বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা ২ ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম ভাগে রাখতে পারি যেখানে ছাত্র ছাত্রীদের প্রতিনিধি হিসেবে একটি নির্বাচিত ছাত্র সংসদ আছে। আর ২য় ভাগে রয়েছে যেখানে এ ধরনের কোন ছাত্র সংসদ নেই।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ২য় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যদিও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের এ নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। অথচ একটি যোগ্য ও নির্বাচিত ছাত্রসংসদ ছাত্রছাত্রীদের কাছে সম্ভাবনার এক অসীম দুয়ার খুলে দেয়। যে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ছাত্র সংসদ হতে পারে ছাত্রছাত্রীদের যুক্তিসংগত দাবি আদায়ের অন্যতম মাধ্যম।
বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি যোগ্য ছাত্রসংসদ থাকলে এদেশের কোন শিক্ষার্থীকে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্তের বলি হতে হত না।
আর ১ম শ্রেণী তে দেশের যে গুটিকয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারাও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের বৃত্তে বন্দি বিধায় সেখানে নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। এতসবের ভিড়ে বাংলাদেশের সকল মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেই প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ১ বছর মেয়াদে একটি নির্বাচিত ছাত্র সংসদ দায়িত্ব গ্রহণ করছে।
নব্বই এর দশক থেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়ে আসছে। তখন দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন একটি নিয়মিত ঘটনা ছিল। সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে একমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেলই এই রীতি ধরে রেখেছে।
সেই নব্বই এর দশক থেকেই দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন যেমন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, রাজাকার বিরোধী আন্দোলন এ নিজ অবস্থান থেকে জোরালো ভূমিকা রেখেছে চমেকসু। চট্টগ্রামের মত জায়গায় যেখানে সবসময় স্বাধীনতা বিরোধীদের দৌরাত্ম ছিল সেখানে প্রথম থেকেই ছাত্র সংসদ সকল স্বাধীনতা বিরোধী দের বিপক্ষে সোচ্চার ছিল। এমনকি বিরোধী দল থাকা অবস্থায় ও চট্টগ্রাম মেডিকেলে স্বাধীনতার পক্ষের দলই সবসময় নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে এবং কখনোই চমেক ক্যাম্পাসে স্বাধীনতা বিরোধীদের অবস্থান করতে দেয় নি। এবং এ সব কিছুই ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের কে সঙ্গে নিয়ে।
ছাত্রসংসদের অনুপস্থিতে এর সুযোগ সুবিধাগুলো সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। তবে ছাত্র সংসদ থাকার সুযোগ সুবিধাগুলো কিন্তু ঠিকই পাচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এর শিক্ষার্থীরা। দেশের বিভিন্ন অস্থিতিশীল সময়ে যেখানে দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল সেখানে বিগত কয়েক বছরে একটি দিনের জন্যও চট্টগ্রাম মেডিকেল বন্ধ ছিল না। উল্টো হরতালের সময় চট্টগ্রাম মেডিকেলের একদল শিক্ষার্থী কে পুলিশ প্রটেকশন দিয়ে কক্সবাজারে পূর্ব নির্ধারিত পিকনিক সম্পন্ন করতে সহায়তা করে ছাত্র সংসদ। বহিরাগতদের থেকে ছাত্র ছাত্রীদের নিরাপত্তার ব্যাপারটিও ছাত্র সংসদ নিশ্চিত করে। ছাত্রসংসদের সমাজসেবা,সাহিত্য,সাংস্কৃতিক, অন্তঃক্রীড়া ও বহিঃ ক্রীড়া বিভাগের উদ্যোগে সারাবছরই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সারাবছর জুড়েই বিভিন্ন সহশিক্ষা মূলক কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়। সারাবছর টানা পড়াশোনার একঘেয়েমী কাটাতে বছর জুড়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। থাকে নাটক,নাচ, গান আর দেশের সেরা ব্যান্ডগুলোর পরিবেশনা।