বুধবার, ২০ মে, ২০২০
কিছুদিন আগে আমি বিছানায় বসে ফোন গুতাচ্ছিলাম। কোন জরুরি কিছুই না এমনে বসে বসে সময় পার করছিলাম। এমন সময় আমার মা আমাকে কি যেন একটা করতে বললেন। আমি কোন কারণ ছাড়া অযথাই রিএক্ট করে বসেছি উনার উপর। এরকম আরো অনেকবার হয়েছে আমার সাথে। কেবল মাত্র নারী মানুষের প্রতিই না সামগ্রিকভাবে আমার অধীনস্থ বা গুরুত্বপূর্ণ যে কারো উপরই কোন কারণ ছাড়াই মাঝে মাঝে তর্কে জড়িয়ে পড়েছি। কিছু সময় আমার আশেপাশে কাউকেই ভালো লাগেনা। বিষয়টা যখন একটু গভীর ভাবে লক্ষ করলাম তখন আমার মাথায় একটা প্রশ্ন তৈরী হয়। ছেলেদের কি কোন কারণে মেয়েদের মতো রেগুলার মুড সুইং হয় কিনা। সেটা নিয়ে আমি সেদিন একটা হাইপোথিসিস আকারে পোস্ট ও করলাম যে-
“নারীদের প্রতিমাসে একটা সময় পার করতে হয় যখন তাদের মুড খুব আপস এন্ড ডাউন করতে থাকে। কিছুই ভাল লাগেনা, অযথা তর্কে জড়িয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি প্রতি মাসে এমন একটা কঠিন সময়ের ভিতর পুরুষেরাও যায় যেটাতে কোন নারী মানুষ তাদের সহ্য হয়না।”
এই পোস্টটাতে ভালই রেস্পন্স আসে। কেউ কেউ সহমত পোষণ করেছে, কেউ কেউ এ ব্যপারে জানতে আগ্রহ দেখিয়েছে আবার কেউ কেউ আমার পোস্টকে ট্রল করছি ভেবে উড়িয়ে দিয়েছে। যাইহোক আমি এটাই আশা করছিলাম। রেসপন্স! পোস্টটি আমাকে এ বিষয়ে রিসার্চ করতে আরো আগ্রহী করে তুলেছে।
আমার পোস্টের বিষয়টা সরাসরি পিরিয়ডকে ইনডিকেট করা ছিলনা। আমি ধারণা করেছি যে পুরুষেরাও নিয়মিত ইমোশনাল ব্রেকডাউনের মধ্য দিয়ে যায় যেমন পিরিয়ড হলে নারীরা যায়। এখন প্রশ্ন হলো বিষয়টা কতটুকু সত্য বা পুরুষেরো কি পিরিয়ড হয় কিনা!
পিরিয়ডকে সংজ্ঞায়িত করলে দেখা যায়, নারী জরায়ুতে প্রতি মাসে একটি করে ডিম্বাণু নি:সৃত হয়, এর ফলে তাদের হরমোনে ব্যপক এটা পরিবর্তন আসে যা তাদের আবেগীয় এবং আচরণের ক্ষেত্রেও অনেক প্রভাব ফেলে। এই ডিম্বাণু যদি সময়ের মধ্যে নিষিক্ত না হয় তবে তা ফেটে গিয়ে রক্ত প্রবাহে বের হয়ে যায়। প্রায় ৭-১০ দিন এই প্রসেস চলে। এটা খুবই স্বাভাবিক একটা যৌনপ্রজনন প্রক্রিয়া। বরং এটা না হলেই বিপদ।
পুরুষের কি এ ধরণের কোন পিরিয়ড হয় কিনা?
