প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -১২
” গরু “
লেখকঃ
ডাঃ মোঃ বেলায়েত হোসেন
শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ
——-
বিকাল চারটা।ইমার্জেন্সী রুমে খুব ব্যস্ত সময় পার করছি।একই সাথে দুইটা খারাপ রোগী এসেছে।একজন রিক্সা থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়েছে,আরেকজন স্ট্রোক করেছেন খুব সম্ভবত।কোন দিকে তাকাবার ফুরসত নেই।এমন সময় বাইরে শুনি হট্টগোল।বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছি,ডাক্তার কই,ডাক্তার?একটা লম্বা শ্বাস ফেললাম,আজকে আমার খবরই আছে।
রোগী ম্যানেজ করছি,আর অবচেতন মনে বাইরের রোগীর জন্য অপেক্ষা করছি।অপেক্ষার অবসান ঘটলো মাত্র দুই মিনিটের মাথায়।একসাথে এক দঙ্গল লোক এসে ঢুকলো ইমার্জেন্সী রুমে।সাথে স্ট্রেচারে শোয়ানো একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক।
রুমে ঢুকেই,সেই দলের সবচেয়ে মোটাসোটা যে লোক,চিৎকার শুরু করে দিলো।ভদ্রলোক সাদা সফেদ একটা পাঞ্জাবি পড়ে আছেন,হাতে সোনালী রঙয়ের ঘড়ি।আমার ব্রাদার তার কাছে যেতেই বললেন,
“ডাক্তার কই?আমার আব্বাকে নিয়ে আসছি,তাড়াতাড়ি দেখতে বল।”
আমি রোগীর কাছে গেলাম।জানতে চাইলাম কি সমস্যা।জানালেন,তার বাবা,স্ট্রেচারে শোয়ানো বৃদ্ধ ভদ্রলোক,আজ দুপুরে খাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই প্রচণ্ড পেটে ব্যথা।রোগীকে দেখলাম,ভাইটাল সাইন চেক করে সব স্বাভাবিক পেলাম।ব্রাদারকে ঔষধ প্রেসক্রাইব করে চলে গেলাম সেই এক্সিডেন্টের রোগীর কাছে।বেচারার অবস্থা বেশি খারাপ মনে হচ্ছে।এর মধ্যেই অন্য রোগীটাকে সিটি স্ক্যান করতে পাঠিয়ে দিলাম।
তো এক্সিডেন্টের রোগীকে দেখছি,এমন সময় পেছন থেকে আমার শার্ট ধরে কে যেন টান দিলো।দেখি সেই পাঞ্জাবী পড়া ভদ্রলোক।
বললেন,
“আমার বাবাকে একবার দেখে ছেড়ে দিলেন কেন ডাক্তার?আমার বাবার কি হইসে?বাবা এমন পেট ব্যথায় অস্থিরতা করতেছে কেন?”
এমনিতে কেউ আমার গায়ে হাত দিলে আমার খুব মেজাজ খারাপ হয়।তার উপর এমন সিরিয়াস একটা রোগী ম্যানেজ করছি,এর মাঝে এমন আচরণ কোন অবস্থাতেই আশা করা যায় না।তবুও মাথা ঠাণ্ডা রাখলাম।শান্ত চোখে বললাম,
‘আপনি চেয়ারে বসেন।আপনার আব্বাকে ঔষধ দেয়া হয়েছে।আমরা কিছুক্ষণ উনাকে অবজার্ভ করবো,তারপর কিছু বলা যাবে।উনাকে ভর্তি করানো লাগতে পারে।আমরা দেখছি।’
এইবার চিৎকার শুরু করে দিলেন তিনি।
“দেখতাসেন মানে?ওই কি দেখবেন আপনি?আমার বাবা রে ফেলাইয়া এইখানে কি করেন?চিনেন আপনি আমারে?”
তবুও কিছু বললাম না।শান্ত গলায় অনুরোধ করলাম,
‘আপনি প্লিজ বসুন।এই রোগীর অবস্থা যথেষ্ট খারাপ।একটু শেষ করে আমি আপনার সাথে কথা বলছি।’
এক্সিডেন্টের রোগীটাকে শেষপর্যন্ত ওটিতে পাঠাতে হয়েছে সরাসরি।আর স্ট্রোকের রোগীর সিটি স্ক্যান হাতে এসেছে ইতিমধ্যে,হেমোরেজিক স্ট্রোক।তাকে ভর্তি দিয়ে বসলাম সেই ভদ্রলোকের সামনে।ইতিমধ্যে তার ব্যথা অনেকখানি কমে গেছে।
‘আপনার আব্বার অবস্থা এখন অনেকখানি ভালো।কি করতে চান আপনি?উনার কিছু পরীক্ষা করাতে হবে,তারপর আশা করি বলা যাবে উনার কি হয়েছে।উনাকে নিয়ে যাবেন নাকি হাসপাতালে ভর্তি রাখবেন?’
