প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৫ জুলাই ২০২০, রবিবার
শুভ্রদেব হালদার
পপুলার মেডিকেল কলেজ
সেশন:২০১৮-১৯
আজকে রবিবার। ডা. অংশুর বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগের পরিসমাপ্তি হবে আজ। সেটাই কিছু মানুষ বলাবলি করছিল। আবার কিছু মানুষ খেপে আছে যেই মুহুর্তে ডা. অংশুকে পাবে, একদম পিটিয়ে শেষ করে দিবে। ডাক্তার হল সেকেন্ড গড। ঈশ্বর, প্রভু, আল্লাহ, গড, বুদ্ধ কাউকে দেখা যায় না। তবে তাদেরই সৃষ্টি ডাক্তারকে সর্বদা দেখা যায়। কিন্তু কাউকে বোঝানো যাচ্ছে না ডা. অংশুর নির্ভীক সত্যাবলী ” চন্দ্রবিন্দুর বিসর্গকে”! সবাই খেপে আছে। এখনো কেন ডাক্তার অংশু আসছে না? কতবার তাকে ফোন দেয়া হয়েছে, এখনো কেন আসছেন না উনি।?ছোট ছেলেটার বাবা রাগে ক্ষোভে চিৎকার শুরু করছে। খায়রুলের ছেলে সোহানের ব্রেইন টিউমার হয়েছে। আজকে ওর অপারেশন হবে। কিন্তু ডাক্তার অংশু এখনো আসেন নি৷ আধঘন্টার মধ্যেই অপারেশন শুরু করতে হবে। তখন খায়রুল সাহেব ডাক্তার সমাজকে দুই-তৃতীয়াংশ কটূক্তির দ্বারা একদম ধূলিসাৎ করছিল।
“এরা কি ডাক্তার না অমানুষ?”
কথাটা শেষ হতে না হতেই গাড়ি থেকে নামলো ডাক্তার অংশু। নার্স তখন খায়রুল সাহেব কে বললেন,
“ওই যে স্যার এসে গেছেন।”
সোহানের বাবা দৌড়ে তার কাছে গেল।
“আপনি কি ডাক্তার না কসাই বলুন তো? ঠিকই তো টাকা গুলো আগে নিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু আপনার আসার কোন নামগন্ধ নেই। আমার ছেলে এইদিকে অসুস্থ আর আপনার কোন খোঁজ নেই। আপনি তো একটা পশু!”
ডাক্তার অংশু কোন উত্তর দিলেন না ওনার কথার। হেঁটে যাচ্ছিলো অপারেশন থিয়েটার এর দিকে।
“শোনেন ডাক্তার, আমার ছেলের যদি কিছু হয়, আপনার সবকিছু কিন্তু শেষ করে দিবো।”
ওনার চিৎকার শুনে অনেক মানুষের তখন সেখানে ভিড় জমে গেল। সবাই বলাবলি করছিল,
“ডাক্তার তো কসাই। ফ্রিতে কিছু দেয় নাকি। ওরা তো অর্থপিপাসু। টাকা নেওয়ার জন্য উন্মাদের মতো করে। একটুও ফ্রি নেয় না। এই টেস্ট, অই টেস্ট দিয়ে ভরিয়ে রাখে প্রেসক্রিপশন। আরে ভাই সেখান দিয়েই তো টাকা পায় বুঝেন না কেন? এই হাসপাতাল কত টাকা চায়। সব অইটা ডাক্তার বেটার ষড়যন্ত্র। টাইম টেবিল আছে নাকি ওনার? আজকে যদি কিছু হয় ওনার একদম খবর বানিয়ে দিবো।”
এদিকে ২ঘন্টা হয়ে গেল। কোন খবর নেই। বাবা হিসেবে খায়রুল সাহেব দিশেহারা হয়ে পড়েছে। আর মনে মনে কতোই না অভিশাপ দিচ্ছে ডাক্তারকে। তবে এটা কিছুটা হলেও অস্বাভাবিক না। কারণ পিতার মন তো আর সেটা মানে না! আর কতই না গালিগালাজ করছিল তাদেরকে। এরপর অপারেশন থিয়েটার এর প্রবেশদ্বারের উপরের রেড লাইটটা যখন অফ হয়ে গেল, ছুটে গেল দরজার কাছে। অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে আসলো ডাক্তার অংশু।
“আমার ছেলের খবর কী?”
