প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার
কোভিড-১৯ আক্রান্ত বা আক্রান্ত অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা বা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিল এমন শিশু-কিশোরদের মধ্যে “মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রোম ইন চিলড্রেন”(এমআইএস–সি) দেখা যাচ্ছে। এপ্রিল মাসে এটি প্রথমে যুক্তরাজ্য ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকেরা শনাক্ত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সম্প্রতি এ নতুন অসুস্থতার সঙ্গে করোনাভাইরাসের (কোভিড–১৯) সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন। ২১ বছরের কম বয়সীরা এতে আক্রান্ত হচ্ছে। এটিকে “পেডিয়াট্রিক ইনফ্লামেটরি মাল্টিসিস্টেম সিনড্রোম”ও (পিআইএমএস) বলা হয়। কোভিডের সাধারণ উপসর্গ শ্বাসকষ্ট বা কাশি নেই, এমন শিশুদের মধ্যেও এ জটিলতা দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সিডিসি।
এদিকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তাদের হাসপাতালে ১৫ মে প্রথম এমআইএস–সি শনাক্ত হয়। মে মাসের শেষ দিকে আরেকটি শিশু শনাক্ত হয়। একজনের বয়স তিন মাস, অপরজনের দুই বছর। এদের প্রচণ্ড জ্বর, ডায়রিয়া, চোখ ও ঠোঁট লাল হয়ে যাওয়া এবং পায়ে হালকা ফোলা ভাব ছিল। পরে দুই বছরের শিশুটির করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। তবে এ পর্যন্ত এ হাসপাতালে এমআইএস–সি আক্রান্ত ১৭টি শিশু শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম ঐ দুই শিশুর এমআইএস–সি আক্রান্ত হওয়ার তথ্য সিঙ্গাপুর জার্নাল অব কার্ডিওলজি তাদের সাময়িকীতে তুলে ধরে। এতে জানানো হয়, নিউইয়র্ক সিটি স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, তাদের ৬৪টি শিশুর এমআইএস–সি শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত ১৫টি শিশু শনাক্ত হয়। পাঁচ ও সাত বছর বয়সী দুটি ছেলে শিশু ৮মে মারা যায়। জন্স হপকিন্সের সাময়িকীতে ২২মে প্রকাশিত এক নিবন্ধে শিশু–কিশোরদের ক্ষেত্রে নতুন ধরনের এ সিনড্রোমকে বিরল উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, জ্বরের সঙ্গে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়, তার মধ্যে রয়েছে অস্বাভাবিক দুর্বলতা ও অবসাদ, লাল ফুসকুড়ি, পেটে ব্যথা, বমি ও ডায়রিয়া, ঠোঁট লাল হওয়া ও ফেটে যাওয়া, চোখ লাল হয়ে ওঠা এবং হাত–পা ফুলে যাওয়া এবং সেইসাথে কাওয়াসাকি রোগের অসুস্থতার মিল রয়েছে। এ দুই ধরনের অসুস্থতায় শরীরের রক্তনালিতে প্রদাহ দেখা দেয়। এ প্রদাহ রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যা হৃদযন্ত্র, কিডনি, লিভার এবং অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতিসাধন করতে পারে। এটা চিকিৎসায় ভালো হয়। ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলে বা সংস্পর্শে আসার চার সপ্তাহের মধ্যে এটি দেখা দিতে পারে। এমআইএস–সি আরোও শনাক্ত করা হয়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে। পাঁচ ও সাত বছর বয়সী দুটি মেয়ে শিশু চিকিৎসাধীন রয়েছে। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ১২ দিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ৩১ আগস্ট বাড়ি ফিরেছে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর। তবে তিন শিশুরই করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল এসেছে।
ইউনাইটেড হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. মো. সেলিম শাকুর এমআইএস–সি সম্পর্কে বলেন, প্রাপ্তবয়স্কদের কোভিড-১৯ সাধারণত অস্বাভাবিক প্রদাহ ও রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধার ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ,