ভদ্রলোকের রাগ তখনো পড়েনি বুঝলাম।
রাগ রাগ গলায় বললেন,
“আপনি আমার আব্বাকে ঠিকমতো দেখেন নাই।কি এককটু পেটে চাপাচাপি কইরাই গেলেন আগের রোগীর কাছে।টাকা কি আমি কম দিমু আপনারে?আপনে আমারে চিনেন নাই,আমি একজন ভিভিআইপি,মানে বুঝেন?ভেরি ভেরি ইম্পরট্যান্ট পার্সন।আর আপনি আমার বাবারে এমনে হেলাফেলা কইরা দেখলেন।আপনি জানেন আমি আপনারে কি করতে পারি?”
এইবার আর রাগ সামলাতে পারলাম না।
‘ওই আপনি আমারে চেনেন?আমি এইখানকার ডাক্তার,ভাইবেন না এর বাইরে আমার আর কোন পরিচয় নাই।এই হাসপাতাল থেকে বাইর হইতে পারবেন আমার সাথে বাজে ব্যবহার করে ভাবতেসেন?আর শুনেন,আমার এতো ভিভিআইপি চেনার দরকার নাই।আমার কাছে রোগীই একমাত্র বিবেচ্য।আপনার বাবার চেয়ে অনেক বেশি অবস্থা খারাপ ছিলো ওই দুইজন রোগীর,জানেন?তবুও আপনার বাবা আসা মাত্র আমি তাকে দেখে চিকিৎসা করেছি,তবুও আপনি আমার সাথে বাজে আচরণ করেই যাচ্ছেন।কি ভাবেন আপনারা নিজেদের?’
ভদ্রলোক এইবার মাথা সামনে এনে চোখ সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আপনি আসলেও আমাকে চেনেন না ডাক্তার সাহেব,আমি রেফাতউল্লাহ,এই ঢাকা শহরের সবাই আমাকে এক নামে চেনে।আমার পরিচয় জানা থাকলে এতো বড় বড় কথা বলতে পারতেন না।আপনার হাসপাতালের এমডি সাহেব পর্যন্ত আমার ভয়ে কাপে,আর আপনি তো সেইদিনের ছেলে।তারপরেও আপনাকে আমার ভালো লাগছে।আপনার সাহস আছে,আমার সাহসী মানুষ ভাল্লাগে।”
এই বলে এইবার চেয়ারে হেলান দিলেন।
‘আপনি এক কাজ করেন,আপনি আমার পার্সোনাল চিকিৎসক হয়ে যান।বেতন এইখানে যা পান,তার চেয়ে বেশিই দিবো।মাঝেমধ্যে বাসায় আসবেন,আমার,আপনার ভাবীর,বা আব্বা আম্মার প্রেশার চেক টেক করে দিয়ে যাবেন এই আর কি।হবেন নাকি?”
আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম তার কথা শুনে।
‘আপনার পরিবারে সম্ভবত কোন ডাক্তার নাই।থাকলে জানতেন একজন ডাক্তারের মর্যাদা কতটুকু,তার সাথে কেমন আচরণ করা উচিৎ।বাদ দেন,আমার এইসব কাজে কোন আগ্রহ নাই।আমি যেমন আছি তেমনই ভালো আছি।’
সেই ভদ্রলোক একবার আমার দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে এবার ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠলেন।বললেন,
“আপনারা যারা এইরকম গরীবি হালতে থাকেন,তারা এইসব বড় বড় নীতিকথা বলে বেড়ান,আসলে ভেতরে ভেতরে আমার মতোই হতে চান।
হিংসে হয়?আমার মতো হতে চান?দেশ বরেণ্য রাজনীতিবিদ,ব্যবসায়ী,ঠিকাদার,কোটিপতি-হুম,হতে চান?আপনাদের হিংসে হয়,আমি জানি।
দেখেছেন আমার হাতে,আইফোন এক্স।এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা দাম,হাতের আংটি তে যে পাথর,সেটার দাম দুই লক্ষ টাকা,আর ঘড়িটাতে সব ডায়াল আর নাম্বারপ্লেট স্বর্ণের তৈরি।আর আপনার যে ফোন,সেটা আমার ড্রাইভারেরও একটা আছে।এইসব বড় বড় কথা বাদ দেন।আমার ভিজিটিং কার্ড রেখে যাচ্ছি,ইচ্ছে হলে ফোন দিয়েন।ওই যে বললাম না,আপনাকে আমার ভালো লেগে গেছে।হা হা হা।”
আর কথা বাড়ালাম না।এদের সাথে কথা বলাই বৃথা।আমার তরফ থেকে কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে তিনি তার বাবাকে নিয়ে বিদায় হলেন।আমি প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে,সব টেস্ট করিয়ে,আবার দেখা করার জন্য বলে দিলাম।বলা বাহুল্য,তিনি আর আসেন নি।আমি আশাও করিনি তিনি আমার মতো একজন ইমার্জেন্সী ডিপার্টমেন্টের মেডিকেল অফিসারের কাছে আবার আসবেন।হয়তো এতোদিনে তিনি কোন বড় স্যারের চেম্বারে যেয়ে পদধূলি দিয়েছেন,আমার কাছে তিনি আসবেন কোন দুঃখে?