– না, ডিরেক্টলি এ ধরণের কোন পিরিয়ড পুরুষের হয়না যেটাতে রক্ত পড়বে। তবে কিছু কিছু দেশে পুরুষের এরকম ব্লিডিং হয় প্রস্রাবের রাস্তায় যেটা ইনফেকশনের কারণে হয়।
এখন আসি হরমোনাল চেঞ্জের বিষয়ে। মেয়েদের মতো রেগুলার বেসিসে ছেলেদের ও হরমোনাল চেঞ্জ হয় যা তাদের ইমোশনালি ভালনারেবল করে তুলে মানে মুড সুইং এর সূত্রপাত করে। এই হরমোনের পরিবর্তন এমন কিছু লক্ষণ তৈরী করে যা মেয়েদের পিরিয়ডের সময়কার লক্ষণগুলোর সাথে মিলে যায়।
এটাকে কি মেইল পিরিয়ড বলা যাবে কিনা?
– হ্যাঁ। সাইকোথেরাপিস্ট এবং লেখক জেড ডায়মন্ড এমনটাই দাবি করছেন উনার ৪০ বছরের ক্লিনিক্যাল অভিজ্ঞতা এবং ১০০০০ এরো বেশি মানুষের রেস্পন্সের উপর ভিত্তি করে। তিনি পুরুষের এই হরমোনাল পরিবর্তনের নামকরণ করেছেন Irritable Male Syndrome (IMS) নামে। এ নামে তার একটি বই ও আছে।
আমরা জানি, পুরুষের প্রজনন হরমোনের নাম টেস্টোস্টেরন। এই হরমোনের পরিমাণ আমাদের শরীরে চেঞ্জ হতে পারে। এক ঘন্টায় ৪/৫ বার ও এটি বাড়তে বা কমতে থাকে। প্রতিদিন ভোরবেলা পুরুষের শরীরে এর মাত্রা থাকে সর্বোচ্চ এবং সন্ধ্যার দিকে কমতে থাকে। সিজনের উপর ভিত্তি করে এটি বাড়ে কমে যেমন নভেম্বরের দিকে এটি সর্বোচ্চ এবং এপ্রিলের দিকে সর্বনিম্ন। এই হরমোন কেবলমাত্র ছেলেদের প্রজনন কাজের জন্যই না বরং আরো বিভিন্ন আবেগীয় প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। যার কারণে এটি বাড়া বা কমা আমাদের আচরণে প্রচুর প্রভাব ফেলে।
ছেলেদের বা মেয়েদের উভয়ের শরীরে টেস্টোস্টেরনের পাশাপাশি ইস্ট্রোজেন (ফিমেল সেক্স হরমোন) ও আছে। মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেন বেশি ও টেস্টোস্টেরন কম, ছেলেদের উল্টা। ছেলেদের শরীরে কিছু টেস্টোস্টেরন ভেঙে ইস্ট্রোজেনে রূপান্তরিত হয়। আমাদের ওজনের ফ্যাট সেল (চর্বি কোষ) টেস্টোস্টেরন কে ইস্ট্রোজেনে রূপান্তর করে। ছেলেদের শরীরে যত বেশি ইস্ট্রোজেন বাড়তে থাকে টেস্টোস্টেরন তত কমতে থাকে এবং ছেলেরা ততবেশি ইরিটেটেড বা বিরক্ত হতে থাকে, এর সাথে নিজেদের আইডেন্টিটি ভুলে রিএক্ট করতে থাকে। তারমানে টেস্টোস্টেরণ যত কম ইরেটিবল মেইল সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হবার আশংকা তত বেশি।
IMS এর লক্ষণ কি কি?
যদিও এটি মেয়েদের পিরিয়ড কালীন সময়ের লক্ষণগুলার সাথে কিছুটা মিলে যায় কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে মেয়েদের মতো শারীরিক যে ক্রিয়াকলাপ তা হয়না বলে ছেলেদের এই লক্ষণগুলো নিয়মিত না। এর কোন রেগুলার প্যাটার্ন নেই। ইরেটিবল মেইল সিন্ড্রোমের লক্ষণ হলো-
- বিনাকারণে ক্লান্তি
- বিভ্রান্তি বা কনফিউশান
- হতাশা বা মন খারাপ থাকা
- রাগ
- বিরক্তি
- উদ্বেগ
- অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা
- যৌন চাহিদা কমে যাওয়া
- মুড সুইং এবং আচরণগত অসমঞ্জস্যতা
এই সিম্পটম বা লক্ষণগুলো যদি দীর্ঘ সময় কারো মধ্যে দেখা দেয় তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া দরকার।
এখন আসি কি কি ফ্যাক্টর বা বিষয় পুরুষ হরমোনের এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী?
