প্ল্যাটফর্ম নিউজ, সোমবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২১
১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় লকডাউন শুরু হয়েছে। সার্বিক কার্যাবলি ও চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করে বিভিন্ন দফায় নির্দেশনা দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এ নির্দেশনাগুলো ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে একটি নির্দেশনায় বলা হয়- আইনশৃঙ্খলা ও জরুরি পরিষেবা, যেমন- কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি), খাদ্য শষ্য ও খাদ্য দ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা (কোভিড-১৯ এর টিকা প্রদান), বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরসমূহ, টেলিফোন, ইন্টারনেট সেবা, গণমাধ্যম, বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। নির্দেশনা অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ নিষেধাজ্ঞার বর্হিভূত থাকবে। এদিকে গত ১২ই এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক অফিসিয়াল চিঠির মাধ্যমে এক সপ্তাহের জন্য জনগণের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করে। চিঠির স্মারক নম্বর ০৪.০০.০০০০.৫১৪.১৬.০০৩.২০.১২০ উক্ত চিঠির ঙ নম্বরে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এ নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত থাকবে। একজন ডাক্তার, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী, তিনি সরকারি কিংবা বেসরকারি, তিনি সরকারি হাসপাতালে যান অথবা বেসরকারি ক্লিনিকে, তাকে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই আদেশটি মন্ত্রিপরিষদ থেকে দেয়া হয়।
কিন্ত ইতিমধ্যেই রাজধানীতে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে বিভিন্ন সড়কে বাধা দেয় পুলিশ। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে চিকিৎসকেরা। এরমধ্যে বেশ কিছু চিকিৎসককে অর্থ জরিমানাও করা হয়েছে। যদিও কিনা, গত মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মিলনায়তনে জরুরি প্রয়োজনে চলাচলের জন্য মুভমেন্ট পাস অ্যাপ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ বলেন, “মুভমেন্ট পাস নিতেই হবে এমন না। আমরা কাউকে বাধ্য করছি না। এখানে আইনগত কোনো বিষয় নেই।”
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় চিকিৎসক- স্বাস্থ্যকর্মীরা সম্মুখসারিতে থেকে কাজ করছেন। প্রজ্ঞাপনে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের লকডাউনের আওতামুক্ত রাখা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় বিড়ম্বনার মুখে পড়া চিকিৎসকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া। লকডাউনে গণপরিবণ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও জরুরী সেবাদানকারী চিকিৎসকদের যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে দেশের দুই একটি হাসপাতালের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া নেয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। বিভিন্ন জায়গায় মুভমেন্ট পাস নেই বলে আটকে রাখা হচ্ছে, পুলিশকে কার্ড দেখিয়ে বারবার অনুরোধ করার পরও দেরিতে পৌঁছাচ্ছে গন্তব্যে। হাসপাতালে যাওয়া- আসার সময় পুলিশের চেকপোস্টে হয়রানি এবং রাস্তায় যানবাহন না পাওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে মরার উপর খরার ঘা।
ডা. কৃষ্ণা হালদার বলেন, “১৩ এপ্রিল রাতে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করি। সকালে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় কারওয়ান বাজার সিগন্যালে গাড়িটি আটকে দেয় পুলিশ। চালক ও আমার আইডি কার্ড দেখানোর পরেও মামলা দেয়া হয়। জরিমানা ও কাগজপত্র নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পুলিশের সহযোগিতা চেয়ে পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। অভিযোগ করেন বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ‘মুভমেন্ট পাস’ বের করা যায় নি।”
