৬ ফেব্রুয়ারি,২০২০
প্রথমে উহান সিটি কতৃপক্ষ ভয়াবহ করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি খুব একটা আমলে নেয়নি এমন কি ব্যাপারটা গোপন রাখতে চেয়েছিলো। এ নিয়ে পূর্ব সতর্কতা জানানো চিকিৎসক ডা. লি ওয়েং নামের একজন অপথালমোলজিস্ট (চক্ষু বিশেষজ্ঞ)’কে পুলিশ চুপ থাকতে বলে। তার অপরাধ ছিলো, তিনি সবাইকে নতুন এই ভাইরাসটির সংক্রমণের ব্যাপারে এসএমএস ও ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতন ও সতর্ক করছিলেন।
ঘটনার শুরুঃ
ডিসেম্বরে ডা. লি ওয়েং খেয়াল করলেন নতুন আক্রান্ত কিছু রোগী প্রায় একই রকম উপসর্গে নিয়ে হাসপাতালে আসছে। তার কাছে বিষয়টি মোটেও ভালো ঠেকেনি। তিনি এ ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক থাকতে বললে পুলিশ তাকে অযথা ‘গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে থানায় ডেকে পাঠায়। তার কাছ থেকে মুচলেকা নেয়া হয়। এবং তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবারও হুশিয়ারী করে।
ডা. লি. এর সাথে এসব ঘটে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে যখন সবে মাত্র কয়েকজন রোগী করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসা শুরু করেছেন।
ডা. লি কাজ করতেন উহান সিটির একটি হাসপাতালে। যে সকল নতুন রোগী জ্বর সর্দি কাশি নিয়ে একের পর এক ভর্তি হচ্ছেন তাদের উপসর্গে গুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা মিল ছিলো ২০০৩ সালের মহামারী আকারে রুপ নেয়া সার্স (সেভেয়ার এক্যুইট রেস্পিরেটরী সিনড্রোম) রোগের মতো। ডা.লি খেয়াল করলেন আক্রান্ত রোগীদের সকলেই উহান সিটির হোয়ানান বাজারের আশেপাশের যেখানে সাপ,বাদুর,শিয়াল,কুকুর ইত্যাদি হিংস্র প্রানীর অংগপ্রত্যংগ খবারের জন্যে বিক্রি হয়।
সচেতন ডা. লি. এর সন্দেহ হলে তিনি সহকর্মীদের গোপনে সতর্ক করতে থাকলেন এবং সকল চিকিৎসক কে প্রোটেকটিভ ব্যবস্থা নিয়ে চিকিৎসা প্রদান করার পরামর্শ দিতে থাকলেন।
ডা. লি এর সতর্কতাকে পুলিশ গুজব ধরে নেয়। তার বিরুদ্ধে তারা চরম বিমাতা সুলভ আচরন করে, শাসায়, তাচ্ছিল্য ও অপমান করে।
পুলিশের ভাষা ছিলো এরকম,
“আমরা তোমাকে আবারো সতর্ক করছি ডা. লি. ওয়েং, যদি তুমি তোমার ‘গোয়ার্তুমি’ বন্ধ না করো, ‘ভ্রান্ত তথ্য’ আর ‘গুজব’ ছড়াতে থাকো তাহলে তোমাকে আমরা আদালতের তুলবো”। তারা চিকিৎসক কে মুচলেকা দিতে বলে।
ডা. লি. তাদের সাথে না পেরে মুচলেকা দিতে বাধ্য হলেন। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় তিনি পুরো ঘটনা, কি হতে চলেছে এবং তার সাথে কি কি আচরন হয়েছে এ নিয়ে তাদের জনপ্রিয় সোশ্যাল মাধ্যম ‘ওয়েবো’ তে পোস্ট করেন। শুধু তাই নয় দুঃখে তিনি তার ওয়ালে একটি ব্যাঙাত্মক কুকুরের কার্টুনও আপলোড করেন। কুকুর টির বড় বড় চোখ। সেগুলো উল্টানো আর তার লক লকে বড় জিহবাটা বেরিয়ে আসছে।
মুহুর্তেই তা ভাইরাল হয়। তোরজোড় পড়ে যায় এনিয়ে। হাজার হাজার লাইক কমেন্টস পড়ে। অনেকে দুখ করে কমেন্ট করেন,
“একজন সচেতন চিকিৎসকের সাথে এমন মূর্খ আচরণ করলে সাধারণ জনগণ বা রোগী বাঁচবে কি করে”। কতৃপক্ষের টনক নড়ে এতে ।
পরের কাহিনী ইতিহাস। ডা. লি কে ‘হিরো’ আখ্যা দেওয়া হয়। তার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন এবং কতৃপক্ষ তাদের অজ্ঞতা আর গর্হিত আচরণের জন্যে বার বার নিঃশর্ত ক্ষমা চান।
কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরী হয়ে যায়। যদিও নতুন করোনাভাইরাস সনাক্ত হয় কিন্তু এক মাস সময় ভাইরাসের জন্যে অনেক সময়। এরই মধ্যে করোনাভাইরাস উহান শহর, উবেই প্রোবিন্স থেকে ছড়িয়ে পড়ে চীন ও চীনের বাহিরে।
ডা. লি. যখন সতর্ক করেন তখন বিষয়টি আমলে নিলে পরিস্থিতি হয়তো এতোটা খারাপ হতোনা।
কতৃপক্ষের, উদাসীনতা, অসচেতনতা আর মূর্খতার জন্যে হাজার হাজার চীনা নাগরিক আজ করোনাভাইরাস এ আক্রান্ত। মারা যাচ্ছেন শত শত।
সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে গেছে চীন থেকে। যা এখোনও চলমান। চীনের বাহিরে ফিলিপাইনেও গেলো দুদিন আগে মারা গিয়েছেন এক রোগী।
ডা. লি এর প্রতি বিমাতা সুলভ আচরনের জন্যে চীন তার প্রায়শ্চিত্ত করছে। বিশ্ব থেকে ‘পরাশক্তি চীন’ এখন কার্যত আলাদা। যেনো এক মৃত্যুপূরী। বিদেশের কোন নাগরিক কে যেমন চীনে যেতে পারছেনা, তেমনি চীন থেকে কোন নাগরিক আসতে পারছেনা। ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ। চীন কার্যত অচল। বিশ্বের বহু দেশ চীনের সাথে ফ্লাইট বন্ধ রেখেছে।
ডা. লি একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ সার্জন। তিনি ভাইরোলজিস্ট, এপিডেমিওলজিস্ট ছিলেন না। তার অতশত ভাববার দরকার ছিলোনা। তার কাজ ছিলো চোখের রোগীর চিকিৎসা করা। কিন্তু সবার আগে তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক, সচেতন নাগরিক। তিন যা করেছেন তা দেশের মানুষের জন্যে করতে চেয়েছেন।
এক পর্যায়ে একজন করোনা আক্রান্ত চক্ষু রোগীর চিকিৎসা করতে যেয়ে ডা. লি ও করোনাভাইরাস এ আক্রান্ত হন।
বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতনতা চলছে। বিমানবন্দরে নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। চিকিৎসকরা লেখালেখি করছেন। আল্লাহ তায়লা আমাদের রক্ষা করুন। করোনাভাইরাস ঢাকায় আসলে বিষয়টি হবে এটোমিক বোমার আক্রমণের চেয়েও মারাত্মক। কারন ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ, অস্বাস্থ্যকর শহর।
ডা. সাঈদ এনাম
ডি এম সি,কে-৫২
সাইকিয়াট্রিস্ট
সহকারী অধ্যাপক