ডাক্তার অংশু কোন উত্তর দিল না। রেগে গিয়ে খায়রুল সাহেব বলেন,
“কি করেছেন আপনি আমার ছেলেকে? আমার ছেলে কি বেঁচে আছে না আপনি আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছেন? কি হল কোন কথা বলছেন না কেন?”
উনি কিছু না বলেই গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। ভিতর থেকে একজন নার্স এসে খায়রুল সাহেব কে বললেন আপনার ছেলে “আউট অফ ডেঞ্জার”৷ ভয়ের কিছু নেই। চিন্তা করবেন না। খায়রুল সাহেব তখন নার্সকে বললেন,
“ওনার অনেক ভাব বেশি, তাই না? কত বার জিজ্ঞাসা করলাম। কোন উত্তর দিলো না। আমি অবাক হয়ে যাই এই হল ডাক্তারের এটিকেট, ম্যানারস।”
তখন সেই নার্স বলল,
“শোনেন খায়রুল সাহেব, ওনার ছেলের ও ব্রেইন টিউমার হয়েছিল। কিন্তু বাঁচাতে পারেন নি। আজকে সকালে ওনার ছেলে মারা গেছে। উনি এখন ছেলের শবদেহ পোড়াতে গেছে।”
খায়রুল সাহেব তখন বললেন,
“আসলে ওটা ওনার পাপের ফল। জীবনে যে পাপ করছে এইজন্যই ওনার সাথে এমন হইছে। দামি গাড়ি বাড়ি এসব যে আসল না, সেটা উনি অর্থের লোভে ভুলেই গেছিলেন।”
নার্স বলল,
“ছিঃ ছিঃ! আপনি কি বলছেন এসব? ডাক্তার অংশু স্যারের মতো মানুষ হয় না। আর আপনি তাকে কন্টিনিউয়াসলি সেই প্রথম থেকে ব্লেইম করে চলছেন। যে আপনার ছেলেক বাঁচালেন তাকে আপনি এসব মন্তব্য করছেন।”
উত্তর আসলো,
“আরে আমি যা বলছি ঠিকই বলছি, আমার ছেলেরে তো বাঁচাইছে আমার প্রভু।”
“আসলে আপনার সাথে আমি কথাবলার কোন ভাষাই পাচ্ছি না।”
বলে সেই নার্সটা চলে গেলেন।
পরের দিন সকালে ডাক্তার অংশু পত্রিকা খুলতেই একটা হেডলাইনে দেখতে পেল। রোগীর স্বজনের হামলায় নিহত রকিব, ছিল “গরিবের ডাক্তার”। বিষয়টি ডাক্তার অংশুকে তীব্রভাবে হিট করলো। না এভাবে আর মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া যে অন্যায় সেটা এখন বন্ধ করতেই হবে, যে করেই হোক। সাধারণ মানুষদের ডাক্তারের বিরুদ্ধে যেসব চিন্তাধারণা এবং অভিমত সেটা যদি এখন ঠিক করা না হয়, তাহলে এই নোবেল প্রফেশন দুমড়ে মুচড়ে যাবে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ কল আসলো তার ফোনে। কেউ একজন ঐ পাশ থেকে জানালো ডাক্তার অংশুর ওয়াইফ ডাক্তার অরুন্ধতী আর নেই। ডাক্তার অংশু পাথর হয়ে গেল। ডাক্তার অরুন্ধতী প্রেগন্যান্ট অবস্থায় দু’শত করোনা রোগীকে সেবা দিয়ে আসছেন। কিন্তু বর্তমানে কোথাও আইসিউ বেড না থাকায়, আর তাকে বাঁচানো সম্ভব হল না। এই নিয়ে নানা সোশ্যাল মিডিয়াতে কতোই না লেখা লেখি, পোস্ট, আর্ট ওয়ার্ক। এরপর সেখানে পৌছালে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হন ডাক্তার অংশু। এরপর তিনি বলেন,
ডাক্তার, নেগলিজেন্স, মারধর – এর জন্য কতটা দায়ী একজন ডাক্তার আর কতটা সমাজ? আর কতটা দায়ী মিডিয়া?
