প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ- ৩৭
” গভীর নদীর নিঃশব্দে বয়ে চলা স্রোতগুলো “
লেখকঃ জামান অ্যালেক্স
১….
কোনো এক বুধবার।ছুটি নিয়েছিলাম।একটু বেলা করে উঠে আয়েশ করে চা খাচ্ছি আর পেপার পড়ে পড়ে পাতা উল্টাচ্ছি…
বিনোদন পেইজে এসে প্যান্ট-শার্ট পড়া এক লাস্যময়ী তরুণীর ছবি দেখে ধাক্কা খেলাম।সাধারণত এই অংশগুলো অ্যাভয়েড করি, সময় আছে, তাই ভিতরে কি আছে তা পড়া শুরু করলাম….
তরুণী নাকি হাল আমলের জনপ্রিয় নায়িকা, তরুণদের হৃদয়ের ঝড়।ছবির পাশে তার সাক্ষাতকার ছাপা হয়েছে। ইনিয়ে বিনিয়ে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, ছবির কারণে প্রায়ই তাকে দেশের বাইরে কাটাতে হয়, মেক্সিকান খাদ্য তার খুব পছন্দ।তার পছন্দের পোষাক -শার্ট ও প্যান্ট। তার ফ্যানদের উদ্দ্যেশ্যে তাকে কিছু বলতে বলা হলে তিনি উপদেশ দিলেন , ‘দেশকে ভালোবাসুন’। বিনোদন পেইজের এহেন খবরে আমি তখন বেশ বিনোদিত……
২….
এবার কোন এক শুক্রবার।এদিনটায় সাধারণত মূল পেপারের সাথে একটি বর্ধিত অংশ থাকে। বর্ধিত অংশের শেষ পাতায় এসে দেখি বড় করে এক টাকলা’র ছবি, পোষাক-আসাকে, কানের বেঢপ দুলে ও চোখের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রথম দেখায় মানসিক রোগী বলে মনে হলো….
ভিতরে পড়তে গিয়ে ভুল ভাঙলো।যাকে দেখে মানসিক রোগী বলে মনে করেছিলাম, উনি আসলে গিটারিস্ট….
উনার সম্পর্কে যেভাবে লিখেছে, তা পড়ে উনাকে আগে থেকে চিনতে না পারার কারণে নিজের মধ্যে ক্ষুদ্র অপরাধবোধ জেগে উঠলো….
পাগলা সাহেব, থুক্কু, গিটারিস্ট সাহেবের দৈনন্দিন জীবন কিভাবে কাটে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া।সকাল ১১ টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে প্রতিদিন ৩০ মিনিট গিটারে টুংটাং করেন।মাথায় একেক দিন একেক কালারের গামছা বেধে বিকালে অভিজাত পাড়ায় হাটতে বের হন।তার হবি–বিভিন্ন রকম সুগন্ধি যোগাড় করা, এ ব্যাপারে ফ্রান্স তার বিশেষ পছন্দ…..
৩…..
লেখাপড়ার চেয়ে কঠিন কিছু নেই- এই কনসেপ্ট নিয়ে দিনকাল কাটাচ্ছিলাম…
৩-৪ বছর আগে হঠাৎ একদিন পেপারের ফ্রন্ট পেইজে দেখি হিমালয় পর্বতমালার ছবি, ইনসেটে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে যিনি আরোহণ করেছেন -তার হাস্যজ্জল ছবি।ভিতরে পড়লাম।তার পর আরো কয়েকদিন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত লাইভ অনুষ্ঠান চললো।যিনি পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছেন তার কথাবার্তা শুনলাম…
এবার আমার কনসেপ্ট ভাঙলো। আমি বুঝতে পারলাম–আমি আসলে বোকা,পর্বতশৃঙ্গ জয় করার কাছে লেখাপড়ার কষ্ট তুচ্ছ…..
৪……
আমার পছন্দের খেলা দাবা ও ক্রিকেট।ক্রিকেটাররা এদেশের মিডিয়ায় কতটুকু হাইলাইটেড তা আমার না বললেও চলবে। তবে ব্যক্তিগত পারফরমেন্সের কারণ ছাড়াও প্রায়ই তারা মিডিয়ায় আরেকটি কারণে আলোচিত হন।আবেগপ্রবণ বাঙালি জাতি এদেরকে প্রায়ই বরণ করে নেন ফ্ল্যাট, গাড়ী ও বাড়ির চাবি দিয়ে। Subcontinent বাদে এরকম আবেগের অযাচিত বহিপ্রকাশ অন্য কোথাও আছে বলে আমার মনে হয় না। ব্যাপারটি চিন্তিত হবার মতই…..