একইদিনে,” কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কোভিড আইসিইউর নার্সরা অধিদপ্তরের সংযুক্ত স্টিকার থাকা গাড়িতে আসার সময় সকালে ভোগান্তিতে পড়েন। মুভমেন্ট পাস ছাড়া তাদের হাসপাতালে যেতে দেয়া হবে না। বিষয়টি জানার পর পরিচালককে জানালেও গাড়ি ছাড়েনি। দুই ঘণ্টা আটকে থাকার পর তারা হাসপাতালে পৌঁছান।” শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসক ইফতেখার রাতের দায়িত্ব পালন করে বাসায় ফিরছিলেন অ্যাম্বুলেন্সে। তাকে ফার্মগেটে নামিয়ে দেয়া হলে ৭ কিলোমিটার হেঁটে রামপুরার বাসায় পৌঁছান তিনি।
১৪ এপ্রিল আরেক ঘটনায় ” স্কয়ার হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক নাজমুল ইসলামকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার সেই স্লিপ যুক্ত করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন তার স্ত্রী চিকিৎসক ইসরাত জাহান। অতঃপর বিষটি নজরে আসায় পুলিশের পক্ষ থেকে ভুল স্বীকার করে তাদের জরিমানা ফেরত দেয়া হয়। তবে উক্ত ঘটনার পরও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বার বার এমন কার্যক্রমের যথাযথ কারণ কি তার সুরাহা মেলিনি এখনো। একই দিনে চিকিৎসক রিয়াজ আহমেদ তমাল জানান, “৭টায় গাজীপুরের টঙ্গী কলেজ গেট থেকে রিকশাযোগে আসার সময় টঙ্গী স্টেশন রোডে পুলিশ আটকাল। আমার আইসিডিডিআর,বি আইডি কার্ড দেখালে বলে যে আমাদেরও নাকি বের হওয়া নিষেধ। অবশেষে বলে দিলেন যে হাসপাতালে ডিউটি করতে হলে রাতে সেখানে থেকে যেতে।”
এদিকে হয়রানিমূলক এসব ঘটনা চলমান থাকাকালীন গতকাল ১৮ এপ্রিল (রোববার) দুপুরে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে পুলিশ চেকপোস্টে আটকানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য এবং স্বাচীপ, বিএসএমএমইউ শাখার সদস্য ডা. সাঈদা শওকত জেনি এর গাড়ি।
তাঁর গায়ে বিএসএমএমইউ এর লোগোযুক্ত এপ্রোন, হাসপাতালের লোগো চিহ্নিত গাড়ি এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচালক কর্তৃক ইস্যুকৃত অনুমতিপত্র দেখানোর পর এগুলোকে ভুয়া দাবি করে পুলিশ সদস্যরা। তিনি বার বার তার পরিচয় দেয়া সত্ত্বেও পুলিশ সদস্যরা মুভমেন্ট পাস এবং পরিচয় চাইতে থাকে। এক পর্যায়ে চিকিৎসক বলেন আমি- “বিএসএমএমইউ এর একজন এসোসিয়েট প্রফেসর, বীর বিক্রমের মেয়ে, আমাকে আপনারা হয়রানি করতে পারেন না। আপনাদের ডাক্তার হয়রানি বন্ধ করতে হবে। শুধু এই ঘটনাই নয় এমন আরো অনেক বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন জায়গা এবং হয়রানির শিকার হয়েছেন বিভিন্ন চিকিৎসকগণ। ”
সরকারি প্রঙ্গাপন, মন্ত্রী পরিষদের দেয়া আদেশ অনুযায়ী কর্তব্যরত চিকিৎসক এবং তাদের ব্যবহৃত যানবাহন লকডাউনের বর্হিভূত থাকা সত্ত্বেও, এপ্রোন পরিহিত এবং নিজ হাসপাতালের লোগো চিহ্নিত গাড়িতে, উক্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচালক কর্তৃক ইস্যুকৃত অনুমতিপত্র অগ্রাহ্য করার মাধ্যমে হয়রানি করানো এবং তাঁকে কটুক্তি করা একজন সম্মুখযোদ্ধার কাছে হতাশাজনক বলে মনে করছেন দেশের চিকিৎসক সমাজ। এদিকে মুভমেন্ট পাস সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মুবিনুর রহমান বলেন, “জরুরি সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকরা লকডাউনের আওতামুক্ত তবে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত গাড়িচালকদের মুভমেন্ট পাস নিতে হবে। ” যদিও প্রঙ্গাপন অনুযায়ী জরুরী সেবাদানকারীদের ব্যবহৃত যানবাহন এই নির্দেশনার আওতামুক্ত থাকবার কথা।