নাকি সবাই দায়ী?
ফার্স্ট ইয়ার এ প্রথম দিন শুনেছিলাম, আমরা নাকি ক্রিম অফ দ্য সোসাইটি, আমরা বাকি এভারেজ স্টুডেন্টদের থেকে উচ্চমেধার। হয়তো বা তাই। একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন উচ্চমেধাটা কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া না। জয়েন দেওয়ার আগের বছরগুলো যখন আমরা দরজা বন্ধ করে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রস্তুতি নিয়েছি, তখন পাড়ার যে ছেলেটা আড্ডা মেরে পাড়ার নেতা হওয়ার দিকে এক কদম এগিয়ে গেছে, তার কি সত্যি অধিকার আছে আমার কলার ধরার? নেই মনে হয়। কারণ ওই যে আমি ক্রীম আর ও সমাজের জঞ্জাল। আমার কাছে বেশ আত্মমর্যাদার ব্যাপার মানছি, কিন্তু এই মানসিকতার একটা খারাপ দিক ও আছে।
এইভাবে আমরা নিজেদেরকে সমাজ থেকে একটু একটু করে আলাদা করে ফেলেছি। তখন মাটিতে পা রেখে চলতে অসুবিধে হয়। ভাবুন শাহরুখ খান একটা মার্সিডিজ কিনলেন, লোকে বলবে কত স্ট্রাগল করে উঠে এসেছে লোকটা। সত্যি কথা নিঃসন্দেহে। কিন্তু একটা কম বয়সী ডাক্তার একটা দামি গাড়ি কিনলে তাকে টাকালোভী ঘুষখোর কমিশনভোগী এইসব শুনতে হয়।
আসলে এটাই হলো কমিউনিকেশন গ্যাপের ফল, যেটা আমরা তৈরি করেছি।
এই দূরত্বটা আমাদের কমাতে হবে। আমাকে পাশের বাড়ির মামা চাচাদের বোঝাতে হবে যে ডাক্তার মাত্রই বায়োলজি পড়া ব্যবসায়ী নয়, প্যাথলজি ল্যাবের জামাই না। সেখানে আমাদের উচ্চমেধার ট্যাগ টা ছেঁটে ফেলতে হবে।
কিন্তু এটা একদিককার কথা। পাবলিক কেও বুঝতে হবে, একটা ছেলে বা মেয়ে ডাক্তার হওয়ার জন্য সমাজ থেকে ঠিক ততটাই সুযোগ সুবিধে পায় যতটা আর বাকি পাঁচটা সাধারণ ছেলেমেয়ে পায়। এফোর্ট আর স্ট্রাগল তাকে অসাধারণ বানায় , তাকে ডাক্তার বানায়।
কি করে ভুলে যান মানুষ মাত্রেই ভুল হতে পারে? কোন নেতা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূরণ না করলে তাকে থাপ্পড় মারেন? আপনার ছেলে পরীক্ষায় ফেল করলে টিচারকে গালিগালাজ করেন? পুলিশ চোর না ধরলে, শালা চোরের কাছে কমিশন খায় এই অপবাদে চড়াও হয়েছেন? না আপনার কেস জিততে না পারা উকিলকে খিস্তি মেরেছেন?
তবে ডাক্তারের জন্য পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেওয়ার আলাদা ব্যবস্থা কেন?
প্রশ্নটা কমন পড়ে গেছে না! উত্তরটা তো আপনার মুখস্থ। আপনার ট্যাক্সের টাকায় কলেজে পড়ে আমরা ডাক্তার হয়েছি, সমাজ ইনভেস্ট করছে তো সমাজের প্রতি দায়িত্ব আছে বৈকি!
-হক কথা। সমাজকে সার্ভিস দিতে আমাদের আপত্তি থাকার জায়গা নেই। কিন্তু প্রশ্নটা হল বাকিদের দায়িত্ব নেই?