১. বয়স- স্বাভাবিকভাবেই ৩৫-৪০ বছর থেকে পুরুষের টেস্টোস্টেরন হরমোন কমতে শুরু করে। যেটাকে বলাহয় মেইল মেনোপজ। যেহেতু টেস্টোস্টেরন কমার সাথে আবেগের সম্পর্ক আছে তাই দেখা যায় ৩৫ এর পর পুরুষের বিরক্তি, মেজাজ খিটখিটানি বেড়ে যায়। টিনেজদের ক্ষেত্রে হরমোনের গঠন পরিপূর্ণ হওয়া শুরু করে তাই তাদের ক্ষেত্রেও মেজাজ খিটখিটে থাকা স্বাভাবিক।
২. স্ট্রেস বা চাপ- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর। স্ট্রেস লেভেল যত বেশি টেস্টোস্টেরণ তত কম। আর বিরক্তি রাগ মেজাজ ও তত চড়া। স্ট্রেসের কারণেই পরিবারে বা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি আনাকাঙ্খিত ঝামেলা বাঁধে। সকল পারিবারিক কলহের বাবা এই স্ট্রেস। ঘরের লক্ষীর স্ট্রেস তো যে কোন পুরুষের জন্যই এভারেস্টে উঠার চেয়েও কঠিন বিষয়। এজন্যই ভাবি কলিকাতা হারবাল এত পপুলার কেন! অথচ মানুষ কোন সাইকোলজিস্টের কাছে যাবেনা যেখানে সবচেয়ে ভাল সামাধান সে পাবে। স্ট্রেসের সাথে সেক্সের সম্পর্কের বিষয়ে বলিউডের একটা মুভি আছে Made in Chaina, রাজকুমার রাও এর মুভি। রিকমেন্ডেট!
৩. খাদ্যাভ্যাস বা ওজনের পরিবর্তন ও টেস্টোস্টেরণের ঘাটতি তে সহায়তা করে।
৪. শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা।
৫. ঘুম না হওয়া বা ঘুমের অভ্যাসের পরিবর্তন। এ প্রজন্মের সবচেয়ে বড় শত্রু এটি।
৬. Eating Disorders ৪/৫ ধরণের অাহার ব্যাধি রয়েছে যা আমাদের শারীরিক এবং মানসিক প্রক্রিয়াকে ব্যঘাত ঘটায়।
মূল কথা হলো এই সবগুলা ফ্যাক্টর আমাদের শরীরের হরমোনে ব্যপাক প্রভাব ফেলে বিশেষ করে সেক্স হরমোন টেস্টোস্টেরণে যা আমাদের ইরেটেবল মেইল সিন্ড্রোম বা মেইল পিরিয়ডের দিকে টেলে দেয়। এতে করে আমাদের মেজাজ বিগড়ে থাকে অযথা এবং তার বাজে প্রভাব আমাদের সম্পর্কগুলোতে পড়ে।
এর থেকে বাঁচতে হলে কি করতে হবে?
