প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২২ জুলাই, ২০২০, বুধবার
ডা.রেজওয়ান
মেডিকেল অফিসার (আইসিইউ, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল)
একদম নতুন এক শহরে এসেছি, কর্মস্থলে কেউ পূর্ব পরিচিত কিংবা সামান্যতম পরিচিত ও নন।
সিনিয়র চিকিৎসকদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, বিদ্রুপ আর রোগীর সামনে গালাগালি এক চিরচেনা চরিত্র সবারই। খারাপ অভিজ্ঞতার ভিড়ে ভাল অভিজ্ঞতা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং তা দেখতে দেখতে হয়ে যাচ্ছে এক অলিখিত নিয়ম, তাই লিখে রাখলাম।
কিন্তু হঠাৎই এ যেন এক ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা। ১০-১১ বছরের সিনিয়ররাও ধরে ধরে শিখাচ্ছেন আইসিইউ এর কাজ। নতুনকে বরণ করছেন উষ্ণ অভ্যর্থনায়। সকল সুবিধা অসুবিধার খুব খেয়াল রাখছেন। বড়রা ছোটদের চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছেন। ভাবা যায়? তারা কিন্তু ছোট হচ্ছেন না, বরং অনুজের অন্তরে আরো বড় হচ্ছেন, শ্রদ্ধায় কখনো কখনো মাথা অবনত হয়ে আসে। কালের বিবর্তনেও স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষ। এক পারিবারিক মায়াজালে আবদ্ধ করছেন তারা। এমন কি করোনা সাসপেক্টেড রোগীর কাছে যেতে না দিয়ে নিজেরাই যাচ্ছেন। শুধু কি সিলেটিরাই এত মায়া জানে কিনা কে জানে তা!
ঔষধ কোম্পানি থেকে সব ধরনের স্যাম্পল, গিফট ফিরিয়ে দিচ্ছেন অবলীলায়! জুনিয়রদের এন ৯৫ মাস্ক, পিপিইর জন্য সিনিয়ররা বার বার অফিসে যাচ্ছেন। ক্লান্ত হলে বলছেন, ঘুমাও, বিশ্রাম নাও আমরা আছি। কী আশ্চর্য চিত্র চারিদিকে! এ কি স্বপ্ন নাকি বাস্তবিক! এ কোন অচেনা জগৎ!
চিকিৎসক সমাজের চিরচেনা অসভ্যতা, নোংরা নীতি চর্চা এক নিমিষেই গুড়েবালি হয়ে যাচ্ছে আমার স্মৃতিপট থেকে। দালাল চিকিৎসক দেখেই কাটছিল ৩ বছর। মহান সৃষ্টিকর্তা ভালদের দেখার সুযোগ করে দিলেন কি!
ঢাকায় যেখানে ডিউটি ৫০০/ ৬০০/ ৭০০ এবং ওটি এসিস্টের টাকা দেয় না, আমার স্ত্রী সিলেটে ডিউটি প্রতি ১১০০ পায়, ওটি এসিস্ট আলাদা। কি আশ্চর্য! কোন দালাল চিকিৎসক বলছে না পারিশ্রমিক কমিয়ে দেন। অথচ নারায়ণগঞ্জ এ ২৪ ঘন্টায় ২২০০ টাকায় ডিউটি করেছিলাম মনে পরে, ওটি এসিস্টে পারিশ্রমিকের প্রশ্নই ছিল না। মনে পরে দালাল চিকিৎসকের কথা যিনি টাকা বাড়াতে দিতেন না বা আরো কমে চিকিৎসক যোগাড় করতেন।
উল্টো চিত্র সিলেটে, বেশিরভাগ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দায়িত্ব কোন মুচি মালিকের হাতে নয় বরং আরএমওর হাতে। তারা যথেষ্ট আন্তরিক চিকিৎসকদের প্রতি। আরো দুটি ব্যাপার আকর্ষণীয় ও শিক্ষণীয়, এরা তাদের আঞ্চলিক ভাষাকে অসম্ভব ভালবাসে, সম্মান করেন এবং নিজ সম্প্রদায়ের রোগীর প্রতি যথেষ্ট মায়া ও দরদ নিয়ে কথা বলেন, সময় নিয়ে কাউন্সেলিং করেন। রোগীও চিকিৎসককে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে। তাদের ভিতরের একতা প্রশংসনীয়।
একটি বিভাগের চিকিৎসকরা এতটা একতাবদ্ধ হতে পারলে, বাকি বিভাগগুলো কেন পারে না? প্রশ্ন রইল।
এছাড়া সিলেটে রিক্সাওয়ালা, অটো চালক, সিএনজি চালক সহ বেশির ভাগ মানুষ নম্র, ভদ্র। কেউ বেশি ভাড়া আদায় করে না। এছাড়া বাটপারের সংখ্যা নিতান্তই কম চোখে পরছে। কিন্তু কিছু মানুষ ননসিলেটিদের একটু অপছন্দ করে বা গোঁড়া। এর কারণ আসলে আমরাই এবং আমাদের ধূর্ততা, শঠতা ও ঠকানোর প্রবণতা।
এ যেন এক নতুন ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা।
এত অল্প সময়ের অভিজ্ঞতা ভুল ও হতে পারে, তাও এ যেন এক অন্য রকম পরিবর্তনের আশার আলো।
এ যেন এক অন্য রকম প্রশান্তি!
এ যেন এক অন্য রকম চিকিৎসক গোষ্ঠী!
এ যেন এক অন্য রকম বাংলাদেশ!
তাই অনুজদের বলব, পরিবর্তন সন্নিকটে ও অবশ্যম্ভাবী। ভাল ব্যবহার, অনুগ্রহ ও জ্ঞান প্রবাহ এ ব্যাপারগুলো অনেক টা চেইন রিয়েকশনের মত, একবার শুরু হলে তা চলতে থাকে অগ্রজ থেকে অনুজে এবং অনুজ থেকে তার পরবর্তী প্রজন্মের অনুজে। হাল ছাড়া যাবে না, ধৈর্য ধরতে হবে একটি অসম্ভব সুন্দর আগামীর।