গতকাল ৯ জুলাই রোজ সোমবার মহামান্য হাইকোর্ট এর এক পর্যবেক্ষণ নিয়ে সংবাদমাধ্যম এবং টিভি চ্যানেলে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এসেছে।
নির্দিষ্ট সংখ্যক রিপোর্টার, মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও আইনজীবীরা ব্যতীত আদালতের বক্তব্য জানার অন্য কোনো সূত্র নেই। বক্তব্য রেকর্ড করার মতো কোনো যন্ত্রও সেখানে অনুমোদিত নয়। ফলে আইনজীবী ও রিপোর্টারদের মৌখিকভাবে জানানো তথ্যই সূত্র।
কিন্তু গতকাল দুপুরের পর থেকে ই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং টিভি চ্যানেলে মহামান্য হাইকোর্টের বক্তব্যটি নানানভাবে প্রচারিত হতে থাকে যা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলে।
‘দেশে ডাক্তারি পেশা দুর্বৃত্তের পেশায় পরিণত হয়েছে: হাইকোর্ট-’ সোমবার দুপুরে এমন ব্রেকিং নিউজ প্রচার করেছে সময় টিভি।
একই সময়ে চ্যানেল ২৪ প্রচার করেছে- ‘কিছু দুর্বৃত্তের কারণে ডাক্তারি পেশার সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে: হাইকোর্ট’।
পরিবর্তন ডটকমের শিরোনাম ছিল, ‘ডাক্তারি দুর্বৃত্তের পেশায় পরিণত হয়েছে: হাইকোর্ট’।
পূর্বপশ্চিম নামে একটি অনলাইনের শিরোনাম ছিল, ‘ডাক্তারি দুর্বৃত্তের পেশায় পরিণত হচ্ছে: হাইকোর্ট’।
জাগোনিউজ শিরোনাম করেছে, ‘চিকিৎসা পেশা কিছু দুর্বৃত্তের কাছে বন্দী : হাইকোর্ট’।
অন্যদিকে বাংলাট্রিবিউন শিরোনাম করেছে, ‘কতিপয় দুর্বৃত্তের কর্মকাণ্ডের কারণে চিকিৎসাসেবার সুনাম নষ্ট হচ্ছে: হাইকোর্ট’।
ডাক্তারি দুর্বৃত্তের পেশায় পরিণত হচ্ছে’ (পরিবর্তন, সময় টিভি) বা ‘চিকিৎসা পেশা কিছু দুর্বৃত্তের কাছে বন্দী’ (জাগোনিউজ) আর ‘কতিপয় দুর্বৃত্তের কর্মকাণ্ডের কারণে চিকিৎসাসেবার সুনাম নষ্ট হচ্ছে’ (বাংলাট্রিবিউন/বিডিনিউজ/চ্যানেল ২৪)- এই বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ দেয়। অথচ টেলিভিশন চ্যানেল বা সংবাদমাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে উক্ত বক্তব্য ব্রেকিং নিউজ হিসাবে প্রচারিত হয়, যা একদিকে যেমন চিকিৎসাসেবার মত মহ্ৎ পেশার সুনাম নষ্ট করে অন্যদিকে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের উপর জনগনের আস্থায় ফাটল তৈরি করছে।
দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নানান সময়ে “ভুল চিকিৎসা”, “ডাক্তারের অবহেলা” ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে যা অধিকাংশ সময়েই মনগড়া এবং ভিত্তিহীন। গতকালকের এই ঘটনা আরেকবার তা প্রমাণ করলো।
সংবাদমাধ্যম কর্তৃক মহামান্য হাইকোর্টের বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং সুস্পষ্টভাবে হাইকোর্ট অবমাননা।
সংবাদমাধ্যমের অবহেলা এবং অপ্রমাণিত, বিকৃত, মিথ্যা তথ্য পরিবেশনের কারণে অনেকেই দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থা হারাচ্ছেন এবং শরণাপন্ন হচ্ছেন পার্শবর্তী দেশসমূহে। অথচ
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিকিৎসাবিষয়ক বিশ্বের পুরোনো চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা সূচকে বাংলাদেশ রয়েছে ১৩৩তম অবস্থানে।যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ১৪৫তম, মিয়ানমার ১৪৩তম, নেপাল ১৪৯তম এবং পাকিস্তান ১৫৪তম অবস্থানে রয়েছে। এ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষনীয়। স্বাস্থ্যখাতে অবদানের জন্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাউথ সাউথ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
জাতিসংঘের MDG ( Millenium development Goal) বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সময়কাল ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত।
যার ছিল আটটি উপাদান:
১. চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল করা, ২. সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন, ৩. জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন, ৪. শিশু মৃত্যুহার হার কমানো, ৫. মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, ৬. এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য রোগব্যাধি দমন, ৭. পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ এবং ৮. সার্বিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা৷