থাকে পুরো ক্যাম্পাসের সকল ব্যাচের অংশগ্রহণে বাৎসরিক পিকনিক।আরও অনুষ্ঠিত হয় অন্তঃক্রীড়া সপ্তাহ এবং ক্রিকেট ও ফুটবল টুর্নামেন্ট। আর এসবই ছাত্রসংসদের প্রতিটি পৃথক বিভাগের তত্ত্বাবধানে এবং সকল সাধারণ ছাত্রছাত্রীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে নিয়মিত সফলভাবে আয়োজন করে আসছে চমেকসু।
সাধারণ ছাত্রছাত্রীর কথা বিবেচনা করে প্রধান ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস উভয়েরই খাবারের মান থেকে শুরু করে আরও নানা সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেছে চমেকসু ।
ছাত্রদের হোস্টেলে পানির সমস্যা দূরীকরণ, ১ম বর্ষের ছাত্রদের আবাসিক সীট এর ব্যাবস্থা করে ছাত্র সংসদ।
এছাড়াও ২০১৪ সালে ক্যাম্পাসে ”সি এম সি ক্যাফে” র স্থাপন চমেক সুর গৌরবের আরেকটা মাইলফলক যা দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ ছাত্রদের এক টি দাবি ছিল।শুধু সি এম সি ক্যাফে স্থাপন নয় খাবারের মানের তদারকি করা এবং ক্যাফেতে ওয়াই ফাই এর সুবিধার ও ব্যবস্থা করেছে ছাত্রসংসদ।
বিগত বছরে চমেকসুর অন্যতম বড় সফলতা ছিল সাহিত্য লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা যা শুধুমাত্র দেশের সব মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যেই না বরং সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের র মাঝে নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ। নান্দনিক নির্মাণশৈলী অার রুচিশীল সাহিত্য সম্ভারের জন্য ইতোমধ্যে তা সারা দেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
এছাড়া ও এ বছরই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৬০বছর পুর্তি উপলক্ষে প্রথম বারের মত সারা বিশ্বে একযোগে ‘সি এম সি ডে’ সফলভাবে পালনের জন্য কাজ করে গেছে চমেকসু।
চমেকসু এর ভিপি এবং সাধারণ সম্পাদক একাডেমিক কাউন্সিলের মেম্বার।একাডেমিক কাউন্সিলের যেকোন সিদ্ধান্ত ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক এর ভোট ছাড়া পাশ হয় না। সুতরাং ছাত্রদের স্বার্থ বিরোধী কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন অবকাশ থাকে না। তাছাড়া শিক্ষকদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে শিক্ষকদের দূরত্ব কমে এসেছে।
শুধু সহ শিক্ষা কার্যক্রমই নয় একাডেমিক কাজে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনিয়তার কথা মাথায় রেখে লাইব্রেরি সহ পুরো ক্যাম্পাসে ওয়াই ফাই সংযোগ দেয়া থেকে শুরু করে লেকচার গ্যালারিতে এসি সংযোজন ফিল্টার প্রদান ও সাউন্ডবক্সের ব্যবস্থা করা সহ আরও অনেক সুবিধার ব্যবস্থা করেছে চমেকসু।
এভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেকোন প্রয়োজনে দিন রাত অতন্দ্র প্রহরীর মত নিয়মিত কাজ করে গিয়েছে চমেকসুর ২০ জন নির্বাচিত সদস্য।নব্বইয়ের দশক থেকে যে আদর্শ নিয়ে অগ্রজরা এই যাত্রা শুরু করে গিয়েছিলেন তাদেরই আদর্শকে পাথেয় করে চমেকসু আজ সারা দেশের জন্য একটা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। তাইতো দিন শেষে চমেকসু চটগ্রাম মেডিকেলের সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের কাছে একটি নির্ভরতার নাম।
সাব্বির আহমেদ, জিএস,
চমেকসু, ২০১৬-১৭।