৩ মার্চ, ২০২০
রাবেয়ার বয়স ২৬ বছর, ২য় সন্তান গর্ভে ছয় মাসে পড়েছে। তার এনোমেলি স্ক্যান করানো হয়েছে, বাচ্চা সুস্থ। তবুও বার বার সে বলছে বাচ্চা সত্যি ঠিক আছে তো?
এটা তার ২য় সন্তান, ১ম সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় ১ম চেক আপ করিয়েছিল চার মাসের সময়, তখন আলট্রাসনোগ্রাম করে দেখা গেল যে বাচ্চার মাথা নেই, জন্মগতভাবেই হয়নি, মাথা ছাড়া কোন বাচ্চা হতে পারে সে জীবনে শুনে নি। আরও পরীক্ষা করে দেখা গেল যে তার অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস এর পরীক্ষা করানো লাগে সে জানত না। জানবে কিভাবে? সে তো কোনদিন ডাক্তার ই দেখায়নি। অগত্যা তার অনাগত শিশু কে জন্মের আগেই চারমাসেই ঔষধ দিয়ে ডেলিভারি করানো হলো। ভয়াবহ সেসব স্মৃতি সে আর ভাবতে পারে না। এবার গাইনি বিশেষজ্ঞ এর তত্ত্বাবধানে গর্ভধারণ এর আগেই সে ফলিক এসিড খাচ্ছে, ডায়াবেটিস ও নিয়ন্ত্রণে। আজ এনোমেলি স্ক্যান এ দেখা গেল বাচ্চা আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে, বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। বিশ্বে প্রতি ১০০ শিশুর ৩ থেকে ৬ জন বড় ধরনের জন্মগত ত্রুটিতে আক্রান্ত এবং এই সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে।
আজ বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস (World birth defect day)। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রায় প্রতিবছর আট মিলিয়ন শিশুর ৬ ভাগ মারাত্মক জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন শিশু জন্মানোর পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায়। শিশুমৃত্যুর চতুর্থ কারণ হিসেবে জন্মগত ত্রুটিকে বিবেচনা করা হয়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার শিশু মারা যায় এ কারণে এবং ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন শিশু, যারা মৃত্যুর ছোবল থেকে বেঁচে যায়, তারা আজন্ম শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে দিন কাটায়।
জন্মগত ত্রুটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, কিন্তু এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় চার হাজারের বেশি রকমের জন্মগত ত্রুটি রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩৩ শিশুর একজন জন্মগত ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীতে আসে। (সূত্র : মার্চ অব ডাইম)
কিন্তু বাংলাদেশে এ দিনটি নিয়ে তেমন কোনো কর্মসূচি দেখা যায় না। এ সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের স্বচ্ছ ধারণাও নেই। বেশির ভাগ সময়ে মাকেই শিশুর জন্মগত ত্রুটির জন্য দোষারোপ করা হয়। অনেকে এর কারণ হিসেবে গর্ভকালীন সূর্যগ্রহণ/চন্দ্রগ্রহণের প্রভাব, খাবার খাওয়ার ফল, মানুষের কুনজর, জিন-পরির আসরকে দায়ী মনে করে।
এখন পর্যন্ত জন্মগত ত্রুটি সম্পর্কে যেসব কারণ জানা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে বংশগত, জিনগত, রক্তসম্পর্কীয় বিবাহ, খুব কম বা বেশি বয়সে সন্তান ধারণ, অপুষ্টি, গর্ভকালীন ধূমপান ও মদ্যপান, সংক্রামক রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হরমোনজনিত সমস্যা, খিঁচুনি, অপচিকিৎসা, তেজস্ক্রিয়তা, ভেজাল খাদ্যদ্রব্য, চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ সেবন ইত্যাদি। গর্ভধারণের আগেই মা-বাবার পূর্ব ইতিহাস জেনে শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি নির্ণয় ও প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ভ্রূণের প্রথম ১২ থেকে ২২ সপ্তাহে ‘হাই রেজল্যুশন আল্ট্রাসনোগ্রামের’ মাধ্যমে বেশির ভাগ ত্রুটি বোঝা যেতে পারে। তাই এই সময়ে গর্ভবতী মায়েদের ‘অ্যানোমালি স্ক্যানিং’ করানো উচিত। এ ছাড়া জিনগত সমস্যা শনাক্ত করতে রক্ত পরীক্ষা এবং ‘অ্যামনিওটিক ফ্লুইড অ্যানালাইসিস’, ‘কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পল অ্যানালাইসিস’ ইত্যাদি এখন বাংলাদেশেই সম্ভব।
আনুমানিক দুই-তৃতীয়াংশ জন্মগত ত্রুটিজনিত রোগের বোঝা সার্জিক্যাল সেবার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়। কিন্তু সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ না করলে এসব শিশুকে অকালমৃত্যু বা দীর্ঘকালীন শারীরিক অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এটি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং এসব শিশু সমাজের জন্য বোঝা হিসেবে বিবেচিত হয়।
জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধের উপায়গুলো হলো রক্তসম্পর্কীয় বিবাহ না করা, খুব কম বা বেশি বয়সে মা না হওয়া, গর্ভধারণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, পরিকল্পিত উপায়ে জন্মদান, গর্ভকালীন নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান থেকে বিরত থাকা, মদ্যপান না করা, ‘অ্যানোমালি স্ক্যানিং’ করা, মাতৃত্বকালীন সেবার মান উন্নয়ন, অপুষ্টি দূরীকরণ ইত্যাদি।
জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। তাই রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, যথাযথ কারণে গর্ভপাতের আইন প্রণয়ন করা, ত্রুটিযুক্ত শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠা করা ও সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। আমাদের উচিত জন্মগত ত্রুটি সম্মন্ধে নিজেদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি পরিবার এবং সমাজের সকলকে সচেতন করে তোলা।
নিজস্ব প্রতিবেদক / ফাহমিদা হক মিতি