প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৬ নভেম্বর, ২০২০, সোমবার
লেখাঃ ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী
সম্পাদক ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী
দেশের প্রাচীনতম বৃহত্তম মেডিকেল শিক্ষা প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা কেন্দ্র হল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক)। এই কলেজের মাস্টারপ্ল্যানকে অবজ্ঞা করে কলেজ ভবনের একাংশ ভেঙে ক্যান্সার হাসপাতাল করার উদ্যোগের কথা জানতে পেরে কলেজের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে অন্যদের মত আমিও মর্মাহত, বিস্মিত।
মূলতঃ মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনে ১৯৫৯ সালে সীমিত আকারে হাসপাতালটি চালু করা হয়। যেহেতু মেডিকেল শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুবিধার্থে হাসপাতাল; তাই একজন শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম ১০ জন রোগী-এই আনুপাতিক হারে ৫০ জনের জন্য পাঁচশ শয্যার হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়। আলোচ্য মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য জমির বরাদ্দ পাওয়া যায় একশ একর। কিন্তু বিভিন্ন সময় অবৈধ দখলের কারণে দফায় দফায় সংকোচনের পর চমেকের জমির পরিমাণ এখন ৬০ একরে এসে দাাঁড়িয়েছে।
জমির পরিমাণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সমন্বিত ব্যবস্থাপনাও এখন অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে।
আমাদের নীতি নির্ধারকদের একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কোন সাধারণ হাসপাতাল নয়। এটি একটি বিশেষায়িত টিচিং হাসপাতাল। এখানে ছাত্ররা রোগীর চিকিৎসায় বাস্তব প্রশিক্ষণ নিতে পারেন, জ্ঞান-দক্ষতা-আচরণ শেখার সুযোগ পান, গবেষণা ও থিসিস রচনার পাশাপাশি চিকিৎসা সেবাও প্রদান করা হয়। মোটকথা গবেষণা আর চিকিৎসাজ্ঞান অর্জন করার মাধ্যমে তৈরি হয়ে থাকেন একজন সফল চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী।
অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং এর দায়িত্ব সুচারুরূপে পালনের পরিবর্তে অতিরিক্ত চাপ নিয়ে চমেকে ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মহল উঠে পড়ে লেগেছে।
চট্টগ্রামবাসীর জন্য নিশ্চয়ই সুখবর, প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল করার জন্য শুধু অনুমতিই দেননি এটার জন্য বরাদ্দও দিয়েছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা সেই হাসপাতাল কোথায় করলে ভাল হয়, সেই প্রস্তাবনায় উপযুক্ত বিকল্প না খুঁজে চমেকের মধ্যেই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার সরল পথ খুঁজে নিয়েছেন। এটা যে কত বড় অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত, সেটা এলাকার সামগ্রিক বাস্তবতা অনুধাবনকারী মাত্রই বুঝতে পারার কথা।
হাসপাতালটি চমেক ক্যাম্পাসে হলে সবচেয়ে বড় আঘাত আসবে এই প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল শিক্ষায়। হাসপাতালের কার্যক্রমের ভারে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হবে। যে ক্ষতি কোনোভাবে পূরণ হবার নয়। তার উপর পরিবেশগত ঝুঁকি অর্থাৎ ক্যান্সার চিকিৎসার অন্যতম উপাদান তেজষ্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ক্রমবর্ধমান চট্টগ্রাম নগরীতে তীব্র যানজট, স্বাস্থ্যগত সমস্যাসহ বহুমুখী সমস্যা তৈরি করবে নির্মিতব্য ক্যান্সার হাসপাতালটি।
অনেক আবেগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষার্থী, শিক্ষকের অতীত ও বর্তমানের আত্মা এই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। এই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণা কর্ম। হাসপাতাল-সেবা এখানে মুখ্য হয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানটির গড়ার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। পরিণতি হবে ভয়াবহ।
আমরা মনে করি, চট্টগ্রামে ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ অত্যন্ত সময়োপযোগী। কিন্তু এর প্রকৃত সুফল পেতে হলে ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য খোলামেলা ও লোকালয় থেকে দূরে একটি স্থান নির্বাচন করতে হবে। উপযুক্ত স্থানের অভাবে সরকারের এমন মহতী উদ্যোগ যাতে ভেস্তে না যায়, সেজন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের হস্তক্ষেপ জরুরি। বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে স্থান নির্বাচন করে হাসপাতালটি নির্মাণ করা হলে চট্টগ্রামবাসী উপকৃত হবে। চট্টগ্রামের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এমন আন্তরিকতাকে অসম্মান করার পরিণাম শুভ হতে পারে না।