Md Belaet Hossain
Md
ঈদের দুইদিন পর,নাইট ডিউটিতে আছি।আজ থেকে আমার ডিউটি শুরু,কোরবানির ঈদ বাড়িতে কাটিয়ে আজই জয়েন করলাম।
বসে আছি,এমন সময় ইমার্জেন্সী রুমে সেই ভদ্রলোক স্ট্রেচারে করে এসে ঢুকলেন।সেই যে ভদ্রলোক,যিনি তার বাবাকে নিয়ে এসে খুব বাগাড়ম্বর করে গিয়েছিলেন।
আজ তিনি একা,ব্যাপার কি?স্ট্রেচারে শুয়ে কাতড়াচ্ছেন,কাছে যেয়ে জানতে চাইলাম কি হয়েছে?আহা উহু করতে করতে জানালেন,ফাকা ঢাকায় বাইক নিয়ে বেড়িয়েছিলেন,একা একাই,রাতের ঢাকা দেখবেন।ঢাকা দেখতে গিয়েই হয়েছে বিড়ম্বনা,সম্ভবত কিছু খেয়ে বের হয়েছিলেন,পরে আর তাল সামলাতে পারেন নি।বাইক নিয়ে একেবারে কঠিন পিচঢালা পথে গড়াগড়ি খেয়েছেন,রাতের ঢাকার রাস্তা তাকে একেবারে বুকে টেনে নিয়েছিলো।
বেশ খানিকটা কেটেছে।সেলাই পড়বে অন্তত দশ বারোটা।ব্রাদারকে সব রেডি করতে বলে দাড়ালাম সেই ভদ্রলোকের বেডের পাশে।বললাম,
‘রেফাতউল্লাহ সাহেব,কেমন লাগছে এখন?এই রাত বিরাতে,একা একা হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকতে?কোথায় আপনার সব চেলাবেলা,ক্ষমতা,আইফোন এক্স?এতো ক্ষমতা নিয়ে কি না আবার এই অধমের কাছেই আসতে হলো?
আপনি ভিভিআইপি,অথচ আমি এক সাধারণ চিকিৎসক।দেখেন তবুও আপনাকে আপনার অসহায় মুহূর্তে আমার কাছেই আসতে হলো।আমি আপনার মতো কেন হতে চাই না,আশা করি বুঝতে পেরেছেন।এমন কোন মানুষ আমি হতে চাই না,যাকে মানুষ ভয় পেয়ে সম্মান করবে।দেখেন,আপনি রাস্তায় পড়ে ছিলেন,আপনাকে কেউ ধরে হাসপাতালে পর্যন্ত নিয়ে আসেনি,বুঝতে পারেন মানুষ আপনাকে কতোটা ঘৃণা করে?এইটুকু রাস্তা,তাও আপনি কাউকে পাশে পেলেন না,একা একাই আসতে হলো।
অথচ জানেন,সেদিনের সেই এক্সিডেন্টের রোগী বাসায় যাবার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে কিভাবে ভালোবাসা জানিয়েছে,কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে?
কি হিংসে হয় আপনার?আমার মতো হতে চান?’
কিছু না বলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন তিনি।ব্রাদার ডাকলেন,তার সব কিছু রেডি করা হয়ে গেছে।আমি হাসিমুখে কাজ শুরু করলাম।
দুইদিন আগে গরুর চামড়া কেটেছি,আজ গরুর মতো কারো চামড়া সেলাই করছি।