প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৩ ই আগস্ট, ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. আসির মোসাদ্দেক সাকিব
ডেন্টাল সার্জন,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
আমরা চাঁটগাইয়ারা বিস্কিট কে ‘বিস্কুট’ বলি। সুতরাং এটা হবে বেলা বিস্কুট। বিস্কিট শব্দটা আমরা বৃটিশদের থেকে শিখেছি। মার্কিনিরা এটাকে ‘কুকিজ’ বলে। বিস্কিট শব্দটা আসলে ফ্রেঞ্চ যেটা ‘বিস’ ও ‘ককতাস’ নামের দুইটা ল্যাটিন শব্দ থেকে এসেছে। বিস মানে দুইবার আর ককতাস মানে সেঁকা। তার মানে বিস্কিট হলো দুইবার সেঁকা জিনিস। প্রাচীন বিস্কিট এর সন্ধানে বেরুলে ১৫৫৮ সালের রোমান অঞ্চলে যেতে হবে। ওদিকে গিয়ে কথা না বাড়াই।
ছোট করে বলি-
মিশরীয় বণিকরা ধউলা নামের শুকনো বিস্কিটের মতো একটা রুটির সওদা করতো জানা যায়। ঠিক একই সময়ে রোমানরাও বুচেলাম নামের ময়দা দুধ দিয়ে শুকনো খাবার বানাতো। এই খাবার গুলো নাবিকেরা দীর্ঘ যাত্রায় নিয়ে যেতো যেহেতু এগুলো সংরক্ষণ করা সহজ। প্রথমে একবার সেঁকা জিনিস গুলো আর্দ্রতাতে তিন চার দিন পরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তাই তারা দুই তিন বার সেঁকে একদম শক্ত করে নেবার পরিকল্পনা করে। সেই থেকেই বিস্কিটের উৎপত্তি। পর্তুগীজ আর স্পেনিশরা সমুদ্রযাত্রায় অগ্রবর্তী ছিলো তাই এরা এই বিস্কিটের বেশি ব্যবহার করতো। এই ভারতীয়রা পর্তুগীজদের থেকেই বিস্কিটের উৎপাদন শিখে নিয়েছিলো তিনশো বছর আগে প্রায়। এর পরে ভারতে বিস্কিট ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারে পর্তুগীজদের আগমন ছিলো নিয়মিত। সেখান থেকে আমাদের পূর্বপুরুষেরাও শিখে নিয়েছিল পদ্ধতি।
আজ থেকে একশো বছরেরো আগে চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকার পাশে চন্দনপুরাতে আবদুল গণি সওদাগর নামে এক বণিক ছিলো। তিনি প্রধানত খাদ্যদ্রব্য সওদাপাতি করতেন। নিজের এক দোকান ছিলো “গণি বেকারি” নামে। আবদুল গণি এই বিস্কিট বানানোর পদ্ধতি রপ্ত করেন ধীরে ধীরে। তিনি পর্তুগীজ ও ইংরেজদের থেকে শেখা এই সিস্টেমে নিজের কিছু রেসিপি মিশিয়ে নতুন এক বিস্কিট বানাবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। এই বিস্কিট টিনের পাতে করে ওভেনে সেঁকার বদলে মাটির পাতে তন্দুরীতে সেঁকার সিদ্ধান্ত নিলেন। দেখলেন যে স্বাদ টা অনেক বেশি হচ্ছে আগের শেখা বিস্কিটের চেয়ে। আবুল ফজলের রেখাচিত্র নামক বইতে পাওয়া যায় যে, বেলায়েত আলী নামের এক বিস্কিটের কারিগর এই সিস্টেমে বিস্কিট বানাতেন। তবে অন্যান্য সূত্র মোতাবেক এই বেলায়েত আলী সম্ভবত আবদুল গণির বেকারির প্রধান কারিগর ছিলেন বলে আমার ধারণা। এই আলাদা স্বাদের বিস্কিটের নাম ছিল বেলায়েত আলীর বিস্কুট যা পরবর্তীতে হয় “বেলা বিস্কুট”। সেই বেলা বিস্কুট এখনো সদর্পে টিকে আছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য হয়ে। এখন সেটা চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানেও প্রসার লাভ করেছে। আবদুল গণি ১৯৭৩ সালে মারা গেছেন নিঃসন্তান মানুষ হিসেবে। তাঁর ছোট ভাই দানু মিয়ার পরিবার এখনো একই স্থানে “গণি বেকারি” নামে সেই দোকানটা চালাচ্ছে।
চট্টগ্রামের নগর ভবন, চউক ভবন, প্রেস ক্লাব থেকে শুরু করে এমপিদের কার্যালয় ও বড় বড় অফিসে বেলা বিস্কুট আর চায়ের অফার টা এখনো বজায় আছে। চায়ে বা সরবতে বেলা বিস্কুট চুবিয়ে নাস্তা না করলে এখনো চাঁটগাইয়াদের চলেনা। ভেজাল করা বাঙ্গালির আজন্ম স্বভাব। এই গণি বেকারির বেলা বিস্কুটের অনেক অনেক ভেজালে এখন বাজার সয়লাব। তবে আসল জিনিসের কোন তুলনা হয় না, শাখাও হয় না।
বেলা বিস্কুট চট্টগ্রামের গর্ব। গণি সওদাগরের অরিজিনাল এই বেলা বিস্কুট খাইনি এমন চাঁটগাইয়া পাওয়া যাবে কিনা জানিনা। এখন শ’খানেক কোম্পানি শখানেক রকমের মজাদার বিস্কুট বানায়, কিন্তু বেলা আমাদের কাছে বেলাই। যুগ যুগ বেঁচে থাক আমাদের বেলা বিস্কুট আর চায়ের আড্ডা।
সূত্র- কৃষ্টিকথা, বণিকবার্তা, banglanews24, আবুল ফজল, Wikipedia.