একটি সভ্যতা সামনে অগ্রসর হয় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে।আমাদের মিডিয়া যাদের নিয়ে লম্ফঝম্ফ করে তারা সভ্যতার অগ্রসরে কতটা ভূমিকা রাখে তা আমার জানা নেই। কিন্তু যারা নীরবে এই সভ্যতাকে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে- তাদের কিয়দংশের উদাহরণ দেই…..
●●প্রফেসর সৈয়দ আতিকুল হক স্যার।কিছুদিন আগে এই প্রতিযথশা চিকিৎসক Asia Pacific League of Associations for Rheumatology( APLAR) এর President নির্বাচিত হলেন।কোন পত্রিকা কি এটাকে লিড নিউজ করেছে।এটা যে কত বড় অর্জন তা কি সাধারণ জনগণ জানে? আমার ব্যক্তিগত মতামত বলি–কয়েকবার হিমালয় পর্বতশৃঙ্গ জয় করার চেয়েও আমার কাছে APLAR এর President হওয়াটা বেশী রোমাঞ্চকর…..
●●ভরহীন কণা- “ভাইল ফার্মিয়ন”।এটি আবিষ্কারে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ড. জাহিদ স্যার।টাকলা গিটারিস্ট নিয়ে মিডিয়ার উন্মাদনা ভালোই চলে।ড. জাহিদ স্যারকে নিয়ে মিডিয়ায় উন্মাদনা চোখে পড়ে না কেন?
●●মেডিকেল সায়েন্সে আসার পর Mathematics এর টাচ তেমন নেই বলে আক্ষেপ ছিলো।নিউরোলজীর প্রফেসর কাজী দীন মোহাম্মদ স্যার, মেডিসিনের প্রফেসর আজিজুল কাহ্হার স্যার, কার্ডিওলজীর প্রফেসর আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী স্যাররা যখন Mathematics এর মত লজিক ব্যবহার করে একটার পর একটা রোগ ডায়াগনোসিস করে রোগীর জীবন বাঁচাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তখন আর আক্ষেপ থাকে না।জানতে চাই, মিডিয়া কি এদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে কোন ফিচার রচনা করে?
●●ড. মাকসুদুল আলম স্যার।পেঁপে, রাবার, পাট এবং ছত্রাক এর জীনোমকে উনি ডিকোড করেছিলেন।জানতে মন চায়, বেঁচে থাকতে উনি কয়টি ফ্ল্যাট, গাড়ী, বাড়ি পেয়েছিলেন?
●●প্রফেসর এ.বি.এম আবদুল্লাহ স্যার। USA এর Library গুলো উনার লেখা বইগুলো তাদের সংগ্রহে রেখে নিজেদের ধন্য মনে করে।অতিকথনপ্রিয় নায়িকার চটুল কথাবার্তা পেপারে আসে, ডাঃ এ.বি.এম আবদুল্লাহ স্যারের দিনপঞ্জি বারংবার প্রথম সারির পেপারগুলোতে দেখি না কেন?
●●২০১৬ সালে বিশ্বে প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় ঘটনা— ” সবচেয়ে ক্ষুদ্র রোবট” আবিষ্কার, যে রোবটটি মানুষের রক্তনালীতে ঘুরে বেরাবে মানুষেরই কল্যাণে।নিউইয়র্ক টাইমসে পর্যন্ত এ খবর ছাপা হয়। এসব ঘটনার পেছনের লোক আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাহের এ সাইফকে কি আমরা চিনি? অভিনেতা- অভিনেত্রীর ফালতু খবর বারংবার ছেপে এদের নাম আমাদের মস্তিষ্কে ঢোকানো হয়, এই জেনারেশনের মস্তিষ্কে তাহের এ সাইফের নাম ঢোকানো হয় না কেন?
●●প্রফেসর আবুল ফায়েজ স্যার, প্রফেসর রিদওয়ানুর রাহমান স্যারের রিসার্চ পেপারগুলো পাবলিশ হয় বিশ্ববিখ্যাত জার্নালগুলোতে। পর্দার পেছনে কাজ করা এই নায়কগুলোকে মিডিয়াতে হাইলাইট করা হয় না কেন?
●●’জুলাই ২০১২ সালে ভারতে বিদ্যুতের বিপর্যয় ঘটল। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ছাপা হলো একজন বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞের মত। হারিকেন স্যান্ডির কারণে আমেরিকার কোনো কোনো শহর যখন বিদ্যুৎবিহীন, এবিসি নিউজ তখন প্রকাশ করল একই বিশেষজ্ঞের বক্তব্য। যুক্তরাষ্ট্রের এই নামকরা বিদ্যুৎ প্রকৌশলীর অন্তত ১০০ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত বা প্রচারিত হয়েছে সিএনএন, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ মূলধারার গণমাধ্যমে’। প্রকৌশলী আরশাদ মনসুর স্যারের কথা বলছিলাম।কয়টা মেইন স্ট্রিম মিডিয়ায় এই খবর এসেছে?….
