বাংলাদেশের ১ম শ্রেণী পদমর্যাদার সরকারী চাকুরী রিক্রুটিং এর দ্বায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন সচিবালয়ের উপর ন্যস্ত। এদের হাতেই বি,সি,এস পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে একজন স্নাতক সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ পান। এমনকি চিকিৎসকরাও এর ব্যতিক্রম নন। তারাও বি,সি,এস পরীক্ষার ৩টি ধাপ অতিক্রম করে সহকারী সার্জন পদমর্যাদায় অভিসিক্ত হন। পদমর্যাদায় একই হলেও অনেক প্রশাসনিক এবং সরকারী সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হন। প্রশাসন কিংবা প্রশাসন সহযোগী ক্যাডার গুলোতে তারা যেসব সুবিধা ভোগ করেন কিংবা শিক্ষক রা যে পরিমাণ সম্মান লাভ করেন চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে তা পুরোপরি কখনই পান না। অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে এবং জনবলের অভাবে থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যথাযথ সেবা প্রদান সম্ভব হয় না। সেখানে চিকিৎসক একজন “ঢাল তলোয়ার বিহীন একজন নিধিরাম সর্দার।” ফলে জরুরী চিকিৎসা সেবার অভাবে রোগীর করুণ পরিণতির দায়ভার বর্তায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের প্রতি।
চিকিৎসক দের নিয়োগের এই পদ্ধতির কিছুটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। গঠন করা দরকার আলাদা সার্ভিস কমিশন অর্থ্যাৎ স্বাস্থ্যসেবা কমিশন।
প্রশ্ন আসতে পারে যে অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিস থেকে একে পৃথকীকরণ করার আবশ্যকতা কোথায়। এর পিছনে যে কারণগুলো আমি দাঁড় করাতে চাই তা হলো
১. চিকিৎসা সেবা মানুষের দোড়গোড়ায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে বিভিন্ন সময়ের সরকার। কিন্তু দেখা গেছে যথোপযুক্ত সংখ্যায় চিকিৎসক নিয়োগ দেবার পরও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ইউনিয়ন সাব সেন্টারে চিকিৎসককে পাওয়া যায় না। প্রায়শঃ পত্রিকার পাতায় এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হলে দেখা যায় থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান কর্মাধ্যক্ষ জানান তার জনবল সংকটের কথা এবং পাশাপাশি তুলে ধরেন যন্ত্রপাতি এবং ঔষধের অপ্রতুলতা। কেউ কেউ আবার জানান প্রেষণে বদলী হয়ে যাওয়ায় চিকিৎসক সংকটের কথা। যে সমস্ত চিকিৎসকের নিয়োগ দেওয়া হয় তারা নবীন এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্নাতকোত্তর কোর্সে অধ্যয়নরত। ফলে অধ্যয়ন সম্পন্ন করার জন্য প্রেষণে তাদেরকে পাঠানো হয় স্নাতোকোত্তর চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে। যদিও চাকুরীতে প্রবেশের শর্তে উল্ল্যেখ করা থাকে, এবং স্নাতকোত্তর প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষার আবেদনে উল্ল্যেখ করা হয়ে থাকে সরকারী চাকুরীরত চিকিৎসকদের চাকুরীর মেয়াদ ২ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তারা এই সমস্ত স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নের আবেদন করতে পারবে না। কিন্তু এগুলো কতটুকু কঠোর ভাবে মেনে চলা হয় তা আমি জানি না। এরপর আছে অবকাঠামো গত সমস্যা। নেই পর্যাপ্ত জনবল, নেই রোগ নির্ণয়ের যথাযথ ব্যবস্থা , ফলে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যথাযথ চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে পারেন না । আর এখানেই মুনাফালোভী একশ্রেণীর চিকিৎসক এবং ব্যবসায়ীদের সুযোগ থাকে অনৈতিক উপার্জনের। এরই প্রভাবে কার্যত সরকারী হাসপাতালের রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থার উপকরণ নষ্ট হয়। আর রোগীর পকেটের টাকা স্থানান্তরিত হয় মুনাফালোভীদের হাতে এবং অভিশাপ বর্ষণ ঘটে সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর। আর এখানেই স্বাস্থ্য সেবাটি মৌলিক অধিকার থেকে দূরে সরে গিয়ে পণ্যে রূপান্তরিত হয়।
২. দ্রব্য মূল্যের উর্দ্ধগতির কারণে সরকারী বেতন স্কেলে যে কোন ক্যাডারেরই সদস্যদের সংসার কিভাবে চলে সেটা বোধ হয় সরকার জানেন না বা জানলেও নিরুত্তর থাকেন। আর সবারই জানা আছে অভাবে স্বভাব নষ্ট। সরকার যে পরিমাণ অর্থ অনর্থক খাতে ব্যয় করে তা দিয়ে থানা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার বহুল উন্নতি করা সম্ভব।