১৮ এপ্রিল (রবিবার) বাংলা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে আসে, “চলমান লকডাউনকে কেন্দ্র করে আবারও জরুরি চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত এক চিকিৎসক দম্পতির গাড়ির বিরুদ্ধে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মামুনুর নামে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশনায় ট্রাফিক রমনা বিভাগের একজন পুলিশ সার্জেন্ট এই মামলা দায়ের করেন। ওই চিকিৎসক দম্পতি জানিয়েছেন, সরকার জরুরি সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের লকডাউনের আওতামুক্ত রাখলেও মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা তা মানছেন না। এটা খুবই দুঃখজনক মন্তব্য করে বিষয়টিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।”
গত ১৪ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হতে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বাস্থ্য সেবার সাথে জড়িত চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের আবশ্যিকভাবে দাপ্তরিক পরিচয়পত্র ব্যবহার করার জন্য বলা হয়।
পরবর্তীতে ১৮ই এপ্রিল দেশের সরকারি দপ্তরগুলোর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল আইডি কার্ডের ধারনা নিয়ে আসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে অধিদপ্তরের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর এইচআরএম এ এই সরকারি আইডি কার্ড যুক্ত করা হয়। প্লাস্টিক কার্ড বা কাগজ প্রিন্ট বের না করে সরাসরি ওয়েব হতে এই আইডি কার্ড ডাউনলোড ও কিউআর কোড স্ক্যান করার সুবিধা থাকছে এতে। তবে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের বেলায় এ সুবিধা নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে চিকিৎসক ডা. তৌফিক আহমেদ ফেসবুকে লিখেন- “সম্ভবত দেশের সরকারি দপ্তরগুলোর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল আইডি কার্ডের ধারনা নিয়ে আসলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে অধিদপ্তরের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর এইচআরএম এ এই সরকারি আইডি কার্ড যুক্ত হলো। প্লাস্টিক কার্ড বা কাগজ প্রিন্ট বের না করে সরাসরি ওয়েব হতে এই আইডি কার্ড ডাউনলোড ও কিউআর কোড স্ক্যান করার সুবিধা থাকছে এতে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্যও স্বাস্থ্য বিভাগীয় স্টাফদের সনাক্তকরন সহজ হবে এতে। অসংখ্য ধন্যবাদ সুযোগ্য ডিজি মহোদয়, এমআইএস (ডিজিএইচএস) ও সংশ্লিষ্ট সকলকে এই নতুন ধারনা বাস্তবায়নের জন্য। উল্লেখ্য যে, হাসপাতালের কোনো স্টাফকে সরকারিভাবে আইডি কার্ড বা স্টাফ বাস/মিনিবাস সার্ভিস দেয়া হয় না। তাই, হয় তারা স্থানীয়ভাবে ম্যানেজ করে, নাহয় বাধ্য হয়েই আইডি কার্ডবিহীন অবস্থায় এবং রিক্সায়, মোটরসাইকেলে বা অটোরিক্সা-সিএনজিতে যাতায়াত করে।”
অন্যদিকে, মুভমেন্ট পাস ও আইডি কার্ড থাকার পরেও আরেক চিকিৎসক ডা. সুজন তার ব্যক্তিগত প্রোফাইলে লিখেন-” শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে ডিউটিতে আসার সময় রিকশা আসতে দিবেনা সংসদ ভবনের পর থেকেই। ডিসি স্যারের নির্দেশ নাকি। আইডি কার্ড, মুভমেন্ট পাশ দেখালাম। তবুও লাভ নেই। ডিউটি করতে হলে এখন প্রাইভেট কার কিনতে হবে। রোজা রেখে পায়ে হেঁটে আসতে বাধ্য করলো। ”
রাস্তায় চিকিৎসকদের হয়রানি সংক্রান্ত পুলিশি কার্যক্রমে স্বাস্থ্যসেবা পেশায় জড়িতেরা একদিকে পড়েছে নানার বিভ্রান্তিতে, অন্যদিকে অহেতুক জরিমানার মাধ্যমে আর্থিক ভাবেও হচ্ছেন ক্ষতির শিকার। নিজেদের জীবন বাজি রেখে হাসপাতালে থাকা করোনা রোগীকে সেবা দেয়া, অন্যদিকে যাতায়াতের এই বাড়তি ভোগান্তি কোনো ভাবেই একজন করোনা যোদ্ধার কাম্য নয় বলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মতামত দিয়েছেন দেশের চিকিৎসক সমাজের সংশ্লিষ্টরা।