স্কুলশিক্ষা তো অবৈতনিক, তবে প্রত্যেক টা শিক্ষিত লোকের উচিত সেই সামাজিক দায়িত্ব নেওয়া। আসুন তবে নতুন নিয়ম শুরু করি। পেশেন্ট দেখার জন্য ডাক্তার টাকা নেবে না, কেস লড়ার জন্য উকিল টাকা নেবে না, পাসপোর্টের জন্য পাসপোর্ট অফিসে কোন টাকা নিবে না, টিচাররা বিনিপয়সায় ছাত্র পড়াবে, আর ইঞ্জিনিয়াররা কোটি টাকার বিদেশী অফার ছেড়ে দেশে থেকে সমাজসেবা করবে। শুধু তাই না, সমাজের ডিমান্ড ফুলফিল না হলে তাকে বাকিরা মিলে পিটিয়ে সিধে করে দেবে। তবে না একটা গণতান্ত্রিক সামঞ্জস্য আসবে।
ডাক্তারের কাছে রোগীর সুস্থতার জন্য সবচাইতে বেশি যেটা প্রয়োজন হয় তা হল ডাক্তারের প্রতি রোগীর শত ভাগ বিশ্বাস, যেটা এদেশে কমতে কমতে তলানিতে না, একেবারে শূন্যে এসে ঠেকেছে। যারা সচ্ছল, যাদের সামর্থ্য আছে তারা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী যেকোন দেশে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে পারেন। তা ঠেকানো যাবে না, দরকারও নেই। যতদিন দেশে বিশ্বমানের হাসপাতাল বানানো যাবে না, ততদিন তারা বিদেশে যাবেনই।
প্রশ্ন হল রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করে, অতি সাধারণ চিকিৎসার জন্যেও, সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে বড় বড় নেতা মন্ত্রীদের কেন বিদেশে যেতে হবে?
যাদের দায়িত্ব দেশে বিশ্বমানের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, তারা নিজেরা যদি বিদেশে চলে যান চিকিৎসার জন্যে, প্রতিষ্ঠান তৈরি করবেন কারা?
ডাক্তারদের সম্পর্কে অত্যন্ত কঠিন শব্দ ব্যবহার করা হয় নির্দয়ভাবে। টাকা ছাড়া অপারেশন করেন না, এই অভিযোগের দায় পুরোটা ডাক্তারদের নিতে হয়। এখানেই আসে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ। বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা মালিক পক্ষের হাতে। সেখানে ডাক্তারদের প্রায় কিছুই করার নেই। সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে। মন্ত্রী-আমলারা উপর থেকে সিদ্ধান্ত নেন। বড় বড় সকল অনিয়ম-দুর্নীতি হয় মেডিকেল সরঞ্জাম কেনাকাটায়।
এদেশে কোন শিশুর জন্ম গ্রহণের সাথে সাথে তার পিতা মাতা আত্মীয় স্বজন “তোমাকে ডাক্তার হতে হবেই” – এই বীজ মন্ত্রটি দুগ্ধশিশুর মস্তিষ্কে স্থাপন করে দেয়, যার দরূণ কতোই না সংগ্রাম করতে হয়। এরপর কিন্তু যখন তাদের বাচ্চাকাচ্চারা কেউ ডাক্তার হতে পারে না, ঠিক তখনি তাদের রুপ হঠাৎ করেই কেমন জানি বদলে যায়! তারা তখন আবার ডাক্তার হতে হবে এই স্বপ্ন টা ভুলে গিয়ে নানা ধরনের বুনন শিল্প রচনা করেন। ডাক্তার সমাজকে নানা দিক থেকে বেফাঁস প্রশ্ন তুলে কলঙ্কিত করে অভিযোগ আনা হয়। তাহলে আমার প্রশ্ন কেনো আপনারা সন্তানকে ডাক্তার হতেই হবে এই কথাটা জন্মানোর সাথে সাথেই সেই বাচ্চাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেন?
