চিকুনগুনিয়া নির্মূলে ১৭ই জুন ২০১৭ ঢাকাবাসী দেখবে মহানগরীর সকল চিকিৎসক চিকিৎসা শিক্ষার্থীর অবিস্মরণীয় সামাজিক উদ্যোগ। আয়োজনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
আগামী ১৭ জুন ২০১৭ ঢাকা মহানগরীর সরকারী-বেসরকারী সকল মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ, সকল নার্সিং ইনস্টিটিউট, সকল প্যারামেডিকেল ইনস্টিটিউট, সকল মেডিকেল এসিস্টেন্ট ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী চিকুনগুনিয়া রোগ নির্মূলে মহানগরীতে এই রোগের বাহক এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস ও জনসচেতনা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক-ভিত্তিক অভিযান পরিচালনা করবে।
মহানগরীর প্রতিটি কোনায় কোনায় নগরবাসীর চোখে দৃশ্যমান হবে শুভ্র এপ্রোন পরিহিত শুদ্ধ মনের হাজার হাজার তরুন চিকিৎসা শিক্ষার্থীর সমাজহিতকর এ অবিস্মরণীয় এবং বিশাল কর্মযজ্ঞ। ঐ দিন মহানগরীর প্রতিটি চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা সমবেত হবে সকাল ৯টার মধ্যেই। শিক্ষক ও অতিথি মন্ডলীর কাছ থেকে তারা নেবে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা এবং অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এরপর তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে আশেপাশের নির্ধারিত এলাকায়। ঢাকা মহানগরকে ভাগ করা হয়েছে ৯২টি এলাকায়। প্রতিটি এলাকায় কোন না কোন দল কাজ করবে। ফলে কোন এলাকাই বাদ থাকবে না। দুপুর ২টা পর্যন্ত এই অভিযান চলবে। এরপর শিক্ষার্থীরা ফিরে যাবে নিজ নিজ ঘরে অথবা হোস্টেলে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আহবানে ছাত্র-ছাত্রীরা ঈদের ছুটি ভোগ করতে বাড়ি যাওয়া বিলম্বিত করে এই কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। ১৪,১৫ ও ১৬ জুন 2017 চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযানের বিষয়ে অরিয়েন্টশন ও প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হবে। ১৭ জুন ২০১৭ অভিযান চলাকালে মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী মহোদয়গণ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিবগণ ও স্বাস্থ্য মহাপরিচালকসহ উর্ধতন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিদর্শন ও সমন্বয় করবেন।
কি করা হবে অভিযানে?
– নির্মানাধীন ভবনগুলোর এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র চিহ্নিত ও ধ্বংস করা হবে
– মোটর যান মেরামতের দোকানগুলোতে গিয়ে পুরোনো টায়ার থেকে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস এবং সেগুলোতে যাতে পানি জমতে না পারে সেজন্য পুরোনো টায়ারগুলো ফুটো করে দেয়া হবে
– আবর্জনার ভাগাড়গুলোতে মশা প্রজনন স্থল যেমন পরিত্যক্ত ডাবের খোসা অপসারণ করা হবে
– বাসাবাড়ির ভেতর এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র চিহ্নিত করে ধ্বংস করা হবে। পরিবারের সদস্যগণকে সচেতন করা হবে। চিকুনগুনিয়া রোগের জরীপ করার উদ্দেশ্যে রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এজন্য নগরবাসীর সহযোগিতা চেয়ে আগে থেকেই মোবাইল মেসেজ পাঠানো হবে।
– ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন অভিযান চলাকালে স্প্রে ও ফগিংয়ের মাধ্যমে কীটনাশক ছিটিয়ে মশা নিধনে বাড়তি কার্যকারিতা সৃষ্টি করবে।
কেন এ ধরণের অভিযান?