আমার লেখায় আমি স্পষ্টত মোটা দাগে দুইটি অংশের কথা বলেছি।দ্বিতীয় অংশে যাদের কথা বলা হয়েছে, তারা নীরবে নিভৃতে সভ্যতার উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন।তারা Fame- seeker নন।#তবে_কেন_আমি_তাদেরকে_নিয়মিত_মিডিয়ায়_হাইলাইট_করতে_বলছি?
কারণটা বলি…..
মিথ্যাকে বারবার বললে তা সত্যের মত শোনায়।মিডিয়া যেভাবে গৌণ টপিক নিয়ে উন্মাদ টাইপের প্রচারণা চালায়, তাতে New Generation মিসগাইডেড হয়।New Generation দেখছে যে এদেশে লেখাপড়া জানা জ্ঞানী লোকদের অবমূল্যায়ন করা হয়।কাজেই এখন তাদের স্বপ্নটা অন্যরকম– লেখাপড়াটা কোন রকমে চুকিয়ে তারা এখন অভিনয়ের স্বপ্ন দেখে, আউলা চুলের বাউলা গায়ক হতে চায়, গিটারিস্ট-পিয়ানিস্ট হতে চায় কিংবা ক্রিকেটার….
এসব হোক, তাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু প্রাইম ইস্যু যে জ্ঞানার্জন–তাতে ঘাটতি কেন? লেখাপড়ার মান আজ তাই নিম্নমুখী-দোষটা মিডিয়ার, তারা এই জেনারেশনকে ভুল বার্তা দিয়ে তাদেরকে ডাইভার্ট করছে। “Only two things are infinite- the universe and human stupidity and I am not sure about the former”….মিডিয়া যাদেরকে প্রতিনিয়ত হাইলাইট করে তা দেখে আইনস্টাইনের এই কথাটা আমার প্রায়ই মনে হয়। এই ট্রেন্ড চলতে থাকলে আজ থেকে ৫০ বছর পর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, জীববিজ্ঞানী, ম্যাথম্যাটিশিয়ান, অর্থনীতিবিদের অভাবে এই দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে তা আমি নিশ্চিত…..
বাংলাদেশের এক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।দু’দিন আগে প্রেসক্লাবে এক সম্মেলনে তিনি কিছু কথা বলেন।তার নমুনা দেই-” বাংলাদেশে এখন আর জ্ঞানের চর্চা নেই। শিক্ষার বিস্ফোরণ হচ্ছে, জিপিএ-৫ পাচ্ছে, গোল্ডেন হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে মান নেমে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের মতো সমাজে জ্ঞানের মানও নেমে যাচ্ছে…..” জ্বি স্যার, এদেশে জ্ঞানের মান আরো নিচে নামবে।এদেশে মডেল হতে মিডিয়া উৎসাহিত করে, এদেশে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তোয়াজ চলে, গায়ক-বাদক হতে প্রণোদনা দেয়া হয়, ক্রিকেটারদের গণসংবর্ধনার আয়োজন করে গাড়ী-বাড়ির ব্যবস্থা করা হয়, পর্বতশৃঙ্গ জয়কে মহিমান্বিত করা হয়–শুধু জ্ঞান চর্চাকে প্রণোদিত করা হয় না, এদেরকে রাখা হয় লাইম লাইটের বাইরে।ঝড়ের আগে ব্যারোমিটারে পারদের কাটা যেমন দ্রুত নামে, এদেশে তেমন ভাবে তাই জ্ঞানের কাটাও নামছে……
“জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ঠ, মুক্তি সেখানে অসম্ভব”। জ্ঞান আজ শৃঙ্খলিত, মুক্তি তাই অনেকটা কাল্পনিক। এরপরও প্রতিকূল এই পরিবেশে সভ্যতার চাকাকে যারা সচল রাখছে, প্রচার বিমুখ এই লোকগুলোর কর্মকান্ডে মুক্তবুদ্ধির মানুষ তাতে অবশ্যই অনুপ্রাণিত হয়।New Generation কে তাই মনে রাখতে হবে, ” We must accept finite disappointment but never lose infinite hope…”
মেকী জিনিসের ভিড়ে আসল জিনিস খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য, কিন্তু অসম্ভব নয়।দ্বিতীয় অংশে বর্ণিত প্রায় Reward বিহীন এই অতিমানবগুলোর কর্মকান্ডগুলোই আমাদের আলোকবর্তিকা। তাদের কর্মযজ্ঞের বিশালতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়ঃ
Don’t try to be the man of the day
Try to be the man of the truth
Try to be the man of the civilization….