প্রমথ চৌধুরী “বইপড়া” গ্রন্থে আলোকপাত করেছিলেন –
“আমাদের সমাজে এমন অনেক মা আছেন, যাঁরা শিশু সন্তানকে ক্রমান্বয়ে গরুর দুধ গেলানোটাই শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষার ও বলবৃদ্ধির সর্বপ্রধান উপায় মনে করেন। দুগ্ধ অবশ্যই উপাদেয় পদার্থ কিন্তু তার উপকারিতা যে ভোক্তার জীর্ণ করবার শক্তি ওপর নির্ভর করে এ জ্ঞান মাতৃকুলের নেই। তাদের বিশ্বাস ও বস্তু পেটে গেলেই উপকার হবে। আর এদিকে সেই শিশুকে ছোট বেলা থেকেই ডাক্তার হতে হবে একথাটা মনে প্রানে বিশ্বাস করাটাই ছিলো তাদের প্রধান লক্ষ্য। ছেলে বা মেয়ের নিজস্ব ইচ্ছা অনিচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে ডাক্তার হতেই হবে এই লক্ষ্যে নানা ধরনের প্রেসার দেয়া হয়। সেটা সেই বাচ্চা কাচ্চারা নিতে পারুক বা না পারুক।”
তাহলে ধরে নিব এটা আপনাদের ঈর্ষাকাতরতা থেকে আসছে, যার দরুণ এরুপ আচরণ!
শুনুন তবে কোন নবীন চিকিৎসকের জীবনকাহিনি-
যে কিনা সকাল বেলায় হাসপাতাল শুরু হওয়ার আগে ওয়ার্ডে চলে যায়, রাতের রোগীর খবর নেয়, সতীর্থদের কাছে থেকে আগ বাড়িয়ে নিজে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করে। এডমিশন ডে হলে সকাল থেকে শুরু করে, নাস্তা বা দুপুরের খাবার খায় দুটোর পরে, ইভিনিং থাকলে চলতে থাকে একটানা রাত ৯টা, ১০ টা বা এগারো টা পর্যন্ত। যার নাইট ডিউটি আছে সে একটু বিশ্রাম নিয়ে চলে আসে রাতে । এরপর সারারাত হয়তো দুইজন ডাক্তার শদুয়েক রোগীর সেবা নিশ্চিত করেন। কার ওষুধ লাগবে, কে কিনতে পারছে না, কার পরীক্ষা লাগবে, কে করাতে পারবে, কে পারবে না, সব ম্যানেজ করতে হয়। সকাল এলে একবার নিজের রাউন্ড, একবার সহকারী রেজিস্ট্রারের রাউন্ড আর একবার প্রফেসারের রাউন্ড। কখন দুপুর হাজির হয় বুঝতে পারে শুধু ক্ষুধার অনুভূতি থেকে। অথবা যখন পা দুটো আর চলতে চায় না। কখনো রোগীর ওষুধ না থাকলে নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে কিনে দেওয়া, কখনো নিজের গায়ের থেকে রক্ত দিয়ে আবার ডিউটিতে ফিরে আসা। এর মধ্যে কোন রোগী মারা গেলে বুকের ভেতর স্বজন হারানোর বেদনা! চোখের জল ফেলার সময় হয় না, আরেকজন হাজির। প্রত্যেক ওয়ার্ডে সহকারী রেজিস্ট্রারের একটা আলমারি থাকে। যখনি কোন রোগী ওষুধ কিনতে পারে না, তখনি সেখান থেকে ওষুধ বের করে দেওয়া হয়। সার্জারি ওয়ার্ডে একই অবস্থা। এডমিশান মানে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা একটানা ডিউটি। পরের দিন অপারেশন শেষ করে হোস্টেলে যেয়ে না খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছেন অনেকেই। এর পরেও কি আপনারা
বলবেন –
“যে আমরা পশু?”