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা মহানগরীতে চিকুনগুনিয়া রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। দেশের অন্য অঞ্চল থেকে চিকুনগুনিয়ার দু’একটি রোগীর খবর পাওয়া গেলেও দেখা যাচ্ছে সেই রোগীরা ঢাকাতেই এডিস মশার কামড় খেয়েছিল। ঢাকা মহানগরীতে নিজের বা প্রতিবেশীর ঘরে বা আত্মীয় বা বন্ধুমহলে কারুর না কারুর চিকুনগুনিয়া হয়েছে এমন খবর এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
চিকুনগুনিয়া মারণব্যধি নয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ প্যারাসিটামলেই কয়েকদিনের মধ্যেই নিরাময় ঘটে। তবে, কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে প্রচন্ড জ্বর হয় ও সেই সাথে থাকে অস্থিসন্ধির দুঃসহ ব্যথা। রোগী দাঁড়াতে বা হাটতে পারে না। কোন কোন ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে চার থেকে ছয় মাসও লেগে যেতে পারে।
ঢাকা মহানগরীর চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে এবং হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন শত শত চিকুনগুনিয়ার রোগী আসছে। সাময়িক সময়ের জন্য হলেও অনেক কর্মজীবি মানুষ আয়-রোজগার করতে পারছে না। অফিস-আদালত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে যেতে পারছে না। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর অনাবশ্যক চাপ। দেশের অর্থনীতির উপর এটি চাপও বটে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মশা নিধনে বাড়তি কর্মসূচী পালন করলেও তা তেমন কাজে আসছে না। কেননা এডিস মশার প্রজনন স্থল এই নগরীর অতি পরিচিত মশককুল কিউলেক্স মশার মত ঝোপঝাড় বা পুকুর নর্দমা নয়। এডিস মশা জন্ম নেয় ঘরের ভেতর বা আশপাশের অল্প স্বচ্ছ পানিতে। যেখানেই সামান্য পানি জমে থাকবে তিন দিনের বেশী (যেমন ফুলের টব, ফেলে রাখা কৌটায় বা বোতল, পানির খোলা ট্যাংক, ছাদের পানি, নির্মাণাধীন ভবনের পানি সংরক্ষণাগার, পরিত্যক্ত টায়ার, আবর্জনা স্তুপের ডাবের খোসা ইত্যাদি), সেখানেই জন্ম নিতে পারে এডিস মশা। এরা কামড়ায়ও দিনের বেলায়। মূলতঃ সকাল ও সন্ধ্যে বেলায়।
কাজেই সিটি কর্পোরেশনের ঘরের বাইরের স্প্রে ও ফগিং কর্মসূচী তেমন কোন কাজে আসছে না। নিরাপত্তার কারণে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নাগরিকদের বাড়ির ভেতরেও যেতে পারছে না। অপরদিকে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংখ্যাও অপ্রতুল। গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার চালিয়েও তেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
জুন ২০১৭-র ১ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহানগরীর ৪৭ টি ওয়ার্ডে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র বিষয়ে একটি জরীপ চালায়। এতে ঢাকা নগরীতে এডিস মশার ব্যাপক উপস্থিতি ধরা পড়ে। ২৩টি ওয়ার্ডে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক উঁচু মাত্রায় এডিস মশা পাওয়া যায়। ব্রুটো ইনডেক্স ২০ হলো স্বাভাবিক মাত্রা। কিন্তু, ৪৭ টি ওয়ার্ডের গড় ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া যায় ৫২ যা স্বাভাবিকের দু’গুনেরও বেশী। কোন কোন এলাকার ব্রুটো ইনডেক্স ১৩৩। যেমন ধানমন্ডি, কলাবাগান, কাঠালবাগান। এসব জায়গা থেকে চিকুনগুনিয়ার রোগীও পাওয়া যাচ্ছে বেশী। বিশেষজ্ঞদের মতে চিকুনগুনিয়া চলতে পারে সেপ্টেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত। এডিস মশা দমন করতে পারলে রোগের প্রাদুর্ভাবও সীমিত রাখা সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ মশক নিধন না হলেও মশক নিধনই চিকুনগুনিয়া নির্মূলের একমাত্র পথ। তাই দেশবাসীকে চিকুনগুনিয়ার হাত থেকে বাঁচাতে স্বাস্থ্য বিভাগকেই নামতে হচ্ছে দুই সিটি কর্পোরেশনকে সাহায্য করতে।
এডিস মশা চিকুনগুনিয়া, ডেংগু ও জিকা রোগের বাহক। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় না হলে ডেংগু মৃর্ত্যুর কারণ হতে পারে। গর্ভবতী মহিলার জিকা ভাইরাস হলে নবজাতকের মাইক্রোসেফালী (ছোট আকারের মস্তিষ্ক) হতে পারে। এর পরিণতি অনিরাময়যোগ্য বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা। কাজেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে তার ফল একটি জাতীয় দুর্যোগ সৃষ্টি করতে পারে।
শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ বা সিটি কর্পোরেশন এডিস মশা নির্মূল লাঘব করতে পারবে না। সকল খাতের অংশগ্রহণে একটি সর্বব্যাপী সামাজিক আন্দোলন অতীব প্রয়োজন। এ বিষয়ে জাতীয় মনোযোগ আকর্ষনের জন্যই স্বাস্থ্য বিভাগ তার যা আছে তাই নিয়ে উপরোক্ত অভিযানটি পালন করতে যাচ্ছে। এর ফলে চিকুনগুনিয়াও কিছুটা কমবে। বাড়বে নাগরিক সচেতনতা।
পূনঃশ্চ
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এডিস নামে একটি মশা এই ভাইরাসের বাহক। ঘন ঘন বৃষ্টিপাত এবং উষ্ণ আবহাওয়া এই মশার প্রজনন বহুগুণ বৃদ্ধি করে। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কুফল এটি এবং বাংলাদেশ নির্দোষ ভিকটিম। বাংলাদেশে রোগটি প্রথম দেখা দেয় ২০০৮ সালে। রাজশাহী ও চাপাইনবাবগঞ্জে। ঢাকা মহানগরীতে রোগটি প্রথম সনাক্ত হয় ২০১১ সালে।
তথ্য ঃ অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ, মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
১৭ই জুনের কর্মসূচিতে অংশ নিব কিভাবে?
আবুল হাছান
রামপুরা ম্যাটস