০৬ এপ্রিল, ২০২০: আজকে বউ এর হোম কোয়ারেন্টাইনের ৪র্থ দিন। বেড রুমের দরজার সামনে চেয়ার। প্রতিবেলায় সেই চেয়ারে খাবার রেখে আসি আর বউ এসে রুমে নিয়ে যায়। আমি থাকি পাশে গেস্ট রুমে। গত বুধবার সাসপেক্টেড কোভিড রোগীর কন্টাক্টে আসার পর থেকে এভাবেই চলছে আমাদের সংসার।
বুধবার রাত ১২ টায় বউ যখন হাসপাতাল থেকে ফোনে জানালো সারাদিনই একটা সাসপেক্টেড রোগীর এক্সপোজারে ছিলো তাই কাল থেকে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে, তখন আমি অন্য হাসপাতালে ডিউটিরত। এত রাতে ডিউটি ছেড়ে বাসায় নিয়ে আসার ব্যবস্থাও নেই। দুইজনেরই ২৪ ঘন্টা ডিউটি শেষ হবে সকালে। সারা রাত কিভাবে কেটেছে আল্লাহ ভালো জানেন।
সকালে বাসায় ফোন দিয়ে আম্মাকে আগে ভাইয়ার বাসায় পাঠালাম। বয়স্ক মানুষদের রিস্ক বেশি তাই সাবধানতা নিলাম আগেই। বউকে গাউন, মাস্ক, গগলস পরিয়ে বাসায় এনেই পাঠিয়ে দিলাম বেড রুমে।
আমার ২ সপ্তাহের জামা কাপড় আর কিছু জরুরী জিনিস নিয়ে চলে আসলাম গেস্ট রুমে।
তারপর থেকে চলছে আমাদের হোম কোয়ারেন্টাইনের দিনগুলো। লক ডাউনে অনেকে হ্যাশট্যাগ স্টে হোম স্ট্যাটাস দিচ্ছে আর আমরা নিরুপায় হয়ে বাসায় বন্দী।
সকাল-বিকাল বউ এর জন্য আনাড়ি হাতে এটা ওটা বানিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা করি। দুপুর আর রাতের খাবার চার তলায় ভাইয়ার বাসা থেকে মান্না সালওয়ার মত নাজিল হয়, আলহামদুলিল্লাহ।
ডাইনিং আর বেড রুমের দুই মাথায় দুইটা সোফা রেখেছি। প্রায় ২০ ফুট দূর থেকে কখনো জোরে, কখনো ইশারায় কথা বলি। দুইজন বই এর স্তুপ নিয়ে বসেছি, বই পড়ি, বই এর কথা আদান প্রদান করি। গুড নাইট বলে পাশের রুমে ঘুমাতে যাই কিন্তু অজানা আতংক কখনো পিছু ছাড়েনা। প্রতিরাতে মনে হয় কাল সকালে উঠে দেখবো তো ও সুস্থ আছে? সকালে উঠে যদি দেখি জ্বর, কাশি নেই মনে হয় আজ আবার নতুন জীবন ফিরে পেলাম।
এভাবেই কেটে যাক আরো কয়েকটা সকাল। তারপর যেন মুক্তি মিলে এই যন্ত্রনাময় দিনগুলোর। দেখি, শুনি, বলি কিন্তু ছুঁতে পারিনা। এই কষ্ট বোঝানো অসম্ভব।
নিজের হাসপাতালের ৭ জন ডাক্তারকে গত মাসে বিভিন্ন সময়ে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছি। তখন শুধু ফোনে তাদের কষ্টের কথা শুনতাম কিন্তু এখন নিজেরাই সেই যন্ত্রনার সাক্ষী।
যে জায়গায় এখন ইউরোপ আমেরিকা পৌঁছেছে আমরা সেই পথে সবে যাত্রা শুরু করলাম। অনেক ডাক্তার আগামী দিনে এই যুদ্ধে নিজেদের বিলিয়ে দিবে। তাতেও হয়ত মানুষের এইসব ডাক্তারদের দোষ দেয়া থেমে থাকবে না। হয়ত এই জনপদে এক সময় দোষারপ করার জন্যও কোন ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও আমরা স্বপ্ন দেখি আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাবেন। কারণ এই মহামারী কোন ডাক্তার, সরকার, শিল্পপতি আটকাতে পারবে না এক আল্লাহ ছাড়া।
যদি আপনজনকে ভালোবাসেন, তাহলে কিচ্ছু করতে হবে না। একটাই অনুরোধ, বাসায় থাকুন। এমন এক রোগ! ভালোবাসার মানুষটাকে আপনিই ছুঁতে পাবেন না। দূর থেকে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই।
দোয়া করবেন যেন বাকী দিনগুলো সুস্থ্যভাবে কাটিয়ে দিতে পারি। আম্মা তার বিছানা ছাড়া রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারে না। আরো কয়েকটা সকাল দ্রুত কেটে যাক যেন আম্মা তার বিছানায় আবারো নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারে।
লেখকঃ
ডা. আলী হোসাইন মাহীদ
সিনিয়র মেডিকেল অফিসার,
ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কল্যানপুর, ঢাকা