“বিশেষ করে ফুসফুস মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত হতে পারে। আর শিশুদের কোভিড-১৯ এর উপসর্গ খুব কম হয়। তবে বর্তমানে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় এবং সম্ভবত ভারত উপমহাদেশেও (এখনো অপ্রতিবেদিত) পরিলক্ষিত হয়েছে যে, কিছু শিশুদের এই রকম প্রদাহ জনিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একাধিক শারীরিক প্রনালী মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত হয়েছে। যাকে বলা হয়েছে “মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রোম ইন চিলড্রেন” (এমএসআই-সি)। আর এর মধ্যে কাওয়াসাকি বা কেডি সাদৃশ্য রোগ অন্যতম। কেডি রোগটিকে পূর্বে একটি বিরল রোগ মনে করা হলেও বর্তমানে এই রোগ বেশি করে চিহ্নিত হচ্ছে। এটি একটি মারাত্মক রোগ। এই রোগে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা সাধারণত আক্রান্ত হয় তবে কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট এমএসআই-সি ও কেডি বা কেডি সাদৃশ্য রোগ শিশুদের দেখা যাচ্ছে। উপসর্গের মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে এবং রোগ নির্ণয়ের কোন নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। কেডি একটি সার্বক্ষণিক জ্বর জনিত রোগ এবং হৃদপিন্ডের ধমনীর প্রদাহ ও ধমনীকে অস্বাভাবিক ভাবে স্ফীত করতে (২৫%) পারে ও হৃদপিন্ডের প্রানঘাতী ক্ষতি করতে পারে। কেডি রোগ হওয়ার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ না থাকলেও পরিবেশ জনিত কারণ বিশেষ করে ভাইরাস সংক্রমণ স্পর্শকাতর শিশুদের কেডি রোগের উপসর্গকে বিকশিত করতে পারে। কেডি এর প্রধান উপসর্গের মধ্যে কমপক্ষে ৫ দিনের বেশী বিরামহীন জ্বরের সাথে চোখ লাল হওয়া, জিহ্বা লাল হওয়া, ত্বকে লালচে রাশ, হাত, পা লাল হয়ে ফুলে যাওয়া, গলায় ব্যথা, গলার লিম্ফ গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, হৃদপিন্ডের স্পন্দন বৃদ্ধি, পিত্তথলিতে পানি জমা (হাইড্রপস গলব্লাডার) ইত্যাদি। জ্বরের সাথে উপরের আর যে কোন ৪ টি উপসর্গ থাকলে কেডি রোগ নির্ণয় করা হয়। তবে বর্তমানে কোভিড-১৯ আক্রান্ত কেডির আরও কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গ দেখা যায়। যেমন- পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, বমি, হৃদপিন্ডের মাংসপেশীর প্রদাহ, নিম্ন রক্তচাপ, হার্ট ফেইলিউর, শকে যাওয়া ইত্যাদি যা এমএসআই-সি এর অংশ।
কেডি বা এমএসআই-সি এর অন্তর্ভুক্ত কারোই ফুসফুসে ক্ষতি করে না যা প্রাপ্তবয়স্কদের তীব্র কোভিড-১৯ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ। ২৫% কেডি রোগীদের অপর্যাপ্ত বা অবৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গ থাকে যা রোগ নির্ণয়ে বিভ্রান্তি ও বিলম্ব করতে পারে ও এই ধরনের রোগীদের হৃদপিন্ডের ধমনী আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। এই সব ক্ষেত্রে ইকোকার্ডিওগ্রাম এর মাধ্যমে হৃদপিন্ডের ধমনী স্ফীত দেখা গেলে রোগ নির্ণয় করা সহজ হয়। তবে, যথাযথ চিকিৎসা জ্বরের প্রথম ১০ দিনের মধ্যে ও হৃদপিন্ডের আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে শুরু করলেই ভালো ফল পাওয়া যায় যদিও ঐ সময় অসম্পূর্ণ কেডি অনেক সময় নির্ণয় করা কঠিন হয়ে থাকে। কেডি বা কেডি সাদৃশ্য রোগ ছাড়াও কোভিড-১৯ সাথে অন্যান্য শারীরিক প্রনালীর প্রদাহ (এমএসআই-সি) থাকতে পারে। এর মধ্যে বিষাক্ত শক সিনড্রোম, হৃদপিন্ডের মাংস পেশীর প্রদাহ, মূত্র যন্ত্রের প্রদাহ ইত্যাদি। যুক্তরাজ্যের আরসিপিসিএইচ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের স্বাস্থ্যবিভাগ বর্তমানে বৈশ্বিক কোভিড-১৯ মহামারীতে শিশুদের জ্বরের সাথে চোখ লাল, পেটে ব্যাথা , গলায় ব্যাথা, ত্বকে লালচে রাশ, ডায়রিয়া, হৃদপিন্ডের স্পন্দন বৃদ্ধি আছে কিনা সে ব্যাপারে শিশু চিকিৎসকদের লক্ষ্য করতে বলেছে।
এই ধরনের রোগ নির্ণয়ের ও দ্রুত চিকিৎসার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও (১৫ই মে ২০২০) প্রায় একই ধরনের উপদেশ ও সতর্কতা দিয়েছে। তবে এই ধরনের কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট রোগে উদ্বিগ্ন না হয়ে শিশু বিশেষজ্ঞ ও অভিভাবকদের একটু সচেতন ও সতর্কতাই যথেষ্ট।