আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ফ্রন্টলাইনারদের সব সময় প্রস্তুত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় জনবল ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে। কোভিড-১৯ চিকিৎসার সাথে যারা কাজ করছেন তাদের উৎসাহিত করতে হবে। টেলিমেডিসিন সেবাকে হাসপাতাল সেবার সাথে সংযুক্ত করতে হবে।
৬) মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি:
আমাদের মূল করণীয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাস্ক ব্যবহার করা। আমাদের সার্বক্ষণিক এবং সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ঘরের বাইরে গেলেই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও সংস্থা যেগুলো আছে, তাদের জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসতে হবে। সারা দেশের মসজিদ, মন্দির, মহল্লা, ওয়ার্ড; সবখানে করোনার টিকা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
৭) দেশব্যাপী সারভাইলেন্স সিস্টেম ও করোনা প্রতিরোধে গবেষণা:
আমাদের করোনা সংক্রান্ত গবেষণায় মনোযোগ দিতে হবে। তাতে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা যাবে। করোনা পরিস্থিতি ১ বছরের বেশি পার হলেও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে করোনা সতর্কতার বিষয়ে তেমন কোনও ক্যাম্পেইন চোখে পড়েনি। সবার কাছে করোনা প্রতিরোধ বিষয়ক তথ্য পৌঁছে দিতে সকল পর্যায়ে সৃজনশীল প্রচারণা দরকার। সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা; এমনকি করপোরেট সংস্থাগুলোও এ কাজে এগিয়ে আসতে পারে। আমরা যতভাবে মানুষের কাছে যেতে পারবো, তত তারা সতর্ক হবে; প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনাও জোরদার হবে।
৮) সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন:
দেশে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ প্রণীত হয়েছে। করোনা মহামারিতে সময় এসেছে এই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের। আইনের উদ্দেশ্য পূরণে বিশেষ করে এর ৫ অনুচ্ছেদের ক ও ঘ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল এবং এর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিস্তার থেকে জনগণকে সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে কর্মকৌশল প্রণয়নসহ সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সংক্রমিত এলাকাকে সংক্রমণমুক্ত এলাকা থেকে পৃথককরণ, সংক্রমণমুক্ত এলাকায় উক্ত রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ এবং আক্রান্ত এলাকায় পুনঃআবির্ভাব প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির অধীনে আনতে হবে।
উল্লেখ্য, মে মাসের শুরু থেকে দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমতে শুরু করে। ২২ মে পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ৮৭ হাজার ৭২৬ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ১২ হাজার ৩৪৮ জন। সর্বমোট সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ২৯ হাজার ৭৯৮ জন।
ইতিমধ্যেই দেশে করোনা প্রতিরোধে সরকারিভাবে নানান প্রশংসনীয় উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। দেশের জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাত নতুন একটি মহামারি এবং রোগ প্রতিরোধে নিয়ে কাজ করছে যা সরকার গুরুত্ব সহকারে সহায়তা করছে। করোনা মোকাবিলায় দেশব্যাপী হাজার হাজার চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, কয়েক লাখ স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যারা চিকিৎসকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। সাধারণ জনগণও নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলে দেশ জয়ী হবে। সকলে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলুন ও সুস্থ থাকুন।