প্রথমত লক্ষ করা নিজের আবেগ অনুভূতির দিকে। নিজের আচরণের দিকে। আমি কিভাবে রিএক্ট করছি কারো প্রতি, কিভাবে নিচ্ছি কারো কথা, কারো উপর কি কোন কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি কিনা বা কারো সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ছি কিনানা অযথা। যদি IMS এর লক্ষণগুলো আমার দৈনন্দিন জীবনের কাজে বা সম্পর্কে কোনরূপ খারাপ প্রভাব ফেলে তবে আমার এ বিষয়ে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। বেশিরভাগ পুরুষ হরমোনাল এই চেঞ্জকে অস্বীকার করতে চায় কারণ তারা মনে করে এসব মেয়েলী রোগ এবং এতে তাদের সম্মান বা পৌরুষত্ব নষ্ট হবে। যার ফলে এর বাজে প্রভাব গিয়ে পড়ে তাদের সাথে জড়িত নারীদের উপর- মা বউ মেয়ে বা বোনদের উপর।
তারপর স্বীকার করা যে এধরণের একটা সমস্যার ভিতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা। চাপ স্ট্রেস নিয়ন্ত্রনের জন্য একটা রুটিন লাইফ মেন্টেন করার চেষ্টা করা, প্রয়োজনে প্রফেশনালদের সাহায্য নেয়া ( আমরা কি করতে আছি!!)। খাদ্যাভ্যাস এবং ঘুমের ব্যপারে সতর্ক থাকা। নিজে প্রতি যত্নশীল হওয়া, কাছের মানুষদের সাথে নিয়মিত কথা বলা।
মূলত যখন কেউ এ ধরণের কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যায় তখন পারতপক্ষে নিজেকে একটু আলাদা করে রাখা, শান্ত করার চেষ্টা করা, ঠান্ডা পানি পানকরা এবং গভীর ভাবে শ্বাস নেয়া। নিজেকে নিজের সাথে গ্রাউন্ডেড করা।
Irritable male syndrome নিয়ে Dr. Jed Diamond এর তৈরী করা একটা একটি প্রশ্নপত্র আছে যেটাতে মনোসামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছু কুইজ আছে যা পূরণ করে বের করা যায় IMS এর পরিমান। এই পরিমানের উপর ভিত্তি করে ৯ ধরণের বৈশিষ্ট্য বা ক্যারেক্টার (যেমন- irritable, aggressive, withdrawal ইত্যাদি) পাওয়া যায় ছেলেদের। http://www.theirritablemale.com এই ওয়েবসাইটে গিয়ে এটি পূরণ করে জেনে নেয়া যাবে কার মধ্যে কি কি ধরণের ইরিটেবল সিম্পম আছে।
একটা সিক্রেট বলি এবার। আমার ধারণা বেশিরভাগ পুরুষ কাজ শেষ করে সরাসরি বাসায় না গিয়ে বন্ধুদের সাথে সময় কাটায় বা আড্ডা দিতে চায় কারণ তাদের আচরণের উত্তান পতন তাদের বাড়ির মহিলারা বুঝতে পারেনা বলে। অযথা তর্ক করার চেয়ে দূরে থাকাই ভাল। আমি এটা বিশ্বাস করি যে আমাদের দেশের বেশিরভাগ নারী তাদের পার্টনারদের ইমোশন লেভেল পর্যন্ত যেতেই পারেনা। কেমন ফিল করছেন তাদের সঙ্গীটি! গ্রামেতো আরো অবস্থা খারাপ। আমার বাবা চাচাদের তো কখনোই দেখলাম না কখনো বলতে তাদের মন খারাপ বা আমার মা চাচীদের ও এ বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখিনি কখনো। আদতে তারা জানেও না যে পুরুষের ইমোশন বলে কিছু আছে! এজন্য ছেলেরা ঘরমুখী না হয়ে বাহির মুখীই রয়ে গেল আর অনাবিষ্কৃত বা চাপা পড়ে রয়ে গেল তাদের বেচারা আবেগগুলো।
আমার এ লেখাটির উদ্দেশ্য হলো একটা সচেতনতা তৈরী করা যাতে আমরা পাশের মানুষটার প্রতি একটু সহানুভূতি, সমানুভূতি দেখাতে পারি। তাকে সাহায্য করতে পারি। নারী পুরুষ সবার সাথেই যেন আমাদের আন্তরিকতা, সহমর্মিতা বজায় থাকে।
জায়েদ বিন ফরিদ
এসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট &
সাইকোসোসাল কাউন্সেলর,
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।