৩. যেহেতু এই চিকিৎসকদের ক্রমাগত পেশাগত উন্নতির জন্য স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ অত্যাবশ্যক সেহেতু এই পেশায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের কে সেই রকম যথাযথ সুযোগ দেওয়া প্রযোজন। শুধু তাই নয় বিশেষজ্ঞ তৈরি করার পর থানা পর্যায়ে যাতে বিশেষায়িত সেবা সুলভ করা যায় সে জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন।
৪.সাধারণ ক্যাডারের পাশাপাশি বিভিন্ন টেকনিক্যাল ক্যাডারের ক্ষেত্রে একই প্রশ্নপত্রে বিসিএস এর নির্বাচনী এবং একই প্রশ্নপত্রে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয় , যা অমূলক। প্রতিটি টেকনিক্যাল ক্যাডার সার্ভিসের জন্য বিশেষায়িত নির্বাচনী এবং লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
৫. সম্প্রতি প্রায় ৪ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নাম মাত্র নির্বাচনী এবং মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে। যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। পাশাপাশি ২৮তম, ২৯ তম ও ৩০ তম বিসিএস পরীক্ষায় স্বল্প সংখ্যক পদ রাখা হয়েছে চিকিৎসকদের জন্য। যাদের মধ্যে অনেক কে রাখা হয়েছে নন-ক্যাডার হিসাবে । যাদের চাকুরী এখনও অনিশ্চিত। এটা বড়ই হাস্যকর যে ক্যাডার সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে সমস্ত ধাপ উত্তীর্ণ হয়ে নন-ক্যাডার তকমা ধারণ করা। আবার একই সেবা খাতে ২ টি ভিন্ন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ প্রদান (অ্যাডহক এবং বিসিএস- স্বাস্থ্য) এটা দ্বৈত নীতি (Double Standard) ছাড়া আর কিছু না। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই বিপুল সংখ্যক চিকিৎসকদেরকে বিশেষ বিসিএস (যেমন শিক্ষকদের জন্য ২৬ তম বিসিএস) এর মত বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া যেত। এতে করে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া রাজনৈতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে পারত।
তবে এ প্রসঙ্গে আলোচনা দীর্ঘায়িত করার চেয়ে বরং আমার সুপারিশ গুলো বিবৃত করি।
১. স্বাস্থ্য সেবার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগের জন্য আলাদা স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাস্থ্য সেবা কমিশন তৈরি করা। যাদের কাজ হবে ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসাবে চিকিৎসক, ২য় শ্রেণী হিসাবে সেবিকা এবং স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী রিক্রুটমেন্ট করা। ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মত ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বদলীর ব্যবস্থা করা যাতে করে দালাল চক্র গড়ে উঠতে না পারে।
২. স্বতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আকর্ষণীয় বেতন কাঠামো তৈরি করা। যাতে করে এই পেশা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের তাদের নিজ কর্মক্ষেত্রে আগ্রহ সৃষ্টি করা।
৩. সরকারী চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিরুৎসাহিত করে সেবা প্রদানে আগ্রহ তৈরি করা।
৪. স্নাতোকোত্তর প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক সিট বাড়ানো।
৫. অবকাঠামো গত সংস্কার সাধন। ই্উনিয়ন সাব সেন্টার পর্যন্ত জনবল, সহায়ক যন্ত্রপাতি এবং ওষুধ সুলভ করা।
৬. ওষুধ বিক্রয়ে যথাযথ নীতিমালা তৈরি এবং কঠোর ভাবে প্রয়োগ করা। যেন কোন নিবন্ধিত চিকিৎসকের লিখিত ব্যবস্থাপত্র ছাড়া যে কোন ওষুধ বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
৭. স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অযথা কোর্সের সময় না বাড়িয়ে বরং আন্তজার্তিক ভাবে স্বীকৃত সময় এবং কাঠামোগত পরিবর্তন আনা।
আর চিকিৎসকদের কাছে আমার আকাঙ্খা তাদের কাজের প্রতি সততা, প্রতিনিয়ত জ্ঞানোন্নয়ন, রোগীর প্রতি আন্তরিকতা এবং সহমর্মিতা ।