উক্ত ৮টি বিষয়ে নির্ধারিত ২০১৫ সালের আগেই সফলতা অর্জনের জন্যে MDG অর্জনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের রোলমডেল। সারা বিশ্বের কাছে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেখানে রোলমডেল, সেখানে আমাদেরই সংবাদমাধ্যমের অপপ্রচার এর কারণে আজ বাংলাদেশের চিকিৎসাপেশা হুমকির সম্মুখীন। আমাদের চিকিৎসকেরা আজ কর্মস্থলে নিরাপদ নয়। বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালের কমেন্ট সেকশনে চোখ বুলালেই চিকিৎসকদের প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা এবং মারমুখী মনোভাবের একটা চিত্র পাওয়া যায়; যার পেছনে রয়েছে সংবাদমাধ্যম এর ক্রমাগত মিথ্যাচার এবং অপ্রমাণিত মনগড়া তথ্য।
টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রায় সময় দেখা যায় – “এক ফাইলই যথেষ্ট”, “গ্যারান্টি সহকারে চিকিৎসা”, “অপারেশন ছাড়াই অমুক রোগের চিকিৎসা”, “অমুক দেশ থেকে আগত বিশ্বমানের চিকিৎসকের ফ্রী সেমিনার”- ইত্যাদি বিভিন্ন রোগ- এবং রোগ নিরাময় সেন্টারের চটকদার বিজ্ঞাপন; যার ফাঁদে পরে অনেক মানুষই আজ সর্বস্ব খোয়ানোর পথে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাসপাতাল- ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক- দালাল- স্থানীয় জনগণ এর কাছে ডাক্তারেরা জিম্মি- এটা ইদানীংকালের Open Secret
সংবাদমাধ্যম চাইলেই এসব সমস্যা থেকে আমাদের উত্তরণ করতে পারে। চাইলেই তারা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতকে আরও বলবান করে তুলতে পারে।
অথচ তাদের দৃষ্টি আজ সেদিকে নেই।
তারা বরং কোনরকম তথ্য প্রমাণ ছাড়াই “ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু”, “ ডাক্তারের অবহেলায় প্রাণ হারালেন অমুক” এই ধরনের খবর প্রচার করায় বেশি মনযোগী। এমনকি “খুনি” , “মেডিকেল মার্ডার” ইত্যাদি শব্দচয়নে তাঁরা যাবতীয় ইথিক্স জলাঞ্জলি দিয়েছেন।
মানুষ মাত্রই ভুল হয়। ডাক্তাররাও এটার ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু একজন ডাক্তার চিকিৎসা ভুল দিয়েছে নাকি সঠিক দিয়েছে এটা মূল্যায়ন করতে পারবেন শুধুমাত্র একজন ডাক্তার।অন্য কোন পেশার কোন মানুষ যদি চিকিৎসা মূল্যায়ন করতে যান তাহলে সেটা ভুল ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা।
অথচ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিকিৎসকের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশনায় ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে। বিভ্রান্ত হচ্ছেন জনগণ।ডাক্তার-রোগীর মধ্যেকার যে মেলবন্ধন তা নষ্ট হচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের দেশ, আমাদের সবার প্রিয় বাংলাদেশ।
চিকিৎসা নিয়ে কেউ অসন্তুষ্ট হলে প্রচলিত নিয়মে বিএমডিসির কাছে অভিযোগ করতে পারেন। প্রয়োজনীয় তদন্ত সাপেক্ষে চিকিৎসা প্রদানে অবহেলা হয়েছে কিনা ইত্যাদি বলা যায় এবং পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া যায়। দীর্ঘকাল মানুষের সুস্থতা নিয়ে ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টায় কারোই উদ্দেশ্য থাকে না রোগীর ন্যূনতম ক্ষতি করার। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দচয়ন কাম্য নয়। অতিরিক্ত কাজের চাপে বা অন্যান্য কারণে রোগীর সুচিকিৎসার এই প্রচেষ্টার ব্যত্যয় যে হতে পারে না, একথা বলা যায় না। অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল বা ERROR কমিয়ে আনার সমন্বিত প্রচেষ্টায় দেশের গণমাধ্যমের সহায়ক ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
দেশের সাংবাদিকতার সুদীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে প্রথিতযশা কিংবদন্তী তুল্য সাংবাদিক গণ কেউই তাঁদের সময়ের চিকিৎসকদের এমন কোনো ভাষায় সম্বোধন করেননি যা পড়ে বা শুনে জনগণ নিজ চিকিৎসার প্রতি আস্থাহীনতায় ভুগতে পারে।
অথচ তাঁদের উত্তরসূরি দের কর্মকান্ড, উপরোল্লিখিত সংবাদ পরিবেশন নিশ্চয়ই তাঁদের লজ্জায় ফেলে দিবে।
দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর যেকোনো প্রকারে আঘাত প্রকারান্তরে জনগণের স্বাস্থ্যের উপর আঘাত। জনগণের মৌলিক অধিকারের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপের শামিল ।
বরং গঠনমূলক সমালোচনা, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মানোন্নয়নে ভূমিকা, অনাকাঙ্ক্ষিত আঘাত বা আক্রমণ থেকে চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে সুরক্ষিত রাখতে ভূমিকা রাখাই কাঙ্খিত ।
জনগণের পক্ষে চিকিৎসার মানোন্নয়নে সহায়ক সত্যনিষ্ঠ গণমাধ্যম ভূমিকা রাখবে এবং এহেন বানোয়াট, ভুল তথ্য সম্বলিত, বিকৃত বক্তব্য পরিবেশনকারী হলুদ সাংবাদিকতা তিরোহিত হবে , এটাই কাম্য।
স্বত্ত্ব:
প্ল্যাটফর্ম।
কৃতজ্ঞতা:
Bdfactcheck