যারা এটুকু পড়েই ভাবছেন এ কি বোরিং গল্প, এর সাথে কসাই হবার যোগ কোথায়, এ শুধু গোড়া পত্তন! এর পর থেকে শুরু হয় প্রতিদিন শারীরিক ও মানসিক পীড়ন। চাকরি নেই, উপার্জন নেই, বাড়িতে টাকা চাওয়ার মুখ নেই , প্রেমিকার বাবার কাছে দাম নেই, রাজনীতির সাথে জড়িত নেই তো কোথাও দাঁত ফুটানোর জায়গা নেই। শুধু নেই আর নেই। তবুও এরা চেষ্টা করে নিজের অশ্রুপাত ঘটিয়ে অন্যের অশ্রুপাত বন্ধ করতে।
এমবিবিএস পাসের পর পরবর্তী উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে হলে, প্রথমেই নতুন করে পাঁচ বছরের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এ সময়ে প্রাইভেট ইনকাম করা কঠিন। রোগীরা সাধারণত তরুণ ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। আর্থিক সঙ্কটের কারণে অনেক তরুণ ডাক্তার অতি প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারেন না। তরুণ ডাক্তারদের অনেকে বিয়ে করে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে! এমতাবস্থায় সমাজের লোকেরা যখন ওই তরুণ ডাক্তারের মা-বাবাকে বুঝাতে শুরু করে,
‘আপনার সন্তান ডাক্তার হয়ে লাখ লাখ টাকা ইনকাম করছে, কই এখনো দালান বানান নি?’
তখন অবস্থাটা কেমন হয়?
মূলত এমবিবিএস পাসের পর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে বিশেষজ্ঞ হতে একজন ডাক্তারের গড়পড়তায় বয়স ৪০ বছর পার হয়ে যায়। আর আর্থিকভাবে সর্বনিম্ন স্বাবলম্বী হতে আরো কমপক্ষে পাঁচ বছর লাগে। তত দিনে ডাক্তার নিজেই ডায়াবেটিস ও প্রেশারের রোগী হয়ে যান। তখন ডায়াবেটিসের কারণে আর ভালো কিছু খাওয়ার সুযোগ থাকে না ডাক্তারের। আনন্দ উপভোগের সময় ও মানসিকতা কোনটাই তখন আর থাকে না তার। এ কারণে ডাক্তারির ইনকাম দিয়ে পিতামাতার মুখে হাসি ফুটানোর স্বপ্নটা অধরাই থেকে যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। কিছুটা সুখী হতে পারে ডাক্তারের সন্তান আর নাতি-নাতনীরা। সমাজের সবাই যেভাবে মনে করে ও প্রচার করে, ডাক্তার মানেই টাকা আর টাকা; সেটা অন্ততপক্ষে তরুণ ডাক্তারের বাস্তবতার সাথে মেলে না। সামাজিক এ ভুল ধারণা তথা এ কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে অনেক পরিবার বা পিতামাতা তার ২৫-৪০ বছর বয়স্ক একমাত্র অপ্রতিষ্ঠিত ডাক্তার সন্তানের কাছে অনেক কিছু আশা করে যখন তেমন কিছুই পান না, তখন ওই পরিবারে সম্পর্কের তিক্ততা সৃষ্টি হয়। আত্মীয়তার বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা বাইরে প্রকাশ হয় না। অশান্তি নেমে আসে ওই পরিবারে। সমাজের লোকেরা তখন প্রচার করতে থাকে,
‘বাবা-মা কষ্ট করে সন্তানকে ডাক্তার বানাইছে, এখন সে বাবা-মায়ের খোঁজখবর নেয় না।’
সমাজে কিছু লোক আছে যারা নিজেরা কিছু গড়তে পারে না, কিন্তু আরেকজনের গড়া জিনিস ভাঙতে ওস্তাদ। এ ধরনের লোকেরা অপ্রতিষ্ঠিত তরুণ ডাক্তারের বাবা-মাকে উসকে দেয়। ডাক্তার বা ডাক্তারিনী তাদের ও অন্য সকল মানুষদের মতো একটা সাধারণ জীবন আছে। কিন্তু তাদের জীবনে উৎসর্গ ও নিজেকে বিসর্জন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।আমি নিজ সন্তানকে হারিয়েছি। সব সময় যে মানুষটাকে পাশে পেয়েছি সেই মানুষটাও আজকে আমাকে রেখে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। প্রেগন্যান্ট হয়েও নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিল এই করোনা যুদ্ধে। আমি নিজেও করোনায় আক্রান্ত। জানি না বেঁচে থাকবো কি না। তবে জীবনের সাথে এতোটাকাল যুদ্ধ করতে করতে চন্দ্রবিন্দুর বিসর্গকে আলোকপাত করতে পেরেছি।